Home সারাদেশ খেলার মাঠ রক্ষা করতে গিয়ে কারাগারে মা, নানির কোলে কাঁদছে ৩ বছরের...

খেলার মাঠ রক্ষা করতে গিয়ে কারাগারে মা, নানির কোলে কাঁদছে ৩ বছরের কন্যা

61

মাহবুবুল আলম, শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি: সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার কায়েমপুর ইউনিয়নের নিভৃত পল্লী বলদীপাড়া-হলদীঘর গ্রামের অযুফা খাতুন খেলার মাঠ রক্ষা করতে এখন কারাগারে। ৩ ছেলে ও ৩ বছর বয়সী এক কন্যা সন্তানের জননী অযুফা খাতুন কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই কান্না থামছে না মাত্র তিন বছর বয়সী শিশু কন্যা মরিয়মের। অযুফা খাতুনের ছেলে কান্না জড়িত কন্ঠে মোহন জানান, ” মা শুধু চেয়েছিলেন আমাদের চৌদ্দ পুরুষের স্মৃতিবিজড়িত খেলার মাঠ দখল করে যেন সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্প না করা হয়। তিনি হাজার হাজার গ্রামবাসির সাথে প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্প চাইনা। সেই চাওয়াই তার জন্য কাল হয়ে ওঠে। গত রোববার (২১ আগস্ট) প্রশাসনের উপস্থিতিতে সহিংসতার ঘটনায় করা মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর ছোট্টো মরিয়মের কান্না কিছুতেই থামছে না।
এই একই মামলায় স্থানীয় মুদি দোকানি আনছার আলীর স্ত্রী মালেকা খাতুন ৩ বছর বয়সী মেয়ে আফিয়াকে সাথে করেই গেছেন কারাগারে। আর পুলিশের ভয়ে আনছার আলী বাড়ি থেকে নিরুদ্দেশ। তাদের অনুপস্থিতিতে ফাঁকা বাড়ি খাখা করছে কেবল।
এছাড়াও এই মামলায় কারাগারে রয়েছেন দরিদ্র ভ্যানচালক আল মাহমুদের স্ত্রী ঝর্ণা খাতুন। দিনমজুর আব্দুল মজিদের স্ত্রী সেলিনা বেগম। সাত বছর বয়সী এক প্রতিবন্দী সন্তানের জননী হোসনে আরা, বৃদ্ধ জামাল প্রামানিকের অসুস্থ স্ত্রী আকলিমা, কৃষক আব্দুল আলীমের স্ত্রী শাফিয়া খাতুন।
গণহারে পুলিশের এই গ্রেফতার আতঙ্কে এখন নারী ও পুরুষ শূণ্য পুরো গ্রাম। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, হাজার হাজার মানুষের বসবাস এই গ্রামে হলেও গ্রেফতার আতঙ্কে বাড়িছাড়া সবাই। মানুষের হাসিখুশিতে ভরপুর কয়েকদিন আগের গ্রামটি এখন জনশূন্য হয়ে খাখা করছে। এই সুযোগে বেড়েছে চোরের উপদ্রপ। প্রতি রাতেই বিভিন্ন বাড়ি থেকে চুরি হয়ে যাচ্ছে গরুছাগল সহ মালামাল।

লুকিয়ে থাকা বলদিপাড়া গ্রামের আতিকুল ইসলাম, শুকুর মাহমুদ, আল মাহমুদ সহ একাধিক ব্যাক্তির সাথে কথা বলে জানা যায়, দুইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী বলদিপাড়া -হলদিঘর মাঠই শিশুদের একমাত্র ভরসা। এখানে ফুটবল অনুশীলন করে অনেকের জেলা ও জাতীয় পর্যায়ে পর্যন্ত খেলার সুযোগ হয়েছে। সেই মাঠেই আশ্রয়ণ প্রকল্প করতে চায় উপজেলা প্রশাসন। এ নিয়ে দীর্ঘদিন আন্দোলন করছেন এলাকাবাসী।

সব দাবি উপেক্ষা করে গত রোববার (২১ আগস্ট) প্রকল্পের মাটি ভরাট করতে গেলে বিক্ষোভ করেন স্থানীয়রা। এ সময় প্রশাসনের লোকজন স্থানীয়দের ওপর হামলা করলে পঞ্চম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীসহ আহত হন ছয়জন। পরে আত্মরক্ষায় গ্রামবাসীও ইট নিক্ষেপ করলে আহত হন সহকারী কমিশনার (ভূমি)।
এ ঘটনার পরেই উপজেলা ভূমি অফিসের প্রেসকার আব্দুল হাই পৌনে দুইশত জনকে আসামী করে শাহজাদপুর থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় বেআইনিভাবে সরকারি কাজে বাধা, গাড়ি ভাঙচুর, পরিদর্শনরত এসিল্যান্ড লিয়াকত সালমানকে হত্যার উদ্দেশে মারধরসহ ১০টি অভিযোগের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
পরে পুলিশ অভিযান চালিয়ে ৯ জন নারী এবং দুইজন পুরুষকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে প্রেরণ করেন। এ খবর এলাকায় ছড়িয়ে পড়তেই গ্রেপ্তার এড়াতে সটকে পড়েন গ্রামের অধিকাংশ নারী ও পুরুষরা।
এদিকে এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং শাহজাদপুর উপজেলার ১ নম্বর কায়েমপুর ইউনিয়নের বলদীপাড়া-হলদীঘর গ্রামের শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্প না করার অনুরোধ জানিয়ে ২১ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।
গত সোমবার (২২ আগস্ট) বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী ও সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের পক্ষ থেকে গ্রিন ভয়েসের সমন্বয়কারী আলমগীর কবীরের সই করা বিবৃতিতে এ অনুরোধ জানানো হয়।
বিবৃতি দেওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মানবাধিকার কর্মী ও বাপার সভাপতি সুলতানা কামাল ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

বিবৃতিতে তারা খেলার মাঠে আশ্রয়ণ প্রকল্প না করার অনুরোধের পাশাপাশি রোববার (২১ আগষ্ট) প্রশাসনের উপস্থিতিতে সহিংসতা, দুস্কৃতিকারীদের দ্বারা স্থানীয় জনগণের হয়রানি ও আহত হওয়ার ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও দোষীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নেওয়া, স্থানীয় এলাকাবাসীর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার ও গ্রেফতারকৃত নারীদের অবিলম্বে নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান।

বুধবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও শাহজাদপুর থানার ওসি (অপারেশন ও কমিউনিটি পুলিশিং) আব্দুল মজিদ জানান, “এখন পর্যন্ত ৯জন নারীসহ মোট ১১ জনকে আটক করা হয়েছে। নতুন করে আর কেউ আটক হয়নি।”