Home মতামত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ১০৪ বছর

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ১০৪ বছর

34

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে পরাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আলোচিত কুখ্যাত গণহত্যা জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের একশত চার বছর পূর্ণ হয়েছে এবার।
১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল আলোড়ন সৃষ্টিকারী মর্মস্পর্শী ঘটনা হচ্ছে এই হত্যাকাণ্ড। এই দিনে ব্রিটিশ প্রশাসনের নির্দেশে অবিভক্ত ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের অমৃতসর শহরে জালিয়ানওয়ালাবাগের সমাবেশে কয়েকশ সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করা হয়।
তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সবেমাত্র শেষ হয়েছে। ভারত থেকে হাজার হাজার সৈনিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ব্রিটিশ সরকার যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিনিময়ে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার মৌখিক প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নিয়ে হাজার হাজার ভারতীয় প্রাণ দেয়। আহত হয় অসংখ্য মানুষ। একই সময়ে ১৯১৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ভারতে রাউলাট অ্যাক্ট জারি করে। এই আইনের আওতায় রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করার অধিকার হারায় স্বাধীনতাকামী ভারতীয় জনগণ। অবিভক্ত ভারতবর্ষের প্রতিটি অঞ্চলে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম নতুন করে বৃহত্তর জনমনে আগুন লাগতে শুরু করে। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে সংগ্রামের এ ধাক্কা প্রবলভাবে অনুভূত হয়। জালিয়ানওয়ালাবাগে রাউলাট অ্যাক্টবিরোধী প্রতিবাদে জড়িয়ে পড়ে সেই অঞ্চলের মানুষ। ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগে সরকারের আদেশ অমান্য করে ছয় থেকে ১০ হাজার মানুষের একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সরকারের আদেশ অমান্য করে সে সভাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য ব্রিটিশ সেনানায়ক জেনারেল রেগিনাল্ড ডায়ার এই সভার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। সেই দিনের গুলিতে, সরকারি ভাষ্যমতে, ৩৭৯ সাধারণ ব্যক্তি নিহত হন এবং আহত হন দুই হাজার ব্যক্তি। এই ঘটনাটি ইতিহাসে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড নামে পরিচিত। এই হত্যাকাণ্ডের পরে পাঞ্জাবের অমৃতসর হয়ে উঠে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে চালিত স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণকেন্দ্র।

কংগ্রেস সদস্য শশী থারুর তার ‘ইনগ্লোরিয়াস এম্পায়ার: হোয়াট দ্য ব্রিটিশ ডিড টু ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের ভূমিকায় লিখেছেন, Jallianwala Bagh Massacre: General Dyer orders gurkha troops to shoot unarmed demonstrators in Amritsar, killing at least 379. Massacre convinces Gandhi that India must demand full independence from oppressive British rule.

হত্যাযজ্ঞে নির্দেশদানকারী জেনারেল রেগিনাল্ড ডায়ারকে নিয়ে নাইজেল কোলেট লিখেছেন ‘দ্য বুচার অব অমৃতসর: জেনারেল রেগিনাল্ড ডায়ার’ নামক গ্রন্থ, যেটি লন্ডন থেকে ২০০৫ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটির শেষ অংশে লেখক মন্তব্য করেছেন, It became impossible for the British to leave India in 1947, with honor, with appreciation or respect of their subjects.’ ফলে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয় তা হলো জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ব্রিটিশদের নৈতিক দিককে আঘাত করে। অনেকের মতে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ভারতের রাজনীতিতে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। অনেকাংশে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম নতুন উদ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
দিনটি ছিল রোববার। ১৯১৯ সালের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ। পাঞ্জাবে যে সময় শিখদের নববর্ষ ও অন্যদের বৈশাখ উদযাপনের আয়োজন চলছে, সেই সময় রেগিনাল্ড ডায়ারকে দায়িত্ব দেওয়া হয় শহরে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় রাখার জন্য। সেই লক্ষ্যে ডায়ার ১৩ এপ্রিল অমৃতসরে আসেন। বিকাল ৪টায় ডায়ার জানতে পারেন জালিয়ানওয়ালাবাগ এলাকায় সাধারণ জনতা ব্রিটিশবিরোধী সমাবেশে জমায়েত হয়েছে। ডায়ার তার সহযোগী ক্যাপ্টেন এফসিসি ব্রিগস ও সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে, পুলিশের এসপিকে সঙ্গে করে কয়েকটি গাড়িবহরসহ জনসমাবেশের দিকে যাত্রা করেন। শহরের রেলসেতু অতিক্রম করে যে পথে ডায়ার অগ্রসর হচ্ছিলেন সেখানে দুই দিন আগে, অর্থাৎ ১০ এপ্রিল, তিন ইংরেজ ব্যাংকারকে হত্যা করা হয়, রানি এলিজাবেথের মূর্তি ভাঙা হয়। তখন বিকাল ৫টা। জালিয়ানওয়ালাবাগ ময়দানে প্রবেশপথ এত সংকীর্ণ ছিল যে ডায়ারের সশস্ত্র বাহিনী সেখানে গোলাবারুদ নিয়ে ঢুকতে পারছিল না। ঠিক সেই মুহূর্তে জমায়েতকারীদের মধ্যে কোনো এক ব্যক্তি ভাষণ দিচ্ছিলেন। ৫টা বাজার পাঁচ মিনিটের মাথায় ডায়ার উপস্থিত জনতাকে লক্ষ করে গুলি ছোড়ার নির্দেশ দেন। ১০ মিনিটে নিরস্ত্র জনগণের ওপর এক হাজার ৬৫০টি গুলি খরচ করা হয়।

পটভূমি

১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষ সম্পূর্ণরূপে ইংরেজ শাসনের অধীনে আসে। শাসনের এক পর্যায়ে ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই ভারতের উদীয়মান ধনী এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মধ্যে স্বায়ত্তশাসন এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা জেগে উঠে। এই আকাঙ্ক্ষার সংহত রূপ প্রকাশ পায় ১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। প্রথম দিকে এই রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য ছিল ইংরেজ শাসনাধীনে থেকেই ন্যায়বিচার এবং স্বায়ত্তশাসন লাভ। কিন্তু ইংরেজ সরকারের পক্ষ থেকে এ দাবী মেনে নেয়া হয়নি। ইংরেজদের যুক্তি ছিল ভারতবর্ষ অনুন্নত বিধায় স্বায়ত্তশাসনের উপযুক্ত নয়। কিন্তু ভারতে এ ধরনের চিন্তাধারার প্রসার ঘটতে থাকে। ধীরে ধীরে এদেশের অনেক স্থানেই রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়, এক সময় টেলিগ্রাফ তারও বসানো হয়। কিছু কিছু কল-কারখানাও স্থাপিত হয়, মূলত কাপড়ের কারখানা প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ঘটনার প্রভাবও এখানে পরিলক্ষিত হয়। ১৯০৫ সালে রাশিয়ার মতো বৃহৎ শক্তি ক্ষুদ্র এশীয় শক্তি জাপানের কাছে রুশ-জাপান যুদ্ধে পরাজিত হয়। একই সময়ে রাশিয়ায় স্বৈরাচারী জারের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। ধনতান্ত্রিক দেশগুলোতে অর্থনৈতিক সংকট শুরু হওয়ায় এশিয়া এবং আফ্রিকার অনুন্নত দেশগুলো দখল করে নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেয়ার জন্য উন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। এরই ফল ছিল ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধে জার্মানি ইংল্যান্ড তথা মিত্রবাহিনীর হাতে পরাস্ত হয়। যুদ্ধে ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীও অংশ নিয়েছিলো। ইংরেজ সরকার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, যুদ্ধে অংশ নিলে পরাধীন দেশগুলোকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা হবে। এই কথায় ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অগ্রদূত মহাত্মা গান্ধী সহ অনেকেই যুদ্ধে যোগ দেন এবং যুদ্ধে ভারতবাসীকে উৎসাহিত করেন।

১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর যুদ্ধ শেষ হয়। কিন্তু ইংরেজ সরকারের নীতিতে কোন রকম পরিবর্তন দেখা যায়নি। যেসব সৈন্য যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল এসময় তাদের বেকার করে নিজ নিজ গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। অর্থনৈতিক মন্দা এবং দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিতে এক কোটির বেশি মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ভারতবাসীর মনে সন্দেহ ঘনীভূত হতে থাকে। এই সন্দেহ থেকেই ক্ষোভ এবং ইংরেজ বিরোধী মনোভাবের সূচনা ঘটে। এসময় ইংরেজ সরকার একদিকে যেমন মন্টেগু-চেমসফোর্ড শাসন সংস্কার আইন করে তাদেরকে শান্ত করার চেষ্টা করে একই সাথে আবার রাওলাট আইন করে ইংরেজ সরকার বিরোধী সকল বিক্ষোভ কঠোর হাতে দমনের জন্য নির্যাতনমূলক আইন জনগণের উপর চাপিয়ে দেয়। এই আইনের অধীনে বিনা কারণে গ্রেপ্তার, অন্তরীণ ও সংক্ষিপ্ত সাক্ষ্য প্রমাণহীন বিচার ও বন্দীত্বের বেপরোয়া পদক্ষেপ গৃহীত হয়। মহাত্মা গান্ধী তখন অহিংস এবং সত্যাগ্রহ তথা রক্তপাতহীন আন্দোলনের মাধ্যমে এর প্রতিবাদের আয়োজন করেন। এই সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে পাঞ্জাব যাওয়ার পথে গান্ধীজিকে গ্রেফতার করা হয়। এর প্রতিবাদে আহমেদাবাদের শিল্প শ্রমিক এবং পাঞ্জাবের সাধারণ জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। সরকার গান্ধীকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। এর পরও বিক্ষোভ কমেনি। ধর্মঘটে এবং বিক্ষোভের লক্ষ্য হয়ে দাড়ায় সরকারী দপ্তর এবং যানবাহন। সাদা চামড়ার ইউরোপীয় কর্মকর্তা এবং অধিবাসীদের উপরও ভারতীয়রা ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। তাদের উপরও আক্রমণ করা হয়। এপ্রিলের ১৩ তারিখ দুজন রাজনৈতিক নেতাকে অমৃতসর থেকে গ্রেফতার করা হয়। এর পটভূমিতেই বলতে হয় হত্যাকাণ্ডের আবহ তৈরি হয়েছিল।

হত্যাকাণ্ড

হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ১৯১৯ সালের ১৪ এপ্রিলে ডায়ারের নিজের ডেসপ্যাচ অনুসারে ১৩ এপ্রিল ১০০ জন গুর্খা সৈন্য আর ২টি সাজোয়া গাড়ি নিয়ে ডায়ারের নির্দেশে জালিয়ানওয়ালাবাগে ২০০০-এর মত “বিদ্রোহী”কে হতাহত করা হয়েছিল। আর এতে খরচ হয়েছিল ১৬৫০ রাউণ্ড গুলি। জালিয়ানওয়ালাবাগের মাঝখানে কুয়োতে পাথর ফেলে কিছু মানুষকে জীবন্ত প্রোথিত করা হয়।

প্রতিক্রিয়া

জালিয়ানওয়ালাবাগের ভয়ানক ও মর্মান্তিক হত্যাকান্ডের ঘটনায় ব্রিটিশ শাসনের প্রকৃত নগ্ন রূপের প্রকাশ হয়ে পড়ে। সরকার জেনারেল ডায়ারের কাজকে সমার্থন করে। কিন্তু এই হত্যাকান্ডের ঘটনায় গোটা বিশ্ব শিহরিত হয়। দেশে-বিদেশে সর্বত্র সরকারের নগ্ন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের ঘটনার প্রতিবাদে দেশের সর্বত্র ঘৃণা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন যে, “এই হত্যাকান্ডের ঘটনা ভারতে যে মহাযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেয় তা উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে পড়ে সবার হৃদয়কে আন্দোলিত করে।” জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘৃণ্য ও বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া “নাইট” উপাধি ত্যাগ করেন। দিল্লির হাকিম আজমল খান তাঁর ‘মসিহ-উল-মূলক’ উপাধি এবং প্রথম শ্রেণীর ‘কাইসার-ই-হিন্দ’ স্বর্ণ মেডেল ব্রিটিশ সরকারকে ফেরত দেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এই ঘটনাকে তীব্র নিন্দা করে; কংগ্রেস নেতা সি.এফ.এন্ডুজ এই ঘটনাকে ‘কসাইখানার গণহত্যা’র সমতুল্য বলে নিন্দা করেছেন।

রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড প্রত্যাখ্যান

জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে রবীন্দ্রনাথ প্রচণ্ডভাবে মর্মাহত হন। ঘটনার প্রতিবাদে তিনি তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড চেমসফোর্ডকে দীর্ঘ পত্র লেখেন। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সেই চিঠিতে তিনি ইংরেজ শাসন-শোষণের প্রতি তীব্র ধিক্কার প্রকাশ করেন। পত্রে তিনি উল্লেখ করেন, The time has come when badges of honor make our shame glaring in the incongruous content of humiliation, and I for my part wish to stand, shorn, of all special distinctions, by side of those of my countrymen who, for their so-called insignificance, are liable to suffer degradation not fir for human beings. And these are the reasons which have compelled me to ask Your Excellency, with due deference and regret, to relieve me my title of knighthood which I had honor to accept from His Majesty the king at the hand of your predecessor, for whose nobleness of heart I still entertain great admiration. যদিও ব্রিটিশ সরকার রবীন্দ্রনাথের স্যার উপাধি বর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি, সেখানে আকবর আলি খান লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড উপাধি ত্যাগের ফলে ব্রিটিশ সরকারের জন্য একটি বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
রবীন্দ্র গবেষক সনৎকুমার সাহা মন্তব্য করেছেন, কবির তৃতীয় নয়নের তেজ ও বিবেকসিদ্ধ ক্রোধ ফুটে উঠতে দেখি জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর একক সিদ্ধান্তে নাইটহুড পরিত্যাগের প্রতিবাদলিপিতে। পৃথিবীর সেরা প্রতিবাদী সাহিত্যে এর তুল্য রচনা খুব বেশি নেই।

গুজরানওয়ালায় বিক্ষোভ

দুই দিন পরে ১৫ এপ্রিল গুজরানওয়ালায় বিক্ষোভ সংঘটিত হয় অমৃতসরের হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ ও বিমান ব্যবহার করা হয়, এরফলে ১২ জন মারা যায় এবং ২৭ জন আহত হয়। ভারতে রয়েল এয়ার ফোর্স অফিসার কমান্ডিং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এন ডি কে ম্যাকুইন পরে বিবৃতি দিয়েছিলেন:

আমি মনে করি পরের দাঙ্গাগুলিতে বিশেষভাবে গুজরানওয়ালায় বিক্ষোভের সময় আমাদের ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করার কথা উল্লেখযোগ্যভাবে দাবি করতে পারি, যেখানে বিক্ষোভকারীরা বিপদজ্জনক ভাবে তাকিয়ে ছিল এবং বোমা এবং লুইস বন্দুক ব্যবহার করা হয় তাদের বিক্ষোভের উপর।

স্মৃতিস্তম্ভসমূহ ও উত্তরাধিকার

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কর্তৃক একটি রেজোলিউশন পাস হওয়ার পর ১৯২০ সালে একটি ট্রাস্ট প্রতিষ্ঠিত হয় একটি স্মারক নির্মাণের জন্য। ১৯২৩ সালে ট্রাস্ট এই প্রকল্পের জন্য জমি কিনে নেয়। আমেরিকার স্থপতি বেঞ্জামিন পোলক দ্বারা পরিকল্পিত একটি স্মারক, ওই স্থানে নির্মিত হয়েছিল এবং ১৯৬১ সালের ১৩ ই এপ্রিল ভারতের রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ উদ্বোধন করেন জওহরলাল নেহেরু ও অন্যান্য নেতাদের উপস্থিতিতে। পরে একটি শিখা স্থানটিতে যোগ করা হয়েছিল।

বুলেট বা গুলির চিহ্ন দেয়ালের এবং পাশের বাড়ী থেকে আজও দেখা যায়। বেশিরভাগ মানুষ বুলেট থেকে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে যাচ্ছিল।

শিরোমণি গুরুদ্বার প্রবন্ধক কমিটি গঠনের

হত্যাকাণ্ডের অল্প কিছুদিন পরে, অমৃতসরের হরমন্দির সাহিব (স্বর্ণমন্দির) সরকারী শিখ সম্প্রদায়ের কর্ণেল ডায়ার শিরোপা (শিখ ধর্মের প্রতি সম্মানিত পরিচয়ের চিহ্ন বা সাধারনত মানবতা) দ্বারা শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে আন্দোলন প্রেরণ করা হয়। ১৯২০ সালের ১২ অক্টোবর মহাশ্বেতা খালসা কলেজের ছাত্র ও অনুষদ মহোদয়ের নিয়ন্ত্রণ থেকে গুরুদ্বার অবিলম্বে অপসারণের দাবিতে একটি সভা আহ্বান করে। ফলস্বরূপ ১৯২০ সালের ১৫ নভেম্বর শিখ মন্দিরের সংস্কার ও সংস্কারের জন্য শিরোমণি গুরুদ্বার প্রবন্ধক কমিটির গঠন করা হয়ে ছিল।

দুঃখ প্রকাশ

যদিও ১৯৬১ ও ১৯৮৩ সালে তার রাজ্যের পরিদর্শনে রাণী এলিজাবেথ এই বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেননি, তবুও তিনি ১৯৯৭ সালের ১৩ অক্টোবর সালে ভারতে রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় ঘটনাগুলি সম্পর্কে বক্তব্য রাখেন:

এটা আমাদের গোপন কিছু বিষয় নয়, এটা অতীতের কিছু জঘন্য ঘটনার কথা – জালিয়ানওয়ালাবাগ, যা আমি আগামীকাল পরিদর্শন করব, এটি একটি দুঃশ্চিন্তার উদাহরণ। কিন্তু ইতিহাস পুনর্বিবেচনা করা যায় না, তবে আমরা কখনও কখনও অন্যথায় উপকৃত হতে পারি। এটা বিষাদের মুহূর্ত, সেইসাথে খুশিও আছে। আমাদের দুঃখ থেকে শিখতে হবে এবং আনন্দে গড়ে তুলতে হবে।
১৯৯৭ সালের ১৪ অক্টোবর রাণী এলিজাবেথ দ্বিতীয়বার জালিয়ানওয়ালাবাগ পরিদর্শন করেন এবং ৩০-সেকেন্ডের নীরবতার মুহূর্তের সাথে তার সম্মান প্রদান করেন। পরিদর্শনকালে, তিনি গোলাপী জাফরান বা কেওরা বর্ণের একটি পোশাক পরেন, যা শিখদের ধর্মীয় গুরুত্বের বার্তা ছিল। স্মৃতিস্তম্ভ পরিদর্শনের সময় তিনি তার জুতা খুলে ফেলেছিলেন এবং স্মৃতিস্তম্ভে একটি জয়মাল্য পরিয়ে দিয়েছিলেন।

যদিও কিছু ভারতীয় বিবৃতিতে দুঃখ ও দুঃখ প্রকাশের জন্য স্বাগত জানায়, অন্যেরা ক্ষমা না চাওয়ার কারণে সমালোচনা করেছিল। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্র কুমার গুজরাল রানীর সম্পর্কে বলেছিলেন যে, রাণী নিজেও ঘটনার সময় জন্মগ্রহণ করেনি এবং তাকে ক্ষমা করার প্রয়োজন নেই।

ব্রিটিশ বিরোধী ভারতবর্ষের স্বাধীনতার লড়াই সংগ্রামে জালিয়ানওয়ালাবাগের সমাবেশে নির্বিচারে গুলিবর্ষণে শহীদদের আমরা ভুলবোনা কোনদিন। সকল শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অভিবাদন!!

-লেখক:মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।