Home সারাদেশ কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৭ বছর উপলক্ষে বাঘাইছড়িতে বিক্ষোভ ও সাজেকে আলোচনা সভা

কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৭ বছর উপলক্ষে বাঘাইছড়িতে বিক্ষোভ ও সাজেকে আলোচনা সভা

23

চট্টগ্রাম অফিস: কল্পনা চাকমা অপহরণের ২৭ বছর উপলক্ষে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ এবং সাজেকে আলোচনা সভা করেছে পার্বত্য চট্টগ্রামে পূর্ণস্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনরত নারী সংগঠন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখা।

আজ সোমবার (১২ জুন ২০২৩) সকাল সাড়ে ১০টায় অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে বাঘাইছড়ি উপজেলার সদর এলাকায় এ বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

“যে জাতিতে বোন উদ্ধারে ভাইরা আত্মাহুতি দেয়, সেই জাতিকে দমিয়ে রাখা যাবে না” শ্লোগানে অনুষ্ঠিত সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের বাঘাইছড়ি উপজেলার সভাপতি অমিতা চাকমা।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সভাপতি অবনিকা চাকমার সঞ্চালনায় সমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে আরো বক্তব্য রাখেন হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ(পিসিপি)-এর রাঙামাটি জেলার সাধারণ সম্পাদক তনুময় চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সভাপতি ক্যামরন দেওয়ান ও হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য দয়াসোনা চাকমা।

হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি নীতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে জাতিগত নিপীড়নের অংশ হিসেবে পরিকল্পিতভাবে সংগ্রামী নারী কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছিল। ২৭ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলেও কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের গ্রেফতার, বিচার ও সাজা দেওয়া হয়নি। একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে এ যাবত পাহাড়ি নারীর ওপর ধর্ষণ, নিপীড়নের কোন ঘটনারই সুষ্ঠু বিচার হয়নি। অপরদিকে ৭ বছর পেরিয়ে গেলেও কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় সংঘটিত তনু হত্যার বিচারও আজো হয়নি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে ধর্ষক, নিপীড়ক, অপহরণকারীরা ক্ষমতাবান হওয়ায় অপহরণের মতো নিকৃষ্ট ঘটনার কোনো বিচার হচ্ছে না।

তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে মতলববাজিদের ভূমিকা তুলে ধরে বলেন, ১২ জুন এলে অনেকে নামে বেনামে ভুইফোঁড় সংগঠনের নাম দিয়ে লোকদেখানো নানা কমর্সূচি পালন করে থাকেন। অথচ তারা কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনাটিকে বিতর্কিত বলে মন্তব্য করেছিলেন। মূলত কল্পনা চাকমার অপহরণ ঘটনাকে পুঁজি করে এরা সংগ্রামী সেজে ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। তিনি এভাবে আন্দোলনে পানি না ঢেলে কল্পনা চাকমার সঠিক নীতি আদর্শের প্রতিবাদী ধারাকে তুলে ধরার আহ্বান জানান।

নীতি চাকমা পাহাড়ের সকল প্রকার অন্যায় দমন-পীড়ন বন্ধ করার ও কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে.ফেরদৌস গঙদের বিচার ও সাজা নিশ্চিত করতে ‘নতুন সংবিধান’ ও ‘জনগণের সরকার’ গঠনের দাবি জানান।

সমাবেশে প্রারম্ভিক বক্তব্যে হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য দয়াসোনা চাকমা বলেন, ১৯৯৬ সালের ১২ জুন সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ৭ ঘন্টা আগে মধ্যরাতে বাঘাইছড়ির কজইছড়ি ক্যাম্পে দায়িত্বরত সেনা কমাণ্ডার লে. ফেরদৌস গংরা সংগঠনের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক কল্পনা চাকমাকে অপহরণ করে। আজ ২৭ বছর পূর্ণ হলেও সরকার তার কোনো হদিস এখনও দিতে পারেনি। বরঞ্চ কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারীদের শাস্তি না দিয়ে এ ঘটনাটিকে প্রপাগান্ডা হিসেবে চালিয়ে দিয়ে অপহরণকারীদের রক্ষা করে চলেছে এবং কল্পনার ভাইদেরকেও নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

তিনি বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতার কথা তুলে ধরে বলেন, দীর্ঘ ২৭ বছরেও এ দেশের আদালত কল্পনা চাকমা অপহরণ ঘটনার বিচার করতে পারেনি। কল্পনা অপহরণ মামলায় ২৭ বছরে ৩৯ জন কর্মকর্তা বদলী হলেও কোনো তথ্য দিতে পারেনি। তিনি রাষ্ট্র ও প্রশাসনের গাফিলতি ও অনীহার কারণে বিচার হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন।

পিসিপি’র রাঙামাটি জেলা শাখার সভাপতি তনুময় চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে সরকার এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি জিইয়ে রেখেছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে ফৌজি শাসনের ফলে প্রতিনিয়ত নারী ধর্ষণ, ভূমি বেদখল, খুন, গুম, অপহরণ বিচার বহির্ভূত হত্যা চালানো হচ্ছে। বিভিন্ন ঠ্যাঙারে বাহিনী দিয়ে বান্দরবানে বম জনগোষ্ঠীকে সংখ্যালঘু থেকে আরো সংখ্যা লঘুতে পরিণত করার পাঁয়তারা চালানো হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী বিভিন্ন ভূইফোঁড় গ্রুপ সৃষ্টি করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।

তিনি আরো বলেন, কল্পনা চাকমার সন্ধান করতে গিয়ে স্কুল ছাত্র রুপন চাকমা আত্মবলিদান দিয়েছেন, সমর-সুকেশ-মনোতোষ গুমের শিকার হয়েছেন। তাদের এই অবদান আমরা কোনোদিন ভুলব না। যতই খুন, অপহরণ, দমন-পীড়ন চালানো হোক না কেন পাহাড়ি জনগণকে কিছুতেই দমিয়ে রাখা যাবে না বলে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন এবং সমাবেশে উপস্থিত সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন জোরদার করার আহ্বান জানান।

গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের খাগড়াছড়ি জেলার সভাপতি ক্যামরণ দেওয়ান বলেন, বাংলাদেশে ভিন্ন ভাষাভাষী জাগিতগত সংখ্যালঘুদের বিতাড়িত করার নানা চক্রান্ত চালানো হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়িদের বিলীন করে দেওয়ার জন্য ভূমি আগ্রাসন এবং নারীদের ওপর নিপীড়ন জারি রাখা হয়েছে। যার ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী ধর্ষণ ও ভূমি বেদখল এখন নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। গত ১ জুন খাগড়াছড়ির মাটিরাঙ্গা উপজেলার তবলছড়ি ইউনিয়নের লাইফু কার্বারি পাড়ায় সেটলার বাঙালিরা পাহাড়ি জুমচাষীদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার ঘটনা, এর আগে মাইসছড়ি ইউনিয়নে ৪টি পাহাড়ি ঘর ভাঙচুর ও গতবছরে একই ইউনিয়নে সেটলার কর্তৃক ৩৭টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও লুটপাটের ঘটনা এবং বান্দরবানে লামায় ম্রো-ত্রিপুরাদের ৪০০ একর জুম ভূমি বেদখল চেষ্টার ঘটনা তাই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

তিনি অবিলম্বে ভূমি বেদখল, নারী নির্যাতনসহ সকল ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

সমাবেশে সভাপতির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের বাঘাইছড়ি উপজেলা শাখার সভাপতি অমিতা চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী নির্যাতন-ধর্ষণ, ভূমি বেদখল, খুন, অপহরণ প্রতিনিয়ত চলছে। এসব অপকর্মকাণ্ডের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়োজিত সেনাবাহিনীই কোনো না কোনো জড়িত। আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন, দুর্নীতি ও দুঃশাসনে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীরা অতিষ্ঠ।

তিনি আর কালক্ষেপণ না করে অবিলম্বে কল্পনা চাকমার চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের আইনের আওতায় এনে বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা প্রদান এবং পাহাড়ে নারী নির্যাতন, খুন, গুম, অপহরণসহ সকল অন্যায় কার্যক্রম বন্ধ করার দাবি জানান।

সমাবেশের পরে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়।

কল্পনা অপহরণের ২৭ বছর উপলক্ষে বাঘাইছড়ি উপজেলা সাজেক ইউনিয়নের আলোচনা সভা করেছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘ। আজ সোমবার (১২ জুন ২০২৩) সকাল ১১টায় সাজেক এলাকায় এ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় পার্বত্য চট্টগ্রাম নারী সংঘের সাজেক ইউনিয়নের সভাপতি রূপসী চাকমার সভাপতি ও মানষী চাকমার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)-এর সাজেক ইউনিটের সংগঠক আর্জেন্ট চাকমা, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক সমর চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য জেসী চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাজেক ইউনিয়নের সভাপতি নিউটন চাকমা।

আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, পাহাড়ি নারী নেত্রী কল্পনা চাকমা পার্বত্য চট্টগ্রামের স্বায়ত্তশাসনের স্বপ্ন দেখেছিলেন। শাসকগোষ্ঠীর রক্ত, চক্ষু ও সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে বাঘাইছড়িসহ সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী সমাজকে সংঘঠিত করতে সহসী ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। ফলে রাষ্ট্রীয় বাহিনী পরিকল্পিতভাবে কল্পানা চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছে এবং সেনাবাহিনীর লে. ফেরদৌস, ভিডিপি কমাণ্ডার নুরুল হকের গংরা কল্পনা অপহরণ করেছে।

বক্তারা, কল্পনা অপহরণের ২৭ বছর পূর্ণ হলেও অপহরণের ঘটনায় সুষ্ঠু তদন্ত ও অভিযুক্ত চিহ্নিত অপহরণকারী লে. ফেরদৌস গংদের বিচার না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং কল্পনা চাকমা অপহরণের বিচারসহ পাহাড়-সমতলে সকল নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্য নারী সমাজের প্রতি আহ্বান জানান।