Home জাতীয় কয়লা নিয়ে বিপত্তি, আগামী ২ বছরে লাগবে ৫ বিলিয়ন ডলার

কয়লা নিয়ে বিপত্তি, আগামী ২ বছরে লাগবে ৫ বিলিয়ন ডলার

24

টাকার জোগান দেওয়াই বড় চ্যালেঞ্জ

ডেস্ক রিপোর্ট: চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আরো দীর্ঘায়িত হলে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারে চলমান অস্থিতিশীলতা প্রকট হয়ে ওঠার আশঙ্কা রয়েছে। এর বিপরীতে চলমান ডলার সংকট কাটিয়ে ওঠা না গেলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে বাংলাদেশ মারাত্মক বিপত্তির মুখোমুখি হতে পারে বলে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা আমদানি নিয়ে সাম্প্রতিক বিড়ম্বনাগুলো এরই ইঙ্গিত বহন করছে। কারণ নির্মাণাধীন ও উৎপাদনের অপেক্ষায় থাকা ৭ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য কয়লার প্রয়োজন পড়বে সাড়ে ২৫ মিলিয়ন টন। গড়ে টনপ্রতি ২০০ ডলার হিসাব করলেও আগামী দুই বছরে শুধু কয়লা আমদানিতেই প্রয়োজন পড়বে ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলারের বেশি। প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসেবে এর পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। এ টাকার যোগান কোথা থেকে আসবে তা নিয়েই চিন্তায় আছে জ্বালানি বিভাগ। খবর আমাদের সময়.কম

রামপাল তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের কয়লা নিয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে ছেড়ে আসা চীনা পতাকাবাহী জাহাজ এম. ভি জে হ্যায় শনিবার (১০ জুন) ভোরে মোংলা বন্দরের হাড়বাড়ীয়ায় ভিড়েছে। আবার পায়রা তাপ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ইন্দোনেশিয়া থেকে কয়লা নিয়ে একটি জাহাজ চলতি মাসের ২৫ তারিখে বন্দরে পৌঁছাবে বলে জানা গেছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শুধু পায়রায় চালু বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য কয়লা আমদানি করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। এর মধ্যে আবার নির্মাণাধীন ও উৎপাদনের অপেক্ষায় থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু হলে আগামী দুই বছরের মধ্যে দেশের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়াবে ৭ হাজার মেগাওয়াটে। ১ হাজার মেগাওয়াট একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য দৈনিক কয়লার প্রয়োজন পড়ে ১০ টন। সংশ্লিষ্টদের তথ্যানুযায়ী, সারা বছর এ সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখতে কয়লার প্রয়োজন পড়বে সাড়ে ২৫ মিলিয়ন টন। গড় মূল্য টনপ্রতি ২০০ ডলার হিসাব করলেও আগামী দুই বছরে চালু হতে যাওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য শুধু কয়লা আমদানি করতেই প্রয়োজন পড়বে ৫ বিলিয়ন (৫০০ কোটি) ডলারের বেশি। আর প্রতি ডলার ১০৭ টাকা হিসেবে এর পরিমাণ দাঁড়াবে সাড়ে ৫৩ হাজার কোটি টাকারও বেশি। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন নিয়ে দেশের জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণেও এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এদিকে সম্প্রতি ‘ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ’ (এফইআরবি) আয়োজিত ‘এনার্জি ট্রানজিশন: গ্লোবাল কনটেক্সট অ্যান্ড বাংলাদেশ’ শীর্ষক সাম্প্রতিক সেমিনারে উপস্থাপিত এক প্রবন্ধেও ঠিক একই পূর্বাভাস দিয়ে বলা হয়, আগামী দুই বছরে দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহার্য কয়লা আমদানিতে বার্ষিক ব্যয় দাঁড়াতে যাচ্ছে অন্তত ৫ বিলিয়ন ডলারে।

বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের তথ্যানুযায়ী, উৎপাদন শুরুর অপেক্ষায় থাকা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে দু-একটিতে এরই মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে। বাকিগুলোও আগামী দুই বছরের মধ্যেই উৎপাদনে আসবে। কক্সবাজারের মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে ১২০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি (জাইকা) সহায়তায় এ প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। গত বছরের নভেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৬৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিপিজিসিবিএল) তথ্যানুযায়ী, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট এবং জুলাইয়ে দ্বিতীয় ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত রয়েছে। এরই মধ্যে এ প্রকল্পের জন্য মাতারবাড়ী-মদুনাঘাট সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত করেছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি)।

বাগেরহাটের রামপালে মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্ট উৎপাদনে আসলেও এর আগে কয়লা সংকটে দু’দফায় কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে অর্ধেক উৎপাদন হচ্ছে কেন্দ্রটি থেকে।

পটুয়াখালীর পায়রায় ১৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন চালু হলেও গত ৫ জুন কয়লা সংকটে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এখানে একই সক্ষমতার আরো দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। এর মধ্যে একটি নির্মাণ করছে বিসিপিসিএল। আরেকটি করছে রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) ও চীনা প্রতিষ্ঠান নরিনকো।

বেসরকারি একটি কোম্পানি চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে নির্মাণ করছে ১২২৪ মেগাওয়াট সক্ষমতার একটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। ৯ জুন কয়লার অভাবে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া বরিশালে ৩০৭ মেগাওয়াট ও ঢাকায় ৬৩৫ মেগাওয়াট সক্ষমতার আরো দুটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে। এর সবক’টিই আগামী দুই বছরের মধ্যে উৎপাদনে আসতে পারে। এ প্রসঙ্গে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. শামসুল আলম বলেন, ডলার ও রিজার্ভ সংকটের কারণে গ্যাস ও কয়লা আমদানিতে এখন জটিলতা তৈরি হয়েছে। আগামীতে কয়লাভিত্তিক এসব বিদ্যুৎ প্রকল্প উৎপাদনে গেলে জ্বালানি আমদানি অনিশ্চয়তায় পড়বে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম জানান, বর্তমান বাজারমূল্য হিসাব করলে এলএনজি আমদানির চেয়ে কয়লা আমদানি ব্যয় তুলনামূলক কম। তবে তার চেয়েও বড় চ্যালেঞ্জ কয়লা আমদানির জোগান নিশ্চিত করা।

এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, জ্বালানির যোগান দিতে না পারায় অর্থাৎ কয়লা, গ্যাস এবং তেলের সংকটের কারণে বিদ্যুতের লোডশেডিং হচ্ছে। তবে আগামী ২ সপ্তাহের মধ্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, জ্বালানি আসার পেছনে সবসময় আমাদের হাত থাকে না। কোথাও বাধাগ্রস্ত হলেই সমস্যা হয়। এবারও তাই হয়েছে। পায়রার জন্য কয়লা কত দ্রুত আনা যায়, সেই চেষ্টা করছি। আশা করি দশ-পনের দিনের মধ্যে এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারব। তবে আগামীতে যে কয়লা আমদানিতে বিপুল পরিমাণ অর্থ লাগবে তার যোগান কোথা থেকে আসবে সেটিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।