Home মতামত আন্দোলনের একাল সেকাল!!

আন্দোলনের একাল সেকাল!!

25

সরদার মোঃ শাহীন:

কম কথা নয় কিন্তু! আমার এই মধ্য বয়সী জীবনে দু দু’টো যুদ্ধ পার করেছি। এক, মুক্তিযুদ্ধ; দুই, করোনা যুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছোট ছিলাম। বেশ ছোট। তবুও মানসপটে কিছু কিছু স্মৃতি আজও অম্লান। বলা যায় জ্বলজ্বল করছে। আর করোনা যুদ্ধ শেষের দিকে চলে এলেও, এখনও চলমান। এখনো করে যাচ্ছি। দেশে-বিদেশে গেল চার বছরে করোনা যুদ্ধ মোকাবেলা করতে করতে ক্লান্ত হয়েছি, শ্রান্ত হয়েছি। তবে সর্বহারা হইনি এখনো। এখনো বেঁচে আছি – এটাই বিধাতার সবচেয়ে বড় রহমত।
রহমত জীবনের ছোটখাটো যুদ্ধেও কম ছিল না। সে সব যুদ্ধেও শেষমেষ টিকে ছিলাম। বড় দু’টি যুদ্ধের বাইরে এই জীবনে ছোটখাটো কেওয়াজ কিংবা রাজনৈতিক যুদ্ধ যথেষ্ঠ দেখেছি। এরশাদ জমানায় রাজনৈতিক যুদ্ধে ছাত্রজীবনের তিনটি বছর বসে কাটিয়েছি। কলেজ পাশের পরে আর ক্লাস ছিল না। ছিল শুধু বন্ধ আর বন্ধ। ফলতঃ চার বছরের অর্নাস শেষ করেছি ৭ বছরে। এরচেয়ে জীবনের বড় খেসারত যেমন আর কিছু হতে পারে না, তেমনি অর্জনও কিন্তু কম নয়।
অর্জন হলো অভিজ্ঞতা। দিনের পর দিন রাজনৈতিক মিছিল মিটিং, ধর্মঘট, হরতালে অভিজ্ঞতার ঝুলি পরিপূর্ণ হয়েছে সেই আমলে। কঠিন সে সব দিন। আর কঠিন ছিল আন্দোলনের এক একটা ধাপ। বড় দু’দল মিটিং ডেকেছে। আওয়ামীলীগ আর বিএনপি। মিটিং তো নয়, যেন ঢাকা উৎসবের নগরীতে সেজেছে। আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে ১৫ দল মহাসমাবেশ করতো মানিক মিয়া এভিনিউতে। আর বিএনপির নেতৃত্বে ৭ দল গুলিস্তানে।
মাঝেমধ্যে শখ করে দেখতে যেতাম সেসব মিটিং। হাঁটতাম মাইলের পর মাইল। রাস্তায় লাখ লাখ লোকের পদচারণা দেখে উদ্বেলিত হতাম। মিছিলের পর মিছিলে ছেয়ে যেত ঢাকার অলিগলি এবং রাজপথ। সারা বাংলা থেকে লোকজন এসে ঢাকা শহর ছেঁয়ে যেত। ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক, কামার-কুমার, কসাই-মজুর সবাই আসতো। বাদ্যবাজনা বাজিয়ে আসতো। স্লোগান আর নৃত্যের তালে তালে একেকটা মিছিল আসতো আর করতালীতে ফেটে পড়তো চারিদিক। ব্যানার ফেস্টুন তত থাকতো না, যত থাকতো জনতার গলা। সকাল থেকেই জনসমাবেশ স্থলে লোকজন আসা শুরু করতো। প্রচন্ড ঝড়বৃষ্টির মাঝেও সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিটি বক্তার বক্তব্য শুনতো। আর শুনতে শুনতেই আন্দোলন দানা বাঁধতো।
মূলত আন্দোলন দানা বাঁধায় মূল ভূমিকা রাখতো দু’টো শক্তিশালী ফ্রন্ট। শ্রমিক ফ্রন্ট এবং ছাত্রফ্রন্ট। প্রচন্ড শক্তিশালী “শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ; সংক্ষেপে স্কপ”নামের শ্রমিক ফ্রন্টের নেতৃত্ব আসতো টঙ্গী, ডেমরা এবং তেজগাঁও থেকে। অর্থাৎ রাজনৈতিক নেতাদের মাত্র একটি ডাকে ঢাকার দুইপাশ বন্ধ হয়ে যেত। শ্রমিকরা বন্ধ করে দিত। সরকারের সাধ্য ছিল না এসব রুখে দেয়ার। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়? আজও একে রুখে দেয়ার সাধ্য কারো আছে বলেও কেউ বিশ্বাস করে না।
কিন্তু বিশ্বাস না করলে কি হবে? সে সব দিনের ঐতিহ্য এখন বিশ্বাসের মাঝে আর আটকে নেই; স্মৃতির ফ্রেমে আটকে গেছে। যে ছাত্রদের প্রত্যক্ষ ভূমিকায় এই দেশে ভাষার আন্দোলন হয়েছে, গণঅভ্যুত্থান হয়েছে; হয়েছে দেশমাতৃকার মুক্তির আন্দোলন। সেই ছাত্রদের ভূমিকা এখন প্রশ্নবিদ্ধ। গত বছরের নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতি এবং ঢাকা কলেজের ছাত্রদের মাঝের কলহ, মারামারি থেকে প্রাপ্ত ভিডিও ফুটেজ আবারো দেশবাসীকে এমনটাই মনে করিয়ে দিয়েছিল।
ঐ ভিডিও ফুটেজটি ফাঁস হবার আগে জনমত ছাত্রদের পক্ষেই যাচ্ছিল। চিরাচরিত নিয়মে দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে যখনই কোন গুষ্ঠীর কেওয়াজ বাঁধে কিংবা ক্রাইসিস আসে, জনপথ সব সময় ছাত্রদের পক্ষেই যায়। গতবারও যাচ্ছিল। পাশে থাকা বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরাও মাঠে নামা শুরু করেছিল। তারা সবাই নেমেছিল শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে। সবার এক স্লোগান, শিক্ষার্থীরা আহত কেন সরকার তুমি জবাব দাও।
এটা ন্যায় সংগত দাবী ছিল, সন্দেহ নেই। কিন্তু খুব ভাল হতো তারা যদি সাথে এটাও বলতো, ব্যবসায়ীরা নিহত কেন সরকার তুমি জবাব দাও। না, এটা কেউই বলেনি। না শিক্ষার্থীরা, না ব্যবসায়ীদের সংগঠনও। ব্যাপারটা এমন যে, ব্যবসায়ীদের জাত নেই; তারা মানুষ না। তারা মরলেও যা, বাঁচলেও তা। কিন্তু শিক্ষার্থীদের বেঁচে থাকতেই হবে। তারা মানুষ। তাদের জাত আছে। আছে বাঁচার অধিকার।
কিন্তু ব্যবসায়ীদের বাঁচার অধিকার নেই। আর এই সব ব্যবসায়ীরাই যে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সেই সব শিক্ষার্থীদের বাঁচিয়ে রাখছে এবং তারাই শিক্ষার্থীদের আপন লোক, কিংবা ঘরের লোক; এটা কারো আচরণে আসেনি। এই সব ব্যবসায়ীরাই যে অভিভাবক হিসেবে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার খরচ জোগায়, সেটাও কেউ বিবেচনায় নেয়নি। সবার একটাই কথা, শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায় করতেই হবে। তাতে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের অধিকার নিপাত যায় যাক; মরে মরুক।
কী অদ্ভুত এই দেশ! কথায় কথায় আমরা তথাকথিত আদর্শিক সেজে কোন এক পক্ষ নেই। কিন্তু কেউই নিরপেক্ষ হতে পারিনা। কোন সমস্যাকেই দুপাশ দিয়ে দেখি না। দেখি কেবল এক পাশ দিয়ে। ভুলেও নিজের দোষ খোঁজার চেষ্টা করিনা। গতবার ঢাকা কলেজ ঘটনায় যদি ভাগ্যক্রমে ভিডিও ফুটেজটি ফাঁস না হতো, সারা ঢাকা শহরে ছাত্রজনতা রাস্তায় নামতো। কে জানে হয়ত আরো প্রাণ যেত। নিরীহ আর অসহায়ের প্রাণ।
বাংলার জমিনে আজও নিরীহ আমজনতা কিংবা অসহায় সাধারণের প্রাণ যাওয়া একটা অতীব তুচ্ছ ঘটনা। বাসের চাপায় রাস্তায় কুকুরের মরে পড়ে থাকা আর মানুষের মার খেয়ে অসহায় কনেস্টবলের পড়ে মরে থাকার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। আন্দোলনের নামে রাস্তায় একজন আন্দোলনকারীও নেই। আছে গুপ্ত হামলাকারী। যাত্রীবেশে বাসে চড়ে পেট্রোল ঢেলে বাস পুড়িয়ে মানুষ মারে। যেন মানুষ নয়, শিশিরভেজা শীতের রাতে মিষ্টি আলু পোড়ে।
রোগ-ব্যাধিতে মানুষ মারা যাচ্ছে; এটা মেনে নেয়া যায়। কেননা মানবজীবনে রোগ-শোক-জরা থাকবেই। যুদ্ধে মানুষ মারা যায়। এটাও মেনে নেওয়া যায়। কারণ দুই পক্ষই যুদ্ধরত। জায়গা-জমি নিয়েও মানুষ মরছে। কারণ দুই পক্ষই হিংসায় উন্মত্ত, জিঘাংসু। আবার সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে। মেনে নিতে হয়। কারণ এসব মৃত্যু মানুষের অতি সক্ষমতার অভিশাপ।
কিন্তু ট্রেনে ঘুমন্ত মানুষ অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে; এই মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না, এই মৃত্যু মেনে নেওয়া দুষ্কর। কেননা নিহত মানুষগুলো নিরপরাধ। তারা যুদ্ধরত নয়, হিংসায় উন্মত্ত নয়, জিঘাংসু নয়। তারা জানে না মৃত্যুর কারণ। তারা ধর্মের জন্য, গণতন্ত্রের জন্য, ক্ষমতার জন্য, অর্থের জন্য লালায়িত নয়। তারা ঘুমন্ত। ঘুমন্ত মানুষ নিষ্কলুষ।
অথচ এই নিস্কলুষ মানুষদের মারার জন্যে গভীর রাতে গ্রাম এলাকার ট্রেনের স্লিপার খুলে নেয় আন্দোলনকারী নামের পাঁচ সাতজন দূর্বৃত্তের দল। কিংবা রেল লাইন তুলে ফেলে। কম বাজেটে আন্দোলন করে সরকারের গদি নড়াবার সবচেয়ে সহজ পথ এটি। লক্ষ্য একটাই। ট্রেন দূর্ঘটনা ঘটিয়ে ঘুমন্ত অসহায় এবং নিরীহ যাত্রীদের মেরে ছাড়খার করে দেয়া। বর্তমানের আন্দোলন মানেই হলো, বাস পোড়াও, ট্রেন পোড়াও। মানুষ মারো আর মানুষ পোড়ো।
কোন দ্বিমত নেই; বদলে যাওয়া সময়ে আন্দোলনের ধরন বাংলায় বদলে গেছে। বদলে গেছে প্রাণ দেবার ধরণও। আগে প্রাণ দিত আন্দোলনকারীরা। দলবেঁধে দিত। পুলিশের গুলির সামনে দলবেঁধে বুক পেতে দিত। আর এখন প্রাণ দেয় পুলিশ কিংবা অসহায় আমজনতা। তারা আন্দোলনকারীদের লাগানো আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়তে পুড়তে মরে।
ক’দিন ধরেই ভাবছিলাম এমন কেন হয়! আন্দোলনের একাল সেকালে এত তফাৎ কেন? আন্দোলনের ধরণ প্রকৃতি নানাভাবে বিশ্লেষণ করে পার্থক্য একটাই পেয়েছি; এখনকার আন্দোলনে রক্ত নেয় আন্দোলনকারীরা। আর তখনকার আন্দোলনে রক্ত দিত আন্দোলনকারীরা। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ আহত আন্দোলনকারীতে ভরে উঠতো। জাতি হতো মর্ম বেদনায় কাতর। জনমত আন্দোলনকারীদের পুরোপুরি পক্ষে যেত। দেশবাসী তাদের এই ভূমিকায় অবনত মস্তিস্কে শ্রদ্ধা জানাতো।
আর এখন দেশবাসী ধিক্কার জানায় আন্দোলনকারীদের। মানে, অবস্থা ঠিক বিপরীত হয়েছে। উল্টে গেছে। রাজনীতির সেকাল একালের চিত্র কিভাবে এবং কবে যে ঠিক উল্টে গেছে বুঝতেই পারিনি। তবে এটুকু বুঝতে পারি, রাজনৈতিক আন্দোলনের বর্তমান এই চালচিত্র যতদিন না বদলাবে, বাংলাদেশের কোন আন্দোলনের কাঙ্খিত লক্ষ্য কোনদিনও হাসিল হবে না! হতে পারে না!! হবার প্রশ্নই উঠে না!!!

-লেখক: সম্পাদক সিমেকনিউজ ডটকম ও সাপ্তাহিক সিমেক।