Home মতামত আধুনিক শিল্পযাত্রার অন্যতম পথিকৃৎ ঋত্বিক ঘটকের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

আধুনিক শিল্পযাত্রার অন্যতম পথিকৃৎ ঋত্বিক ঘটকের ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ

35

সৈয়দ আমিরুজ্জামান |

বাংলা চলচ্চিত্র জগতে এবং জীবনমুখী সাহিত্য ধারায় ঋত্বিক ঘটক এক বিশিষ্ট শিল্পী। তাঁর কর্ম ও সৃজনক্ষেত্রের পরিধি কেবল চিত্র পরিচালনা ও কথাসাহিত্যে নয়, ভারতের পুনা ফিল্ম ইনস্টিটিউটে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন দীর্ঘকাল। প্রথম জীবনে কবি ও গল্পকার তারপর নাট্যকার, নাট্যপরিচালক, অবশেষে চলচ্চিত্রকার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন। আজ তাঁর ৪৭তম মৃত্যুবার্ষিকী।
ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাক্টিস করো’- কথাটি তিনি প্রায়শই বলতেন। শুধু কি বলতেন? না। কাজের মাধ্যমে দেখাতেনও। সেই কাজ নাটক, সেই কাজ চলচ্চিত্র। নাটক আর চলচ্চিত্রের গল্পে, চিত্রপটে তিনি মানুষকে ভাবাতেন। ভাবতে শেখাতেন। তার গভীর জীবন দর্শন ছড়িয়ে দিতেন দর্শকদের মাঝে। দর্শক সেই দর্শনে ডুবে যেতেন, সমালোচকরা বিশ্লেষণে মগ্ন হতেন।
ঋত্বিক ঘটক বলেছেন, “রাজনীতি জীবনের একটা বড় অংশ। রাজনীতি ছাড়া কিছুই হয় না, প্রত্যেকেই রাজনীতি করে, যে করেনা বলে সেও করে। অ্যাপলিটিক্যাল বলে কোন কথা হয় না।”
সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনদের সঙ্গে একই কাতারে তার নাম উচ্চারিত হয়। বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রে তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় হয়ে আছেন। মাত্র ৭টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে তিনি যে অসামান্য খ্যাতি কুড়িয়েছেন, তা অবিশ্বাস্যও বটে!
তিনি ঋত্বিক কুমার ঘটক। সংক্ষেপে ঋত্বিক ঘটক নামে সবার কাছে পরিচিত। উপমহাদেশের অন্যতম সেরা নির্মাতা হিসেবে তাকে বিবেচনা করা হয়। স্রোতে গা না ভাসিয়ে তিনি ছুটেছিলেন বিপরীতে। বিকল্প ধারার চলচ্চিত্রকে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান এখনো শ্রদ্ধাভরে স্মরণীয়।
সৃষ্টিতে উল্লাস খুঁজে পাওয়া এই ক্ষ্যাপা নির্মাতার চলে যাওয়ার দিন আজ। ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঋত্বিক ঘটক না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। প্রয়াণ দিনে খ্যাতিমান এই চলচ্চিত্রকারের প্রতি শ্রদ্ধা।
ঋত্বিক ঘটকের জন্ম ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশের ঢাকায়। তখন অবশ্য বাংলাদেশ ছিল না। ছিল ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। রাজশাহীর মিয়াঁপাড়ায় তিনি বেড়ে উঠেছিলেন। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী কলেজ ও বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে। এরপর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শেষ করেন এমএ।
অত্যন্ত শিক্ষিত এবং সংস্কৃতি সমৃদ্ধ পরিবারে ঋত্বিক ঘটকের জন্ম। তার বাবা ছিলেন একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট। তবে তিনি কবিতা ও নাটক লিখতেন। এছাড়া ঋত্বিকের বড় ভাই মনীশ ঘটক ছিলেন খ্যাতিমান লেখক। শিল্প-সাহিত্যের ছোঁয়া তাই ছোট বেলাতেই পেয়েছেন ঋত্বিক ঘটক। তিনি যত বড় হয়েছেন, তত উপলব্ধি করেছেন শিল্প-সংস্কৃতির গুরুত্ব। এবং নিজেকেও যুক্ত করেছেন এই সৃষ্টিময় ভুবনে।
১৯৫৮ সালে ঋত্বিক ঘটক কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে গ্রাজুয়েশন কোর্স সম্পন্ন করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ ক্লাসে ভর্তি হন। কিন্তু এমএ কোর্স শেষ না করেই ঋত্বিক বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন। কারণ তার কাছে ডিগ্রির চেয়ে লেখক হওয়া বেশি জরুরি ছিল।
দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন ইত্যাদি নিয়ে তখন পুরো ভারতবর্ষে বিরাজ করছিল অস্থির পরিবেশ। দেশ ও মানুষের সেই প্রেক্ষাপট কলমের আঁচড়ে তুলে ধরতেন ঋত্বিক ঘটক। তৎকালীন বিভিন্ন পত্রিকায় লিখেছেন তিনি।
ঋত্বিক ঘটক ছিলেন বামপন্থী রাজনীতির অনুরাগী। তার চিন্তা-ধারাও ছিল স্রোতের প্রতিকূলে। পত্র-পত্রিকায় লেখার পাশাপাশি নাটকে যুক্ত হন ঋত্বিক ঘটক। পঞ্চাশের দশকে তিনি নাটক লিখেছেন, পরিচালনা করেছেন এবং তাতে অভিনয়ও করেছেন। তার রচিত ও নির্দেশিত নাটকগুলোর মধ্যে রয়েছে- চন্দ্রগুপ্ত, অচলায়তন, কলঙ্ক, দলিল, কত ধানে কত চাল, অফিসার, ইস্পাত, জাগরণ, জ্বলন্ত, জ্বালা, ডাকঘর নবান্ন, ঢেউ, সাঁকো, হযবরল, বিসর্জন ইত্যাদি।
মূলত ছাত্রজীবনেই সংস্কৃতি জগতে পুরোপুরিভাবে জড়িয়ে পড়েন ঋত্বিক ঘটক। দেশভাগের কারণে কলকাতায় চলে যাওয়ার বিষাদময় ঘটনা তাকে প্রবলভাবে আঘাত করেছে। যার ফলে তিনি তার সৃষ্টিকর্মে এই বিষয়টি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বহুবার তুলে ধরেছেন।
চলচ্চিত্রে তার অভিষেক ঘটে ১৯৫১ সালে। নিমাই ঘোষ পরিচালিত ‘ছিন্নমূল’ চলচ্চিত্র দিয়ে তিনি অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। একই চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি।
এক বছর পর অর্থাৎ ১৯৫২ সালে ঋত্বিক ঘটক পূর্ণাঙ্গ পরিচালক হিসেবে কাজ শুরু করেন। তার নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘নাগরিক’। তবে চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়। জানা যায়, ১৯৭৭ সালে এসে ‘নাগরিক’ মুক্তির আলো দেখেছিল।
ছয় বছর সময় নিয়ে ঋত্বিক ঘটক উপহার দেন তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় চলচ্চিত্র ‘অযান্ত্রিক’ ও ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। সমালোচক মহলে চলচ্চিত্র দুটি ব্যাপক প্রশংসিত হয়। যদিও ব্যবসায়িকভাবে তেমন সুবিধা করতে পারেনি এগুলো। তবে চলচ্চিত্র দুটির গল্প, নির্মাণশৈলি ঋত্বিক ঘটককে আলাদা পরিচয় এনে দেয়।
ষাটের দশকে ঋত্বিক ঘটক তিনটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এগুলো হচ্ছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কোমল গান্ধার’ ও ‘সুবর্ণরেখা’। এই তিনটি চলচ্চিত্রকে ঋত্বিক ঘটকের সেরা নির্মাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এগুলোকে একসঙ্গে ঋত্বিক ঘটক ট্রিলজি হিসেবেও অভিহিত করা হয়। তিনটি চলচ্চিত্রে তিনি কলকাতার তৎকালীন রুঢ় বাস্তবতার চিত্র তুলে ধরেছিলেন। যার ফলে ব্যবসায়িক সাফল্য না পেলেও ব্যাপকভাবে আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক।
ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ষাটের দশকে ঋত্বিক ঘটক আর কোনো চলচ্চিত্র নির্মণ করতে পারেননি। সত্তরের দশকে তার ক্যারিয়ারে আসে নতুন মোড়। একজন প্রযোজক তার কাছে আসেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র বানাতে। অদ্বৈত মল্লবর্মণ রচিত এই উপন্যাস ঘিরে একই নামে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ঋত্বিক। ১৯৭৩ সালে মুক্তি পায় এটি। আর মুক্তির পর বাংলা চলচ্চিত্রের ধারায় নতুন একটি পথের সূচনা হয়। যে পথ ধরে পরবর্তী সময়ে অনেকেই হেঁটেছেন। এক জরিপে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ চলচ্চিত্রটি বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের স্বীকৃতি পায়।
ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত শেষ চলচ্চিত্র ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’। এটি মুক্তি পায় ১৯৭৭ সালে। এই চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটকের ব্যক্তি জীবনের অনেক কিছুই উঠে এসেছে। কারণ এটা তার আত্মজীবনীমূলক চলচ্চিত্র। দেশভাগ, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, নকশাল বাড়ি আন্দোলন এই সব কিছু তিনি তুলে ধরেন এখানে।
চলচ্চিত্র ঋত্বিক ঘটকের নেশা, ধ্যান-জ্ঞান সবই ছিল। তবে এই মাধ্যমকে তিনি প্রতিবাদের ভাষা হিসেবেও ব্যবহার করেছেন। তিনি চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সমাজের অন্যায়-অবিচার ও বৈষম্য নিয়ে জোরালো প্রতিবাদ করেছেন। উঁচু, সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া ঋত্বিক সারাজীবন সমাজের নিচু শ্রেণির মানুষের অধিকার নিয়ে লড়েছেন।
ষাটের দশকে ঋত্বিক ঘটক কিছু দিনের জন্য পুনেতে বসবাস করেছেন। সে সময় তিনি ভারতীয় চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে অতিথি অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তিনি সেখানে ভাইস-প্রিন্সিপাল হিসেবে অধিষ্ঠিত হন। তার ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন মনি কাল, কুমার সাহানি, আদুর গোপালকৃষ্ণ, সাঈদ আখতার মির্জা, জন আব্রাহাম, সুভাষ ঘাই ও বিধু বিনোদ চোপড়ার মতো খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতারা।
বাংলা ভাষার চলচ্চিত্রকে নতুন পথ দেখানো ঋত্বিক ঘটককে স্বীকৃতি দিতে ভুল করেনি ভারত সরকার। ১৯৭০ সালেই তাকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করা হয়। একই বছর তিনি ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ স্বর্ণপদক লাভ করেন। ১৯৭৪ সালে ‘যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ্য গল্পকার হিসেবে ঋত্বিক ঘটক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে রজত কমল পুরস্কার অর্জন করেন।
ব্যক্তিজীবনে ভীষণ উদাসীন আর খামখেয়ালী ছিলেন ঋত্বিক ঘটক। অতিরিক্ত মদ্যপান করতেন তিনি। যা তার শরীর নিতে পারেনি। এমনকি অনিয়মের সেই জীবন পছন্দ করতেন না তার স্ত্রী সুরমাও। যার ফলে মৃত্যুর সময় অন্য আপনজন তো পরের কথা, স্ত্রীকেও পাশে পাননি ঋত্বিক। তার ওই সময়কার দুর্বিসহ জীবনের সাক্ষী ছিলেন আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন। তিনি বলেছিলেন, ‘শেষ ক-টা বছর ঋত্বিকের বেঁচে থাকাটাই একটা বিরাট অঘটন।’
১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫০ বছর বয়সে চলে যান ঋত্বিক ঘটক। রেখে যান অসামান্য এক শিল্প অধ্যায়। রেখে যান কিছু অসম্পূর্ণ কাজও। স্রোতের বিপরীতে ছুটে ঋত্বিক চলে গেলেও তার সৃষ্টিকর্ম এখনো উজ্জ্বলভাবে স্মরণীয়। উপমহাদেশের চলচ্চিত্র জগতে তার নির্মাণ গবেষণার এক সমৃদ্ধ ক্ষেত্র।

-লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।