Home মতামত একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারিঃ ৬

একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারিঃ ৬

56

সাইফুল ইসলাম শিশিরঃ উত্তর জনপদের সবচেয়ে ব্যস্ততম রেলওয়ে জংশন ঈশ্বরদী। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এখানে উঠানামা করে। বাংলা, উর্দু মিশেল ভাষা- লাউড স্পিকারের সেই গমগমে আওয়াজ কানে বাজে।
“ঢাকাগামী সুন্দরবন এক্সপ্রেস ট্রেনখানি ২ং প্লাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে। যেসকল যাত্রীগণ মুলাডুলি, চাটমোহর, বড়ালব্রিজ, উল্লাপাড়া, সিরাজগঞ্জ ঘাট হয়ে ঢাকা যাবেন, তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি”—

ইতোপূর্বে কতবার ঈশ্বরদী এসেছি, তার কোন ইয়ত্তা নেই। ছোট বেলার অনেক স্মৃতি চোখে ভাসে। দোকানী পিরিচে স্লাইস করা গোল কেকের ওপর সামান্য গরম দুধ ঢেলে চামচসহ হাতে ধরিয়ে দিতো, সাদা ধোঁয়া উড়তো। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খেতাম। কী যে স্বাদ! মনে হয় এখনো জিহ্বায় লেগে আছে।

ফারুক একটা বেঞ্চের উপর আমাকে বসিয়ে রেখে সামনে গেছে। দূর থেকে প্রক্ষালন কক্ষ দেখা যাচ্ছে। কালোর উপরে সাদা কালিতে আঁকা ঘটি হাতে পুরুষ- মহিলার ছবি। ব্রিটিশ চলে গেছে, পাকিরাও– কিন্তু “জেনানা- মর্দানা” লেখা সেই সাইনবোর্ড খানি এখনো অনাদরে দাঁড়িয়ে আছে। অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে।

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়।

টোপর পরা বরযাত্রীর ছোট একটি দল সামনের দিকে এগিয়ে আসছে। আমিও আগ্রহ ভরে তাকিয়ে দেখছি। হঠাৎ বরযাত্রীরা আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল। বর আমার দিকে চেয়ে হাসছে। শরীফ, আমার স্কুল- জীবনের বন্ধু। বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে দু’তিন বছর পরে । জুনিয়রদের সাথে মিশে সেও আমার জুনিয়র ফ্রেন্ড হয়ে যায়। আমাকে আস্তে করে বলে “ছিছির! কেমন আছো গো? ছব শুনেছি। সাবধানে থেক দোস্ত।” একই ট্রেনে ওরা ভেড়ামারা যাচ্ছে।

ফারুক কিভাবে কী ম্যানেজ করল জানিনা। আমরা গার্ড সাহেবের বগিতে গিয়ে উঠলাম। খাতিরই আলাদা। পরে বুঝেছি “টাকায় করে কাম মিছাই মরদের নাম।”

মাথার ভিতর পরিকল্পনা ছিল ঝিনাইদহ / যশোর যাবো। কিন্তু প্রাথমিক আলোচনা না করে হঠাৎ করে কোথাও যাওয়া ঠিক হবেনা। এই মুহূর্তে একটা ল্যান্ডিং স্পেস দরকার। যেখানে একটু দম নিয়ে আবার সামনে আগানো যায়। পুলসিরাত পার হবার মতো। একটু এদিক ওদিক হলেই সমূহ বিপদ। কাউকে বিশ্বাস করতেও এখন ভয় লাগে। অথচ সারা জীবন মেনে এসেছি – আস্থা রেখেছি “মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ।”

দুএকজন পরামর্শ দিয়েছেন “ভাজবে করল্লা, বলবে ঝিংগা।” দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম চুয়াডাঙ্গা নেমে পড়বো। ফারুক কে ইশারা দিলাম। গার্ড চাচাকে সালাম দিয়ে বিদায় নিলাম। মাত্র পরিচয় অথচ মনে হচ্ছে কত চেনা, কত আপনজন। এক নিমিষেই ট্রেন ছেড়ে চলে গেল।

ছোট্ট স্টেশন চুয়াডাঙ্গা। সবেমাত্র আড়মোড়া ভেঙে উঠছে। চা স্টল- বুক স্টল তখনও খোলেনি। চুলার পাশে একটি বেওয়ারিশ কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে কিছু কয়লা পড়ে আছে। ঝাড়ু- বালতি হাতে দু’জন পরিচ্ছন্নতা কর্মী প্লাটফর্মে ঢুকছে। খটমট ভাষায় কীযেন বলছে। ঝগড়া না অন্যকিছু তা বোঝার উপায় নেই। দ্রুত পা ফেলে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম।

ডাঃ রফিকুল ইসলাম বাবলু। চুয়াডাঙ্গা হেলথ কমপ্লেক্স এর ইনচার্য। ডাক্তার বাবলু, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ, বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি ছিলেন। আমাকে দেখে সে অবাক। এতো ভোরে কিভাবে হাজির হলাম! হাত মুখ ধুয়ে নাস্তা করলাম। ডাঃ বাবলু আমার বিষয়টি জানে কিনা! তখনও আমি নিশ্চিত না। তিনি নিজে থেকেই বললেন, আমার এখানে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্ররা আসে। আপনি সবার কাছে খুবই পরিচিত। জানাজানি হলে সমস্যা হবে। তার চেয়ে আমার গ্রামের বাড়ি জেহালা- মুন্সিগঞ্জ চলে যান। এখান থেকে ১২ কিলোমিটার পথ। রিকশায় যেতে ঘণ্টা দেড়েক লাগবে। ওখানে থাকবেন, কোন সমস্যা হবে না।

আখ খেতের পাশ দিয়ে সিংগেল রোড এঁকেবেঁকে চলে গেছে। সারাদেশে তখন ইউপি নির্বাচনের ডামাডোল চলছে। তার হাওয়া এসে লাগছে এই পাড়াগাঁয়। দেয়ালে /বেড়ায় পোস্টার ঝুলছে। দোকানের সামনে জটলা- ভীড় করে মানুষ বিড়ি ফুঁকছে- চা খাচ্ছে। ভোট রঙে মেতে আছে সবাই। রিকশা থামিয়ে আমি আর ফারুক ভোটের চা খেলাম। কুশরের গুড় দিয়ে তেজপাতার চা। দারুণ মজা। পয়সা দিতে গেলে দোকানী বলে “লাগলে আরও এক কাপ খান, পয়সা লাগবে না”। আরও কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। মিশে গেলাম মানুষের ভীড়ে। ভুলেই গিয়েছিলাম আমি একজন দণ্ডপ্রাপ্ত ফেরারি। যখন সম্বিত ফিরে এলো কুয়াশার চাদর ছেড়ে সূর্য তখন মধ্য গগনে।

চলবে —–


২৮ আগস্ট ২০২১ সাল
লেক সার্কাস, উত্তর ধানমন্ডি
ঢাকা