Home মতামত একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারিঃ ৮

একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারিঃ ৮

35

সাইফুল ইসলাম শিশির: সকালে জেহালা বাজার থেকে টুকিটাকি কিছু কেনাকাটা করলাম। মানিক আসলে আজ নিরুদ্দেশে রওনা হবো। যেখানে কেউ আমাকে খুঁজে পাবেনা। সুঁই-সুতা, ব্লেড-কাঁচি, কাগজ- কলম, সাবান- শ্যাম্পু, পেস্ট- ব্রাশ, গামছা, গেঞ্জি- লুঙ্গি ইত্যাদি সঙ্গে নিলাম।

বাবা-মাকে আজ সকালে ছোট্ট একটি চিঠি লিখেছি। “আমি ভালো আছি। কোন চিন্তা করবেন না। বাড়িতে পুলিশ যেতে পারে। বরাবরের মতোই মুড়িমুড়কি, পেঁপে- কলা, খাইয়ে বিদায় দেবেন। জিজ্ঞেস করলে বলবেন – অনেক দিন থেকে কোন যোগাযোগ নেই। কোথায় আছে জানিনা।” এচিঠি পেয়ে বাবা হয়তো আবারও ২ সের জিলাপি কিনে মসজিদে মিলাদ দিবে। সকলের কাছে দোয়া চাইবে।
চিঠির উপর সীলছাপ্পড় দেখে টিকটিকিরা নাকি অনুসরণ করে, পাত্তা লাগায়। সে সুযোগ যেন না পায়, সে ব্যাপারে সজাগ আছি। ফারুক আজিজ খান চিঠিখানা ফিরতি পথে ইশ্বরদী ডাকবাক্সে ফেলে দেবে। তাকে এব্যাপারে সাবধান করে দেয়া আছে।

‘দুয়ারে প্রস্তুত গাড়ি, বেলা দ্বিপ্রহর,
হেমন্তের রৌদ্র ক্রমে হতেছে প্রখর।’

মানিকের সাথে নিরুদ্দেশ যাত্রার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। অদূরে কাকভেজা চোখে দাঁড়িয়ে আছে আসু। “আঁসু বান গ্যায়ে মতি”। কি দারুণ সাযুজ্য। কাছে না যেতেই বাঁধভাঙ্গা জল যেন দুকূল ছাপিয়ে উছলে উঠিল। “ছিছির ভাই! আপনাকে দেখে মনে বল ফিরে এসেছিল। আপনিও চলে যাচ্ছেন গো।”

সূর্য মাথায় নিয়ে নদীর পাড় ধরে হেঁটে চলেছি। মাথাভাঙ্গা নদী বাংলাদেশ- ভারতের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি আন্ত- সীমান্ত নদী। মুর্শিদাবাদ জেলার জলাঙ্গির ১৬ কিঃমিঃ পূর্ব- দক্ষিণে পদ্মা থেকে উৎসারিত, কুষ্টিয়া- মেহেরপুর হয়ে চুয়াডাঙ্গার দামুড়হুদা উপজেলার ইছামতী- কালিন্দির মোহনায় এসে মিশেছে। ১২১ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীপথ। সাধারণত বর্ষাকালে এ নদীর দুকূল প্লাবিত হয়না এবং জোয়ার ভাটার কোন প্রভাব নেই।

এখন শুষ্ক মৌসুম। পানির লেভেল থেকে পাড় অনেক উঁচু মনে হচ্ছে। ব্রিটিশ- ভারতে মাথাভাঙ্গা নদী দিয়ে বড় বড় স্টিমার চলতো। ইংরেজ সাহেবেরা নদীপথে এদিকে আসত। আলমডাঙ্গায় তারা নীলকুঠি স্থাপন করে। নীলকরদের সুবিধার কথা বিবেচনা করে, ১৮৬২ সালে এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে উঁচু এবং দ্বিতল ভবন বিশিষ্ট রেলস্টেশন স্থাপিত হয়। ‘সে রামও নেই সেই অযোধ্যাও নেই।’ দু’একটা বিরল প্রজাতির পামট্রি এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মাঝে মাঝে চোখে পড়ে নদীতে জাল দিয়ে জেলেরা মাছ ধরছে। বকপাতিগুলো পানির উপর দিয়ে এলোপাতাড়ি উড়েবেড়াচ্ছে। বাঁশের উপর টালমেরে বসে আছে মাছরাঙা পাখি। মাঝে মাঝে আকাশে ডানা ঝাপটায়- মাছ শিকার করে। গাঁয়ের বধূরা বৈকালিক গোসল সেরে লাইন ধরে বাড়ি ফিরছে। ছোট বেলায় দেখা দইভাঙ্গা নদীর দৃশ্য মনে পড়ছে। নস্টালজিক!

নদীর পাড় ঘেঁষে উঁচানিচা পথ। উঠতে গিয়ে মনে হচ্ছে যেন গিরিখাত তোরাবোরা পাহাড় ডিঙ্গায়ে যাচ্ছি। ক্লান্ত শরীর, ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসছে। পা যেন আর কিছুতেই চলছে না। তবুও যেতে হবে– “ক্লান্তি আমার ক্ষমা কর প্রভূ পথে যদি রই পিছিয়ে — ।”

যাযাবরের মতো পথ চলেছি। কোথাও ঠাঁই নেই- নেই কোন ঠিকানা। হাট বোয়ালিয়া হয়ে বাচামারা বামে ফেলে সালদা বিলের দিকে হাঁটছি। চুয়াডাঙ্গা জেলার শেষ সীমানা, মেহেরপুরের শুরু। দেয়ালে ইউপি নির্বাচনের দুএকটি পোস্টার ঝুলছে। ফজলুর রহমান- চাষি ফজলু নামে একজন চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী। হঠাৎ ব্রেনের ভিতর ক্লিক করলো। ফজলুর রহমান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে উদ্ভিদবিদ্যার ছাত্র। জোহা হলের পূর্বপাশে পতিত জমি আবাদ করে ফজলুর রহমান সেসময় হৈ চৈ ফেলে দেয়। সে চাষি ফজলু নামে দারুণ খ্যাতি পায়। জানতাম তার বাড়ি কুষ্টিয়া জেলায়। এই সেই ফজলুর রহমানের গ্রাম, বাচামারা।

সূর্য তখন ডুবুডুবু করছে। ২২ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে চাঁদপুর গ্রামে আব্দুর রহমান কালু “চেয়ারম্যানবাড়ি” এসে পৌঁছলাম। বিশাল চারচালা বৈঠকখানার এক রুমে আমার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আবু মিয়া ভিতর বাড়ি থেকে একটি লন্ঠন বাতি নিয়ে এলো। মৃদু আলোতে চিমনির উপর দুএকটা ‘আগুনেপোকা’ উড়ে এসে পড়ছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই নেমে আসে ভুতুড়ে অন্ধকার। তখন চান্দ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষ। জোনাকির জ্বলানেভা– মিটিমিটি করে শুধু জ্বলছে। রাত নিঝুম চারিদিকে। নির্ঘুম রাত- ভাবছি কখন সূর্য উঠবে?

চলবে —


৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ সাল
লেক সার্কাস উত্তর ধানমণ্ডি
ঢাকা