Home জাতীয় গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির চাপ ‘ভোক্তার ওপরই পড়বে’

গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির চাপ ‘ভোক্তার ওপরই পড়বে’

22

ডেস্ক রিপোর্ট: আর্থিক চাপ সামলাতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে একের পর এক দাম বাড়াচ্ছে সরকার। গত জুনে গ্যাসের দাম গড়ে ২৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছিল। ৭ মাস পর এবার গ্যাসের দাম বাড়ল ৮২ শতাংশ।

শিল্প, বিদ্যুৎ ও বাণিজ্যিক খাতের গ্রাহকেরা দেবেন বাড়তি এ দাম। তবে পরিবহন খাতে ব্যবহৃত সিএনজি ও বাসায় ব্যবহৃত গ্যাসের দাম বাড়ায়নি সরকার। নতুন দাম ফেব্রুয়ারি থেকে কার্যকর হবে।

এখন বিদ্যুতের পর গ্যাসের দাম বাড়ায় পণ্যের উৎপাদন খরচ বাড়বে। এতে বাজারে পণ্যের দাম আরেক দফা বাড়তে পারে। মূল্যস্ফীতিকে এটি আরও উসকে দিতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাসের এই মূল্যবৃদ্ধির চাপও আদতে পড়বে সাধারণ মানুষের ওপরই।
২০০৯ সাল থেকে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানো হয় গণশুনানির মাধ্যমে। এটি করে আসছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এতে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ার কারণে ইচ্ছেমতো দাম বাড়ানো যায় না। গত ডিসেম্বরে বিইআরসি আইন সংশোধন করে এ ক্ষমতা নিজেদের হাতে নিয়েছে সরকার। নিয়মিত দাম সমন্বয় করতে চায় তারা। এরপর এ মাসেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর ঘোষণা এল নির্বাহী আদেশে।
গতকাল বুধবার গ্যাসের নতুন দাম নির্ধারণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ। পরে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাখ্যায় জ্বালানি বিভাগ বলেছে, খোলাবাজার থেকে চড়া দামে এলএনজি কিনে গ্যাসের চাহিদা পূরণের জন্য বিদ্যুৎ, শিল্প, ক্যাপটিভ ও বাণিজ্যিক খাতে গ্যাসের মূল্য বাড়িয়েছে সরকার। এর আগে চলমান কৃষি সেচ মৌসুম, আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্মে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের বাড়তি চাহিদা মেটানো, শিল্প খাতে উৎপাদন নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য করণীয় নিয়ে অংশীজনের মতামত নেওয়া হয়েছে।
এবার গ্যাসের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে বিদ্যুৎ খাতে। সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১৭৯ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে গ্যাসের দাম।

সরকারি-বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রতি ইউনিট গ্যাসের বর্তমান দাম ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৪ টাকা করা হয়েছে। বিদ্যুৎ খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বর্তমান দামে কয়লা, জ্বালানি তেলসহ সব জ্বালানি পেলেও পিডিবির ঘাটতি হতে পারে ৪০ হাজার কোটি টাকা। সরকার ভর্তুকি বরাদ্দ রেখেছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। এখন গ্যাসের দাম বাড়ায় ঘাটতি আরও বেড়ে যাবে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৫০ শতাংশের বেশি আসে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। এতে বাড়তে পারে বিদ্যুতের দাম। যাদের শিল্পে ব্যবহৃত নিজস্ব বিদ্যুৎকেন্দ্র (ক্যাপটিভ) নেই, তারা আরও বাড়তি খরচের চাপে পড়বেন।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, মূল্যবৃদ্ধি নয়, দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমেই টেকসই সমাধান রয়েছে। এখন গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে বিদ্যুতের দাম বাড়তে পারে। এতে ভোক্তার ওপর আরও চাপ তৈরি হবে। দাম সমন্বয় মানে ভোক্তার ওপর বাড়তি দামের দায় চাপানো নয়। সরকারের নীতি সংশোধন না করে মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি অনৈতিক।
মূল্যবৃদ্ধি যৌক্তিক নয়
আগে বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে গ্যাসের দাম আলাদা ছিল। এবার সবার জন্য একই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এমনকি শিল্পে নিজস্ব বিদ্যুতের জন্যও একই করা হয়েছে গ্যাসের দাম। এতে এ চার শ্রেণির গ্রাহকের জন্য নতুন দাম করা হয়েছে ইউনিটপ্রতি ৩০ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প গ্রাহকদের। এরপর মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পের। হোটেল ও রেস্তোরাঁ খাতে ব্যবহৃত বাণিজ্যিক শ্রেণির গ্রাহকেরা ফেব্রুয়ারি থেকে গ্যাসের প্রতি ইউনিটে দাম দেবেন ৩০ টাকা ৫০ পয়সা। আগে তাঁরা দিচ্ছিলেন ২৬ টাকা ৬৪ পয়সা।

বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা ডলার সাশ্রয়ে খোলাবাজার থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আনা গত জুলাইয়ে বন্ধ করে দেয় সরকার। দেশেও গ্যাসের উৎপাদন কমে যায়। এতে সরবরাহ–সংকট দেখা দেয়। শিল্পমালিকেরা কারখানা চালু করতে বাড়তি দামে গ্যাস আমদানির দাবি জানান। সরকারের সঙ্গে একাধিক বৈঠকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাওয়ার ভিত্তিতে প্রতি ইউনিটে ২৫ টাকা পর্যন্ত দাম দিতে রাজি হন তাঁরা। শিল্পমালিকেরা বলেন, দাম বাড়িয়ে গ্যাস না দিলে শিল্প খাত ধ্বংস হয়ে যাবে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। গত আগস্টে জ্বালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধির (সাড়ে ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ) পর বাজারে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এখন বিদ্যুতের পর গ্যাসের দাম বাড়ায় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের খরচ বাড়বে।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, গ্যাসের দাম এক লাফে এতটা বাড়ানো ঠিক হয়নি। এতে শেষ বিচারে ভোক্তার ওপরই চাপ বাড়বে। তিনি আরও বলেন, ছোট, মাঝারি ও বড় শিল্পের জন্য গ্যাসের ইউনিটের দাম একই অর্থাৎ ৩০ টাকা করাটাও যৌক্তিক হয়নি। তাতে ছোট-মাঝারি শিল্প সংকটে পড়বে। এই জায়গায় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ দরকার হবে।
এ নিয়ে গত ১৪ বছরে ছয় দফায় গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। দেশে এখন দিনে গ্যাসের মোট চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহের সক্ষমতা আছে ৩৭৬ কোটি ঘনফুট। আর এখন গড়ে সরবরাহ করা হচ্ছে ২৬৬ কোটি ঘনফুট। দিনে ৩১০ কোটি ঘনফুট পর্যন্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে শিল্পে গ্যাস সরবরাহ মোটামুটি নিশ্চিত করা যায়। তবে দাম বাড়লেও সরকার এলএনজি আমদানি করে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় আছে ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে। তাঁরা বলছেন, দাম বাড়িয়ে সরকার হয়তো বাড়তি টাকা আদায় করতে পারবে। কিন্তু এলএনজি কিনতে তাদের ডলার লাগবে। দেশে ডলারের সংকট তো দূর হয়নি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি করে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনাকে আড়াল করা হচ্ছে। গ্যাসের দাম ২৩ শতাংশ বাড়িয়ে এলএনজি আমদানি কমিয়ে অর্ধেকে নামিয়েছে। তাহলে বাড়তি টাকা গেল কোথায়। তাই শুধু দামই বাড়বে। সামনে বিদ্যুতের দাম আবার বাড়বে। সংকট যেমন ছিল, তেমনি থাকবে। জ্বালানি নিরাপত্তা ইতিমধ্যেই বিপন্ন হয়েছে।
প্রথমআলো