Home মতামত উল্টা পাল্টা সিক্স এন্ড নাইন!!

উল্টা পাল্টা সিক্স এন্ড নাইন!!

35

সরদার মোঃ শাহীন:

শোনিমের ছোটবেলার কথা। আমার খুবই স্নেহভাজন একজনের বউভাত অনুষ্ঠানের দাওয়াতে গেলাম। এদিকে প্রচন্ড গরমে প্রাণটা যায় যায় অবস্থা দেশের সব মানুষের। বাতাসের সাথে আগুনের ফুলকা এসে গায়ে লাগছে। ঢাকা শহরকে মনে হচ্ছে আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি। এই গরমে কেউ বিয়ের অনুষ্ঠান ফেলে? আবার নাম দিয়েছে বউভাত। আমার শোনিমের কৌতুহলী প্রশ্ন, তাহলে জামাইভাত অনুষ্ঠান কোনটি?
পাত্র নিজেই নিজের গার্ডিয়ান; বাবাকে হারিয়েছে ছোট বয়সেই। ছেলেবেলায় এতিম হবার কষ্ট অনুভব করেছিল একবার; বড় হবার পরে বিয়ের আয়োজন করতে যেয়ে নিজেকে আবার এতিম মনে হল তার। সবকিছু নিজেকে একা সামাল দিতে হচ্ছে। কে না কার বুদ্ধিতে নিমন্ত্রণ পত্র ছাপিয়েছে ইংরেজিতে। আজকাল অবশ্য এটা একটা ফ্যাশন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সামাজিকভাবে একটু বাড়তি মূল্য পাবার আশায় বাংলা বাদ দিয়ে ইংরেজিতে কার্ড ছাপানো হচ্ছে অহরহ।
তথাকথিত এলিটদের ফলো করতে যেয়ে মধ্যবিত্তের সুন্দর মনের মানুষদের মনটা আস্তে আস্তে অসুন্দর হয়ে যাচ্ছে। কবে যে কোন্ পক্ষ এটাকে অমুসলিমদের কালচার বলে বসবে না তাই বা কে জানে! এইরূপ রেশারেশীতে বাংলাদেশে আরবী আর সংস্কৃত ভাষায় নিমন্ত্রণ পত্রের কালচার আবার চালু না হয়। দাওয়াত পত্র বিলি করাটা আরো ঝামেলার ব্যাপার। শুধু ফোন করে দাওয়াত দিলে চলবে না; কার্ড পাঠাতে হবে। আবার যাকে তাকে দিয়ে কার্ড পাঠালে হবে না; দাওয়াতী বুঝে দাওয়াত পৌঁছাতে হবে।
যানজটের এই শহরে এভাবে দ্বারে দ্বারে ঘুরে ঘুরে দাওয়াত দিতে হবে। এখানে খুবই দুঃখজনক বিষয়টি হলো পাত্রকে সমাজ রক্ষার জন্যে সবাইকে নিয়ম মেনে সম্মান দিয়ে দাওয়াত করতে হবে; অনুষ্ঠানের দিন সবার জন্যে সকল কিছু রান্না করে বসে থাকতে হবে। কিন্তু যাদেরকে এই সম্মান দেয়া হলো তারা নিশ্চিত করবেন না যে আদৌ তারা দাওয়াতে আসবে কিনা! সামাজিকতার এই যে একপাক্ষিক অবিচার কিংবা একচোখা নীতি এটা দেখার কেউ নেই!
খাবার টেবিলে বসে একটি অদ্ভুত আচরণ লক্ষ্য করলাম। একেকটি টেবিলে ১৬ জন বসে ছিলাম আমরা। বেশভুষা এবং পোশাকে মনে হচ্ছিল প্রায় প্রতিটি টেবিলে মধ্য ও উচ্চবিত্তের সহঅবস্থান। অদ্ভুত কালচারটির চর্চা নির্লজ্জের মত লাগছিল এই তথাকথিত উচ্চবিত্তদের নিয়ে। সবাইকে একটি করে রোস্ট দিলেও বেয়ারার দল বাড়তি রোস্ট এনে দিল শুধু উচ্চবিত্তদের প্লেটে।
শুধু কি তাই? বাড়তি গোশত, মিনারেল বোতল, হাত ধোবার সাবান-পানি টেবিলে দেয়া সহ টিস্যু পেপারও হাতে ধরিয়ে দিল। পাশে বসা অন্যরা এসব না পেয়ে হীনমন্যতায় ভুগছিলেন। অসামাজিকতা দিয়ে অসুন্দর করা হলো একটি সুন্দর সামাজিক অনুষ্ঠানকে। দাওয়াত করে ডেকে এনে এভাবে সমাজের সামনে মধ্যবিত্তকে শ্রেণি বৈষম্যের মধ্যে ফেলে অপমান করার অধিকার কে দিয়েছে খুব জানতে ইচ্ছে করছিল আমার।
অদ্ভুত একটি বিষয় যে কোন বিয়ে বাড়ির গেট পেরোলেই চোখে পড়ে। পানের ডালা সাজিয়ে রাখা হয় একটি কাউন্টার। সবাই এসে ঢোকার মুখেই সাথে করে আনা গিফট সামগ্রী এখানে জমা দিয়ে নামটি লিখিয়ে নেয়। আমার ছেলেবেলায় দেখেছি এই গিফট কালচার প্রক্রিয়াটি নিয়ে আমার আব্বা কী রকম ঝামেলায় পড়তেন।
বিয়ের একটি কার্ড হাতে পাবার পরে সমস্ত দাওয়াতীদের মধ্যে তিনটে দলের সৃষ্টি হয়। একটি দল গিফট ম্যানেজ করতে পারবে না বলে অনুষ্ঠানেই আসে না। (ছেলেবেলায় এমন অনেক বিয়েতে আমাদের যাওয়া হয়নি।) ২য় দলটি সাংঘাতিক হিসেব মেলাতে শুরু করে কিভাবে এই যাত্রা কোন ভাবে সামাল দিয়ে তথাকথিত সমাজ রক্ষা করবে। তবে এ দলটির একটি অনুষ্ঠানে হাজির হবার কারণে মাসের শেষ দশ দিনের বাজারের লিস্ট কাটছাট করতে হয়। আর ৩য় দলের কোন সমস্যাই থাকে না। বরং প্রতিযোগিতা করে গিফট আনে।
বিয়ে যাদের, তাদের জন্যে বিয়েটা খুবই আনন্দের। আনন্দটি অনেক কারণেই। পাত্র-পাত্রী সারা জীবনের জন্যে একে অন্যকে পাবে; এটা পাবার আনন্দ। দেখতে অনেক সুন্দর পোশাক পড়বে, গহনা পড়বে; এটা পড়ার আনন্দ। হানিমুনে যাবে, এ বাড়ি সে বাড়ি বেড়াবে; এসব বেড়াবার আনন্দ।
আর জামাই বাবুর জন্যে শ্বশুর বাড়ির বিশেষ সমাদর তো আছেই। তাদের এই আনন্দে শরীক হতে যেয়ে কিছু দাওয়াতীকে কেন গলদঘর্ম হতে হবে বা মাসের শেষ দিনগুলো হিসেব করে সংসার চালাতে হবে তা আমার বুঝে আসে না! বিয়ের আনন্দ তাদের দুজনার আর কষ্ট করবে পাড়াশুদ্ধ মানুষ; এটা কেন হবে?
ঠিক ভিন্ন দৃষ্টিটি চোখে পড়ে কোন বাড়িতে কেউ মারা গেলে। যে মারা যায় সে তো যায়ই। যদি রোগে ভোগে মারা যায় তাহলে পুরো পরিবারকে শেষ করে দিয়ে যায়। প্রথমত চিকিৎসায় অনেক টাকা পয়সা যায়, দীর্ঘদিন হাসপাতালে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে তাদের জীবন যায় যায়। শেষমেষ একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটাও চির বিদায় নিয়ে চলে যায়। থাকে শুধু প্রিয়জন হারাবার বেদনা, প্রিয়মুখ বিদায়ের শোক আর অনেক অনেক দেনার বোঝা।
এটা হলো প্রথম কষ্টের চাপ। দাফন শেষে শুরু হয় সামাজিক ঠেলা সামলানোর নতুন চাপ। এতদিন যে সমাজ চিকিৎসার সময় পাশে এসে দাঁড়ায়নি, সেই সমাজের সামাজিকতার নামে চল্লিশা আর কুলখানি করার পরামর্শ আসে। গ্রামশুদ্ধ মানুষ খাওয়ানোর প্রস্তাবও আসে। একটিবারও এই প্রশ্নটি আসে না, এই শোকাতুর মানুষগুলো ঠিকভাবে খেয়ে পড়ে বেঁচে আছে কি না; সামনের দিনগুলো বেঁচে থাকতে পারবে কিনা?
খুব দরকার ছিল এদের জন্যে অনুষ্ঠানের দিন গিফট আনার। কে ভাববে এসব! সবাই আসে, কিন্তু কেউ ভাবে না। কেউ গিফট আনে না! যেহেতু গিফট আনার ঝামেলা নেই, তাই কেউ দাওয়াতী অনুষ্ঠান মিস করে না। দলবেঁধে এসে সবাই মোনাজাত ধরে। মোনাজাতস্থল মৌ মৌ করে পাশ থেকে বাতাসে ভেসে আসা খাবারের বাহারী ঘ্রাণে! মৃত লোকটির কর্পূরের গন্ধ হারিয়ে যায় গোশত পোলাওয়ের বাঁসে! বিদায় বেলায় ভাল হয়েছে, খাবার উত্তম হয়েছে বলে বলে সবাই চলে যায়।
কিন্ত দলবেঁধে কেউ আর গোরস্থানে যায় না। ওখানে যাবার কাজ কেবল গুটি কয়েক অতীব নিকটজনদের। তারা গোরস্থানে যায়; খুব কষ্টের মন নিয়ে তারা যায়! ভেজা চোখে আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহ্লাল কুবুর বলে কবরবাসীকে সালাম জানায়। কিন্তু কবরবাসীর সালামের জবাব তাদের কানে পৌঁছায় না! তাদের কানে তখন কেবলই বাজে পাওনাদারদের কলিজা কাঁপানো ডাক!! আমরা একটি বারও ভাবিনা বাংলাদেশের এই জাতীয় সামাজিক কালচারে আছে কত বড় রকমের ফাঁক!!!

-লেখক: সম্পাদক, সিমেকনিউজ২৪ ডটকম।