স্টাফ রিপোর্টার ।। হজের কারণে লডার কেনার কিছুটা ধুম পড়েছিল। সে মৌসুম শেষ। লাগাম টানা হয়েছে সরকারি কর্মকর্তা ও ব্যাংকারদের বিদেশ যাত্রায়। করোনা পরবর্তী নানা ঝক্কি-ঝামেলার কারণে মানুষের বিদেশ ভ্রমণও কমেছে। আমদানিতেও চলছে বেশ কড়াকড়ি। তাহলে ডলারের দাম বাড়ছে কেন?-এ প্রশ্নের উত্তরে সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের মন্তব্য মুখ্য কারণ ‘মজুত’। অধিক মুনাফার নেশায় চাল, ডাল, তেল ও লবণের মতোই ডলার’কেও পণ্য ভেবে মজুত করা হচ্ছে। আর এই মজুতের পিছনে রয়েছে তিনটি চক্র। এই চক্র হলো কয়েকটি বাণিজ্যিক ব্যাংক, মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠান ও অসাধু ব্যবসায়ীরা। এ তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক ও গোয়েন্দা সংস্থা ডিবি। এর ফলে ডলার মজুতের হিড়িক পড়েছে। লাগামহীন ডলার বাজারে তাই মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অশুভ চক্র গুজব তুলেছে, সামনে ডলারের দাম আরো বাড়বে। সেই গুজবে হুজুগে বাঙালি এখন ছুটছেন ডলারের পিছনে। অনেকে প্রতারিতও হচ্ছেন। তাই তো ডলারের কারসাজি বন্ধে ব্যাংক ও মানিচেঞ্জার প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বন্ধ ও দায়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কঠোর হুশিয়ারি এবং আমদানিতে কড়াকড়ি সহ চতুর্মুখী চাপেও ডলার বাজারের উর্ধ্বমুখী লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না।

জানাগেছে, বিশ্ববাজারে অস্থিরতায় ‘ডলারের দাম আরো বাড়বে’-এ প্রত্যাশায় অধিক মুনাফার নেশায় মানুষ শেয়ারবাজারের মতোই ডলার সংগ্রহে বিনিয়োগ করছেন। ব্যাংকের মাধ্যমে ডলার সংগ্রহে পাসপোর্ট ও এনডোর্সমেন্ট ঝামেলা এড়াতে তারা খোলাবাজারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন। কারণ খোলা বাজারে ডলার সংগ্রহে এসব ঝামেলা পোহাতে হয় না। কেউ কেউ ফেসবুকে, ম্যাচেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ ডলার কেনা-বেচার লোভনীয় প্রস্তাব দিচ্ছে। সেই পথে পা বাড়িয়ে অনেকেই হচ্ছেন প্রতারিত।

‘ডলার বাজারে কেন এত অস্থিতরতা’-এ তথ্য অনুসন্ধানে বাংলাদেশ ব্যাংক ও ডিবি মাঠে নেমে তথ্য পেয়েছে একটি চক্র বাজার থেকে অপ্রয়োজনে ডলার কিনে মজুত করছে। দাম বাড়লে সেগুলো বাজারে বিক্রি করে মুনাফা লুটে নেওয়ার জন্যই এসব করা হচ্ছে। এজন্য তারা তিনটি চক্রকে শনাক্তও করেছে। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংক মুনাফার জন্য অপেশাদারি আচরণ করছে। একটি ব্যাংক নগদ ১০৪ টাকায় কিনে ১০৮ টাকায় ডলার বিক্রি করছে বলেও তথ্য পেয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এছাড়া বেশকিছু ব্যাংক নগদ ডলার বেচাকেনার ক্ষেত্রে ২ থেকে ৩ টাকা মুনাফা করছে। কিছু ব্যাংক প্রভাবশালী ও নিকটজনের কাছে বেশি মাত্রায় ডলার বিক্রি করেছে। সেগুলোও নেওয়া হয়েছে বেআইনিভাবে।

মুনাফার নেশায় মেতেছে মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠান। তাদের অনেকেই ১০২ টাকা করে ডলার কিনে ১০৮ টাকায় বিক্রি করেছে। অনেকে অফিসিয়াল চ্যানেলে কম দামে ডলার কিনে খোলাবাজারে বেশি দামে বিক্রি করেছে। বাজারে সংকটের আভাস পেয়ে আগে থেকেই ডলার কিনে মজুত করা হচ্ছে।

অসাধু ব্যবসায়ীরাও পণ্য মজুতের মতো ডলার মজুতেও নেমেছে। তারা মূলত ডলারকে চাল, ডালের মতো নিত্যপণ্য মনে করে মজুত করছে। ব্যাংক থেকে টাকা তুলে ব্যবসায়ীরা এখন খোলা বাজারে ডলার কিনছে। এভাবেই সৃষ্টি হচ্ছে ডলার সংকট, অস্থির হচ্ছে ডলার বাজার।

এর আগে গত মে মাসে খোলাবাজারে ডলারের দাম বাড়লে একটি গ্রুপ বাজার থেকে ডলার কিনে মজুত করে। ওই সময়ে প্রতি ডলারের দাম ১০৪ টাকায় উঠেছিল। পরে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও গোয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপে কমে আসে।

এবিবি’র চেয়ারম্যান সেলিম আরএফ হোসেন বলেছেন, একটি গোষ্ঠী বেআইনিভাবে ডলার মজুত করে বিপুল অঙ্কের মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছে। তারা পরিকল্পিতভাবে বাজার অস্থির করে তুলছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিদর্শক দলের সূত্র বলছে, কার্ব মার্কেট থেকে একটি গ্রুপ সংঘবদ্ধ হয়ে ডলার কিনছে। এমন তথ্যও পাওয়া গেছে, ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নগদ ডলার কিনেছে। অনেকের মধ্যে গুজব রয়েছে, ব্যাংকে টাকা থাকলে তার কোনো মূল্য থাকবে না। মূল্যস্ফীতির কারণে টাকার মান অনেক বেশি কমে যাবে। যেকারণে তারা ডলার কিনে মজুত করছে।

তবে ডলার বাজার নিয়ন্ত্রণে সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকারের একাধিক সংস্থা। বাংলাদেশ ব্যাংক, বাণিজ্যিক ব্যাংক ও মানি চেঞ্জার প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনুসন্ধান চলছে। খোলাবাজারে ডলারের দাম নিয়ে কারসাজি বন্ধে পুলিশের ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চ (ডিবি) তদন্ত করছে। ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই, ব্যাংকারদের সংগঠন এবিবিও এ বিষয়ে কাজ করেছে। ডলারের বাজারে কারসাজি প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউজের লাইসেন্স বাতিল করবে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর রশিদ বলেছেন, বেআইনিভাবে বাজার থেকে ডলার কিনে মজুত করলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কৃত্রিমভাবে ডলারের দাম কেউ বাড়াচ্ছে কি না তা তদারকি করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১১টি টিম এক সাথে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে অভিযান শুরু করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া ডলারের দরের চেয়ে এক টাকা থেকে সর্বোচ্চ দেড় টাকা পার্থক্য হতো ব্যাংকের নগদ ডলারের মূল্যে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঁধে দেয়া ৯৪ টাকা ৭০ পয়সা দরে ডলার বিক্রির নির্দেশনা দেওয়া হলেও ব্যাংকগুলো ডলার বিক্রি করছে ১০৫ টাকা থেকে ১০৮ টাকা পর্যন্ত। বাস্তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের এ মূল্যের কোনোই কার্যকারিতাই নেই। ব্যাংকগুলোতে প্রকৃতপক্ষেই ডলার সঙ্কট রয়েছে নাকি কৃত্রিমভাবে ডলারের সঙ্কট সৃষ্টি করা হচ্ছে তা তদারকি করার জন্যই ব্যাংকগুলোর ট্রেজারি বিভাগে লেনদেনে হানা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দেখা হচ্ছে, ব্যাংকগুলো বাস্তবে কী দরে বিদেশী মানিচেঞ্জারগুলোর কাছ থেকে রেমিট্যান্স সংগ্রহ করছে, আর বিক্রি করছে কত মূল্যে। কেউ ডলার লেনদেনের ক্ষেত্রে অতিমুনাফা করছে কি না তা তদারকি করা হচ্ছে।

ব্যাংকের মতো মানিচেঞ্জারগুলোতেও তদারকি জোরদার করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কোনো মানিচেঞ্জার কারসাজির মাধ্যমে ডলারের মূল্য বাড়িয়ে অতিমুনাফা করছে কি না সেজন্য তদারকি করা হচ্ছে। ডলারের দাম নিয়ে অস্থিরতা ঠেকাতে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর হবে বলে জানিয়েছেন আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম।

এদিকে বাজার তদারকির পাশাপাশি আমদানি ব্যয়ের হ্রাস টানার চেষ্টা করা হচ্ছে। ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ ডলারের ওপরে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করা হয়েছে। পাশাপাশি সরকারি জ্বালানি তেল, ভোগ্যপণ্যসহ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে সঙ্কটে পড়া ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রত্যাশা এ চেষ্টা অব্যাহত থাকলে বৈদেশিক মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রিত হবে। কেউ কারসাজির মাধ্যমে বাজার ঘোলাটে করতে পারবে না।

তবে এমন কঠোর ব্যবস্থার মধ্যেও ডলার দাম বাড়ছে হু হু করে। এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ডলারের মূল্য ১১২ টাকায় উঠেছিল। এভাবে যদি বাড়তেই থাকে আর ডলারেরও মজুত করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক ঝুঁকি বাড়ার শঙ্কাই বেশি।