Home মতামত আশা করি ব্র্যাক এখনও জামাত-বিএনপি হয়নি

আশা করি ব্র্যাক এখনও জামাত-বিএনপি হয়নি

326

জিয়াউল হক মুক্তা:

অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান আজ ৩১ অক্টোবর দৈনিক সমকালে লিখেছেন ‘নির্বাচন কীভাবে নিরপেক্ষ বা অনিরপেক্ষ হয়’। রচনাটিতে তিনি ‘গায়েবী মামলা’, ‘রাজপথের সংঘাতময় অবস্থা’,‘নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নজরদারি’ ও ‘ভোট গণনা ও ফল প্রকাশ’ — এই চারটি বিষয়কে নির্বাচনের নিরপেক্ষতার বা অনিরপেক্ষতার নির্ধারক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।

ড. জিল্লুরের বক্তব্য থেকে মনে হয় না অ্যাকাডেমিক্যালি তিনি একজন অর্থনীতিবিদ এবং মনে হয় না তিনি ব্র্যাকের মতো একটি দলনিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। এটা সত্য দশক দশক ধরে তিনি বিএনপির অনানুষ্ঠানিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেছেন, তারপরও তিনি যখন ব্র্যাকের চেয়ারম্যানশিপ পেলেন তার উচিত ছিল নিজের একটি দলনিরপেক্ষ ভাবমূর্তি গড়ে তোলা। নিজের কলুষিত রাজনৈতিক অবস্থান দিয়ে তিনি ব্র্যাকের মতো একটি প্রতিষ্ঠানকে বিপদে ফেলতে পারেন না। আমরা জানি প্রশিকার মতো একটি প্রতিষ্ঠানের কর্নধারের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ওই প্রতিষ্ঠানটির কী হাল হয়েছে। ব্র্যাকের পরিচয় ব্যবহার করে ড, হোসেন জিল্লুরের রাজনৈতিক মত প্রকাশব্র্যাককেও ধ্বংস করবে না এই নিশ্চয়তা তিনি কীভাবে পান?

মনে রাখা দরকার বিএনপির সাথে কয়েক দশক ধরে অতিঘনিষ্ঠ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান হচ্ছেন এমন একজন অর্থনীতিবিদ, যিনি আন্তর্জাতিক লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানের হয়ে বাংলাদেশের জন্য তথাকথিত ‘দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র’ বা পিআরএসপি প্রণয়ন করেছিলেন। পিআরএসপি ছিল বাংলাদেশের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রক্রিয়া বাতিল করে আন্তর্জাতিক লগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পরামর্শ ও নির্দেশনাক্রমে তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য বিএনপি-গৃহীত প্রধান জাতীয় পরিকল্পনা দলিল; অবশ্য বলে রাখা ভালো বিএনপি পিআরএসপি’র পক্ষে অবস্থান নিলেও বিএনপির মন্ত্রী ড. মঈন খান এই দলিল জনসমক্ষে ঢিল দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছিলেন। পরে ২০১০ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উন্নয়ন অংশীদারদের সভা ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ফোরাম-বিডিএফ’সভায় নিজস্ব জাতীয় পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পক্ষে তাঁর দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেন। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের সরকার দেশের পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রক্রিয়া পুনরায় চালু করেবাংলাদেশের অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করে।

ড. জিল্লুর তার রচনায় জামাত-বিএনপি’র শব্দ ‘গায়েবি মামলা’র ফলে সৃষ্ট ‘রাজনৈতিক শরণার্থী’দেরনিয়ে পরিশ্রমী সমাজবিজ্ঞানীদের গবেষণা-নির্দেশনা দিয়েছেনএবং বলেছেন যে ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামী নামে নতুন কৌশল আবিষ্কার করা হয়েছে। বোঝা যায়, তিনি জামাত-বিএনপি পরিচালিত দেশব্যাপী পরিচালিত আগুন-সন্ত্রাস ও অপরাপর অপকর্ম লুকিয়ে ফেলতে চাইছেন। একজন গবেষক হিসেবে তিনি পরিষ্কার জানেন যে আইনকানুনের সূচনাকাল থেকে ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামীর বিধান রয়েছে, বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ ফৌজদারি মামলায় তা যুগ যুগ ধরে উল্লেখ হয়ে আসছে; তারপরও তিনি জঙ্গি-জামাত ও জঙ্গিসঙ্গি-বিএনপির জোশ থেকে নির্দ্বিধায় বলে দিলেন যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামী নামে নতৃন কৌশল আবিষ্কার করেছে। তার মতো একজন ব্যক্তির পরিমিতিবোধ হারিয়ে ফেলা ভালো লক্ষণ নয়! চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে স্মার্ট টেকনোলোজি ব্যবহার করে কথিত ‘অজ্ঞাতনামা’ আসামিদের কি চিহ্নিত করা যাচ্ছে না? গণমাধ্যমের লিখিত সংবাদের চেয়েও কি ভিডিও ফুটেজ, অনলাইন সূত্র ও ফোন ট্র্যাকিং-সূত্রের প্রমাণ নির্ভরযোগ্য নয়? এসব প্রযুক্তি কি বড় বড় অপরাধীদের চিহ্নিত করছে না?তারপরও ড. জিল্লুর গণমাধ্যমের কাঁধে বন্দুক রেখে গুলি ফুটিয়েছেন, মামলাগুলোকে অসত্য বলেছেন, এবংতারপরও মির্জা ফখরুলের বাক্য ব্যবহার করে তিনি বলে দিলেন যে অভিযুক্তদের দৌড়ের উপর রাখার জন্য এসব কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে।

তার দ্বিতীয় বক্তব্য ‘রাজপথের সংঘাতময় পরিস্থিতি’ বিষয়ে। জামাত-বিএনপির ধারাবাহিক বর্বর আগুনসন্ত্রাসের ইতিহাস তিনি মুছে ফেলতে চেয়েছেন এবং বলেছেন যে গত এক বছর ধরে ‘রাজনৈতিক বিরোধী দল’ নির্বাচন পর্যন্তশান্তিপূর্ণ কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার জন্য জিদ ধরে চেষ্টা করছে। এরপর তিনি ২৮ অক্টোবরের সহিংস ঘটনাকে অপ্রত্যাশিত বলেছেন এবং পুলিশকে দোষারোপ করেছেন। দল বেঁধে পিটিয়ে ও ইট দিয়ে ছেঁচে পুলিশ হত্যা করা, যাত্রী থাকা অবস্থায় গাড়িতে আগুন দেয়া, পুলিশ হাসপাতালে হামলা করা আর প্রধান বিচারপতির বাসায় জামাত-বিএনপি’র সংঘবদ্ধ হামলা করাকে ড. জিল্লুর মনে হচ্ছে সমর্থন করছেন।

তৃতীয় ও চতুর্থ বিষয়ে তিনি অনেকগুলো খুচরো প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন; তাকে ধন্যবাদ, এগুলোর প্রত্যেকটিই বিবেচনার দাবি রাখে; কিন্তু নির্বাচন পর্যবেক্ষন প্রতিষ্ঠান বিষয়ে তিনি তার জানাশোনার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। তিনি কি জানেন না যে বিএনপির অঙ্গ সংগঠনের মতো প্রতিষ্ঠান বা আওয়ামী লীগের সমর্থক প্রতিষ্ঠানের মতো অনেক প্রতিষ্ঠানই আছে যারা পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গী প্রকাশ করেন। তাদেরকে কেন নির্বাচন পর্যবেক্ষণের অনুমতি দিতে হবে? পর্যবেক্ষণের প্রক্রিয়া ও মানদণ্ড নিয়ে কথা না বলে তিনি প্রতিষ্ঠানের দিকে নজর দিচ্ছেন কেন? ডালমে কুছ কালা হ্যায়?

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী করার জন্য সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ বিষয়ে একটি কথাও না বলে তিনি তো পুরোপুরিভাবে জামাত-বিএনপি’র দলীয় অবস্থান নিয়ে ফেললেন! বিএনপি এত বছরেও কেন নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের জন্য কোন প্রস্তাবনা হাজির করলো না? কমিশনের ব্যক্তি পরিবর্তন ও অ্যাডহক পদক্ষেপের মাধ্যমে কি নির্বাচন ব্যবস্থা নিরপেক্ষ হয়? না, হয় না। তার মতো জানাশোনাওয়ালা একজন ব্যক্তি ব্যবস্থা পরিবর্তনের কথা না বলে বিএনপি’র দলীয় অবস্থান কেন নেবেন?

সবশেষে প্রথম যে বিষয়টি মনে রাখা দরকার, কেবল ড. হোসেন জিল্লুর নন, প্রায় অধিকাংশ মানুষ রোগের কারণকে মোকাবেলা করতে চান না, তারা লক্ষণের চিকিৎসা করেন। এটাই হলো বাংলাদেশের অনগ্রসরতার অন্যতম প্রধান কারণ। সমস্যার মূলে যেতে হবে।

এরা কি জানেন না যে আদালতের নির্দেশনাক্রমে সাংবিধানিকভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটেছে?এরা কি মইনউদ্দিন-ফখরুদ্দিনের অনির্ধারিতকালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দেখননি? এরা কি জানেন না যে জামাত-বিএনপি অনির্বাচিত ব্যক্তিদের সরকারের মাধ্যমে অসাংবিধানিক সরকার কায়েমের ষড়যন্ত্র করছে? এরা কি দেখেন না যে কী অবমাননাকরভাবে প্রকাশ্যে বিএনপি-জামাত বিদেশীদের সাথে আঁতাত করছে? বিদেশীদের নিজেদের পক্ষে দেখানোর জন্য জালিয়াতির মতো কার্যক্রম পরিচালনা করছে?

সবশেষের দ্বিতীয় যে বিষয়টি মনে রাখতে হবে, তা হলো, রাজনৈতিক অবস্থান। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিরোধ কেবলমাত্র ক্ষমতা দখলের বিরোধের চেয়ে বৃহত্তর। ড. হোসেন জিল্লুরের মতো ব্যক্তিগণআর টক শো’র গণতন্ত্রবাজগণসমস্যাটিকে কেবল ক্ষমতা দখলের সাথে গুলিয়ে ফেলেন।

বিএনপির সাথে যুদ্ধাপরাধীর দল জামাতের গাঁটছাড়া বাধা নিয়ে এদের কোনো বক্তব্য নেই। তার মানে, যে জামাত মানুষের তৈরি সংবিধান-আইন-বিধি-বিধান বাতিল করে আল্লাহর আইন কায়েমের প্রকাশ্য ঘোষণা দেয়, যে জামাতধর্ষণকারী-লুটপাটকারী-অগ্নিসংযোগকারী যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারী, সেই জামাতকে ও যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষাকল্পে যে বিএনপি হরতাল-অবরোধ দিয়েছে, যে বিএনপি নিজামী-সাঈদীর পক্ষে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছে— এই গণতন্ত্রবাজগণ তাদের পক্ষে।

স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ও স্বাধীনতার শত্রুদের পক্ষের লোক হিসেবে এরা আমাদেরও শত্রু। শত্রুদের রাজনৈতিকভাবে পরাজিত করেই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অর্থবহ করতে হবে। ভিন্নমতের সাথে সহাবস্থান হতে পারে, শত্রুপক্ষের সাথে আপোষ হতে পারে না। গত ৫১ বছর এই সহাবস্থানপ্রয়াসের চেষ্টা বিফলে গেছে— শত্রুরা বাংলাদেশের গলা টিপে ধরেছে।

ড.হোসেন জিল্লুর রাজনৈতিকভাবে বাংলাদেশের শত্রুদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন; তাতে সমস্যা নেই; শত্রুর কাতারে তিনি একজন সৈনিক মাত্র। কিন্তুপ্রশ্ন হলো ব্র্যাক নিয়ে; ব্র্যাকের পরিচয় ব্যবহার করে তিনি জামাত-বিএনপির পক্ষ নেন কী করে? ব্র্যাক বাংলাদেশের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালনকারী একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান; আশা করি এখনও ব্র্যাক জামাত-বিএনপি হয়নি। আশা করি ব্র্যাক প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমে নিজেদের চেয়ারম্যানের রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতা বিষয়ে তাদের বক্তব্য পরিষ্কার করবে।

-লেখক: বেসরকারি উন্নয়ন পরামর্শক।