Home সারাদেশ আফসোস নিয়ে চলে গেলেন কেরামত আলী, মুক্তিযোদ্ধা হয়েও পেলেন না রাষ্ট্রীয় মর্যাদা

আফসোস নিয়ে চলে গেলেন কেরামত আলী, মুক্তিযোদ্ধা হয়েও পেলেন না রাষ্ট্রীয় মর্যাদা

26

রাহাদ সুমন, বিশেষ প্রতিনিধি ॥স্বাধীনতার ৫২ বছর পরেও তালিকায় অর্ন্তভূক্ত হতে না পারার একবুক কষ্ট-যন্ত্রনা আর আফসোস নিয়ে চির অচেনার দেশে পাড়ি জমালেন বরিশালের বানারীপাড়ার ৭১’র রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত উপ-পুলিশ পরির্দশক কেরামত আলী খান। এমনকি মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা পাওয়ার সৌভাগ্যটুকুও হয়নি তাঁর। পরিবারের পক্ষ থেকে তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের জন্য বরিশাল জেলা প্রশাসক ও বানারীপাড়ার ইউএনওর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তিনি গেজেটভূক্ত না হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি। ফলে তাঁর স্ত্রী ও তিন কন্যাসহ স্বজনদের মনে আক্ষেপ,অভিমান ও গভীর মর্মপীড়ার সৃষ্টি হয়েছে। বুধবার (২০ সেপ্টেম্বর) ভোর পৌনে ৪টার দিকে মো. কেরামত আলী খাঁন (৭০) ঢাকায় বনশ্রীর আল-রাজি হাসপাতালে চিকিৎসাধিন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তিনি দীর্ঘদিন ধরে ঘাতকব্যাধি ক্যান্সারে ভূগছিলেন। ওই দিন বাদ আসর বানারীপাড়া কেন্দ্রীয় ঈদগাঁহ মাঠে জানাজা শেষে তাকে পৌর শহরের ২ নম্বর ওয়ার্ডের বাড়ির আঙিনায় চির নিন্দ্রায় শায়িত করা হয়।
এ ব্ষিয়ে কেরামত আলী খাঁনের স্ত্রী জাহানারা কেরামত আক্ষেপ করে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম অর্ন্তভূক্ত করার জন্য আমৃত্যু তাঁর স্বামী আইজিপি,স্বরাষ্ট্র ও মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রনালয় এবং জামুকাসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দপ্তরে ছুঁটে বেড়িয়েছেন। স্বামীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তিনিও ছুঁটেছেন। ক্যান্সার আক্রান্ত হওয়ার পরে তাঁর স্বামী মৃত্যুর পূর্বে মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নিজের নাম দেখে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে পড়েন। মনে আফসোস নিয়েই তাঁেক চলে যেতে হলো। এ কষ্ট ও আফসোস আজীবন গোটা পরিবারকে বয়ে বেড়াতে হবে।
কেরামত আলী খানের বড় মেয়ে বানারীপাড়া উপজেলার পূর্ব সলিয়াবাকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক কামরুন্নাহার রুবি বাবার জন্য আহাজারি করে আক্ষেপের সুরে বলছিলেন, এখন আর লিখে কি হবে তিনি তো জীবদ্দশায় তাঁর স্বীকৃতি দেখে যেতে পারলেন না।
তাঁর মেজ জামাতা সুপ্রিমকোর্টের সহকারি এ্যাটর্নি জেনারেল মো. আনিচুর রহমান বলেন,শ্বশুরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করার জন্য জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে মুঠোফোনে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু তিনি গেজেটভূক্ত না হওয়ায় তা সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, লাল-সবুজ পতাকা ও স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় জীবন বাজি রেখে যুদ্ধজয়ী একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হয়েও বিদায় বেলায় তাকে সম্মান জানাতে না পারার মর্মপীড়ায় ভূগছেন গোটা পরিবার।
প্রসঙ্গত,অমিত সাহসী টকবগে যুবক কেরামত আলী খাঁন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উদাত্ত আহবানে সাড়া দিয়ে মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য মনে করে স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে ১৯৭১’র মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ৯ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধকালীণ বেজ কমান্ডার বেনী লাল দাস গুপ্ত বেণুর নেতৃত্বে বরিশালের বানারীপাড়া,উজিরপুর,ঝালকাঠি ও পিরোজপুরের স্বরূপকাঠি উপজেলাসহ বিভিন্ন এলাকায় সন্মূখ সমরে অংশ গ্রহণ করে তিনি দেশ মাতৃকাকে শত্রু মুক্ত করতে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন।
স্বাধীনতার পরে কেরামত আলী খান বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন। দেশের আইন শৃঙ্খলা সমুন্নত রাখতে রাখেন ভূমিকা। পুলিশের সার্ভিস বুকে তার নামের সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা লেখা থাকলেও স্বাধীনতার ৫২ বছরেও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তাঁর নাম অর্ন্তভূক্তি হয়নি।
তার আবেদনের প্রেক্ষিতে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটি যাচাই-বাছাই শেষে গত ২৬ জুলাই জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে তার স্বপক্ষে সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
সেখানে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য সচিব ফাতিমা আজরিন তন্বী, কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধকালীণ বেজ কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা বেনী লাল দাসগুপ্ত বেণু এবং সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মকবুল হোসেন মৃধা স্ব্ক্ষারিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সংশ্লিষ্ট আবেদনকারী কেরামত আলী খাঁনের স্বপক্ষে উপস্থিত স্বাক্ষীদের বক্তব্যে প্রতিমান হয় যে, তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা ও তার দাখিলকৃত কাগজপত্র যাচাই-বাছাই ও পর্যালোচনায়ও দেখা যায় তিনি একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা।
এ সুপারিশকৃত প্রতিবেদন অনুযায়ী কেরামত আলী খাঁনের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় গেজেটভূক্ত হওয়া এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। অথচ মৃত্যুর পূর্বে তিনি তাঁর এ বীরত্ব গাঁথার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেখে যেতে পারলেন না। আফসোস নিয়েই তাকে অনন্তলোকে চলে যেতে হলো।
এদিকে উপজেলা যাচাই-বাছাই কমিটি তাঁকে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রাথমিক স্বীকৃতি দেওয়ায় মানবিক বিবেচনায় তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা যেত বলে তাঁর স্বজনসহ স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অভিমত।
এ ব্যাপারে বানারীপাড়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সহকারি কমান্ডার মীর সাইদুর রহমান শাহজাহান বলেন, যাচাই-বাছাই প্রতিবেদনে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অভিহিত করে সুপারিশ করার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি কেরামত আলী খাঁনকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের জন্য ইউএনওর কাছে বিনীত অনুরোধ জানালে গেজেটে নাম না থাকায় অপরাগতা প্রকাশ করা হয়।
এ প্রসঙ্গে বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য সচিব ফাতিমা আজরিন তন্বী বলেন, তিনি জেলা প্রশাসকসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করেছিলেন কিন্তু কেরামত আলী খান মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভূক্ত না হওয়ায় পরিপত্র অনুযায়ী তাঁকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন দেওয়া সম্ভব হয়নি।