অন্তর্জাতিক ডেস্ক: দক্ষিণ আফ্রিকায় সংখ্যালঘু শেতাঙ্গ শাসনের বিরুদ্ধে সুর চড়ানো প্রবীণ লড়াকু, বর্ণবাদ অবসান আন্দোলনের সম্মুখসারির সৈনিক, অনুপ্রেরণামূলক বার্তা আর নাগরিক-মানবাধিকারের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবে পরিচিত শান্তিতে নোবেলজয়ী আর্চবিশপ ডেসমন্ড টুটু মারা গেছেন। রোববার কেপটাউনে ৯০ বছর বয়সে চিরবিদায় নিয়েছেন আফ্রিকার বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম এই নেতা।

টুটুর জীবনের সংক্ষিপ্ত সময়রেখা এক প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স।
• ১৯৩১: দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গের প্রায় ১৭০ কিলোমিটার পশ্চিমের শহর ক্লার্কডর্পে জন্মগ্রহণ করেন টুটু।
• ১৯৪৩: খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী টুটুর পরিবার অ্যাংলিক্যান এক চার্চে যোগ দেয়।
• ১৯৪৭: জোহানেসবার্গের সোফিয়াটাউনের কাছের এক মাধ্যমিক স্কুলে পড়ার সময় যক্ষায় আক্রান্ত হন টুটু। সেই সময় একজন যাজকের সাথে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে এবং অসুস্থতা থেকে সেরে ওঠার পর ওই যাজকের চার্চে সেবা দেওয়া শুরু করেন তিনি।
• ১৯৪৮: জাতীয় নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতার সময় বর্ণবাদের সূচনা করে শ্বেতাঙ্গ জাতীয় পার্টি। বর্ণবাদ চালুর এই উদ্যোগের কারণে দলটি
কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে চাওয়া শেতাঙ্গ ভোটারদের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
• ১৯৫৫: নোমালিজো লিহ শেনক্সেনকে বিয়ে করেন টুটু এবং জোহানেসবার্গের একটি হাই স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন; যেখানে তার বাবা ছিলেন প্রধান শিক্ষক।
• ১৯৫৮: কৃষ্ণাঙ্গ ছাত্রদের বিরুদ্ধে বৈষম্য প্রচার করে এমন শিক্ষাদান ব্যবস্থার অংশ হতে অস্বীকার করে স্কুল ছাড়েন টুটু। স্কুল ছাড়ার পর যাজক হয়ে যান তিনি।
• ১৯৬২: কিংস কলেজ লন্ডনে ধর্মতত্ত্ব নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য ব্রিটেনে পাড়ি জমান তিনি।
• ১৯৬৬: দক্ষিণ আফ্রিকায় ফেরেন টুটু। পরে ইস্টার্ন কেপের একটি সেমিনারিতে ধর্মতত্ত্ব পড়ানো শুরু করেন তিনি। একই সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে নিজের মতামত জানাতেও শুরু করেন।
• ১৯৭৫: জোহানেসবার্গের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ অ্যাংলিক্যান ডিন হন টুটু।
• ১৯৮০: সাউথ আফ্রিকান কাউন্সিল অফ চার্চেসের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে টুটু গির্জার নেতাদের একটি প্রতিনিধি দলকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পিডব্লিউ বোথার সঙ্গে দেখা করেন। এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বে থাকা টুটু দেশটির প্রধানমন্ত্রীর প্রতি বর্ণবাদের অবসানের আহ্বান জানান। এই বৈঠকে কোনও লাভ না হলেও দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য সেটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত; যেখানে একজন কৃষ্ণাঙ্গ নেতা দেশের সবচেয়ে ঊর্ধ্বতন শ্বেতাঙ্গ সরকারি কর্মকর্তার মুখোমুখি হয়েছিলেন। বৈঠকের পর দেশটির সরকার টুটুর পাসপোর্ট জব্দ করে।
• ১৯৮৪: শ্বেতাঙ্গ সংখ্যালঘু শাসনের অবসান ঘটানোর প্রচেষ্টার জন্য টুটুকে নোবেল শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়।
• ১৯৮৫: টুটু জোহানেসবার্গের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ বিশপ হন। বর্ণবৈষম্য দূর করতে তিনি প্রকাশ্যে দক্ষিণ আফ্রিকায় অর্থনৈতিক বয়কট ও নাগরিক অসহযোগ শুরু করেন।
• ১৯৮৬: কেপ টাউনের বিশপ হন এবং সাউদার্ন আফ্রিকা প্রদেশের অ্যাংলিকান চার্চের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি হয়ে ওঠেন টুটু। অন্যান্য গির্জার নেতাদের সাথে কৃষ্ণাঙ্গ প্রতিবাদকারী এবং সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বন্দ্বের মধ্যস্থতা করেন তিনি।
• ১৯৯০: প্রেসিডেন্ট এফডব্লিউ ডি ক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসকে (এএনসি) নিষিদ্ধ তালিকা থেকে অপসারণ এবং কারাবন্দী নেলসন ম্যান্ডেলাকে মুক্তির পরিকল্পনা ঘোষণা করেন।
• ১৯৯১: বর্ণবাদ আইন ও বর্ণবাদী বিধি-নিষেধ বাতিল এবং রাষ্ট্র ও ১৬টি বর্ণবাদবিরোধী গোষ্ঠীর মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
• ১৯৯৪: দেশের প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে এএনসির বিপুল বিজয়ে ম্যান্ডেলা ক্ষমতায় আরোহনের পর বর্ণবাদ-পরবর্তী বহু জাতিগোষ্ঠীর দেশের জন্য ঐক্যকে তুলে ধরতে ‘রেইনবো নেশন’ কথাটি প্রবর্তন করেন ডেসমন্ড টুটু।
• ১৯৯৪: ম্যান্ডেলা টুটুকে ট্রুথ অ্যান্ড রিকনসিলিয়েশন কমিশনের চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। বর্ণবাদের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘন অপরাধীদের কথা শোনার, রেকর্ড করার এবং কিছু ক্ষেত্রে সাধারণ ক্ষমার জন্য এই কমিশন গঠন করা হয়।
• ১৯৯৬: কেবলমাত্র কমিশনের কর্মকাণ্ডে মনোনিবেশ করার জন্য টুটু চার্চ থেকে অবসর নেন। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন, সমতার প্রচার এবং রিকনসিলিয়েশনের কাজ অব্যাহত রাখেন তিনি। পরবর্তীতে দক্ষিণ আফ্রিকার আর্চবিশপ এমিরেটাস হন তিনি।
• ১৯৯৭: প্রোস্টেট ক্যান্সারে আক্রান্ত হন টুটু। এরপর থেকে তিনি বারবার সংক্রমিত হন এবং চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি হন।
• ২০১১: তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা দালাই লামা বার্ষিক ডেসমন্ড টুটু ইন্টারন্যাশনাল পিস লেকচার উদ্বোধন করেন। এই অনুষ্ঠানে অংশ নিতে তিব্বতের নেতাকে ভিসা দিতে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার অস্বীকৃতি জানানোয় স্যাটেলাইট লিংকের মাধ্যমে পিস লেকচার উদ্বোধন করেন টুটু।
• ২০১৩: টুটু এএনসি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রকাশ্যে এই দলটির সমালোচনা করেন। বৈষম্য, সহিংসতা এবং দুর্নীতি মোকাবিলায় এএনসি ব্যর্থ হওয়ায় তিনি দলটিকে আর ভোট দেবেন না বলে জানান।
• ২০১৩: ‌‘দেশের নৈতিক দিকনির্ণায়ক’ হিসাবে টুটু সমকামীদের অধিকারের প্রতি নিজের সমর্থন ঘোষণা করেন। বলেন, তিনি কখনই এমন ঈশ্বরের উপাসনা করবেন না; যিনি হোমোফোবিক।
• ২০২১ দীর্ঘ অসুস্থতায় ভুগে দুর্বল-ভঙ্গুর হয়ে যাওয়া টুটুকে তার ৯০তম জন্মদিনে বিশেষ থ্যাংসগিভিংয়ের জন্য হুইল চেয়ারে করে কেপ টাউনের সেন্ট জর্জের ক্যাথেড্রাল ঘুরিয়ে দেখানো হয়; যা এক সময় বর্ণবাদবিরোধী কর্মীদের স্বর্গভূমি হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
• ডিসেম্বর ২৬, ২০২১: ৯০ বছর বয়সে কেপ টাউসে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন টুটু

টুটুর কিছু বিখ্যাত উক্তি

• আপনার আওয়াজ বাড়াবেন না। বরং আপনার যুক্তিকে আরও শানিত করুন।
• আমাদের নদী থেকে লোকজনকে টেনে তোলা বন্ধ করতে হবে। আমাদের উজানে যেতে হবে এবং খুঁজে বের করতে হবে কেন তারা পানিতে পড়ছে।
• আঁধারের মধ্যেও যে আলো আছে তার আশা দেখা যাচ্ছে।
• ক্ষমা ছাড়া কোনও ভবিষ্যৎ নেই।
• আপনি যেখানে আছেন, সেখান থেকে সামান্য হলেও ভালো কিছু করুন। এটি সেই সামান্য কিছু ভালো জিনিস; যা বিশ্বকে আচ্ছন্ন করে ফেলে।
• আমি চুপ থাকতে পারতাম, কিন্তু আমি পারি না এবং আমি চুপ থাকতে পারবো না।-আমাদের সময়.কম