Home মতামত আজ মহান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের ১৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী : মার্ক্সবাদ ও তার প্রাসঙ্গিকতা...

আজ মহান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের ১৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী : মার্ক্সবাদ ও তার প্রাসঙ্গিকতা এখনও বর্তমান

39

সৈয়দ আমিরুজ্জামান:

১৪ই মার্চ মহান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের ১৪০তম মৃত্যুবার্ষিকী।
১৮৮১ সালের ডিসেম্বরে জেনি মারা যাওয়ার পর মার্ক্স এক ধরনের catarrh-য় আক্রান্ত হন। এই রোগ তাকে জীবনের শেষ ১৫ মাস অসুস্থ করে রাখে। এই রোগ পরবর্তীতে ব্রঙ্কাইটিস ও সব শেষে pleurisy তে পরিণত হয়। এই pleurisy-র কারণেই ১৮৮৩ সালের ১৪ই মার্চ তার মৃত্যু হয়। মৃত্যুর সময় মার্ক্সের কোন জাতীয়তা তথা দেশ ছিল না, তাকে ১৭ই মার্চ লন্ডনের হাইগেট সেমিটারি-তে সমাহিত করা হয়। তার সমাধি ফলকে দুটি বাক্য লেখা আছে। প্রথমে লেখা, কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর শেষ লাইন “দুনিয়ার মজদুর এক হও” (Workers of all land unite), এরপরে লেখা ১১তম থিসিস অন ফয়ারবাখ-এর এঙ্গেলীয় সংস্করণের বিখ্যাত উক্তি, “এতোদিন দার্শনিকেরা কেবল বিশ্বকে বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যাই করে গেছেন, কিন্তু আসল কাজ হল তা পরিবর্তন করা।” (The Philowophers have only interpreted the world in various ways – The point however is to change it)
১৮১৮ সালের ৫ মে প্রুশিয়ার ট্রিয়ের শহরে জন্মগ্রহণ করেন মহান দার্শনিক কার্ল মার্ক্স। বিশ্বব্যাপী এ বছর পালিত হয়েছে তাঁর দুই শত তিনতম জন্মবার্ষিকী।
কার্ল মার্ক্স তাঁর আজীবনের সহযোদ্ধা ও সহকর্মী ফ্রেদরিখ এঙ্গেলসের সাথে মিলে প্রতিষ্ঠা করেন শ্রমিক শ্রেণীর বিপ্লবী মতাদর্শ, যাকে পরবর্তীকালে ‘মার্ক্সবাদ’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। বিপ্লবের ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করে মার্ক্সবাদ। যে বিজ্ঞান প্রকৃতি, সমাজ ও মানব মুক্তি এবং চিন্তার গতিবিধি উদ্ঘাটন করে। আর শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে মেহনতি মানুষের বিপ্লব সম্পাদনের এবং সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ নির্মাণের পথ দেখায়। মার্ক্সের অবস্থান, দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতিগুলোকে সম্মিলিতভাবে ‘মার্ক্সবাদ’ বলে অভিহিত।
মার্ক্সীয় মতবাদ জন্মলগ্ন থেকেই শাসকশ্রেণীর আক্রমণ মোকাবিলা করে চলেছে। বুর্জোয়া চিন্তাবিদেরা ‘মার্ক্সবাদ অচল’ বলে প্রচার চালান। কিন্তু এখনও দেখা যাচ্ছে, মার্ক্সবাদ দুনিয়াকে বোঝার ও বদল করার হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে। ফলে তার প্রাসঙ্গিকতা আরও বেশি করে অনুভূত হচ্ছে।
মার্ক্স ‘বিদ্যমান সকল কিছুর কঠোর সমালোচনা’র নীতি অনুসরণ করেন। আর তাঁকে রাজনৈতিক কারণে নির্বাসিতও হতে হয়। দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে হয় তাঁর পরিবারকে। বহু আত্মত্যাগ করেন তাঁরা।
যেটা লক্ষণীয়, মার্ক্সীয় মতবাদ তত্ত্ব ও প্রয়োগের সমন্বয় ঘটায়। মার্ক্স যেমনটা বলেছেন– “‘দার্শনিকরা এ যাবৎ দুনিয়াকে শুধু নানাভাবে ব্যাখ্য করেছেন। তবে মূল কথা হলো তাকে পরিবর্তন করা।” মার্ক্স একাধারে ছিলেন দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও বিপ্লবী। তিনি লাগাতার গবেষণা চালিয়ে যান। আর এর পাশাপাশি ব্যবহারিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও যুক্ত হন। আন্তর্জাতিক সর্বহারাশ্রেণীর মহান শিক্ষক তিনি। লেখক ও সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করেছেন।
১৮৪৮ সালে কমিউনিস্ট লীগের জন্য মার্ক্স ও এঙ্গেলস যৌথভাবে রচনা করেন কমিউনিস্ট পার্টির ইশতেহার।বিশ্বজুড়ে এ বছর যে প্রকাশনার ১৭২তম বার্ষিকী পালিত হচ্ছে। ইশতেহারে তাঁরা ঘোষণা করেন, “আপন মতামত ও লক্ষ্য গোপন করতে কমিউনিস্টরা ঘৃণা বোধ করেন। তাঁরা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেন যে, তাঁদের লক্ষ্য সিদ্ধ হতে পারে কেবল সকল বিদ্যমান সামাজিক অবস্থার সবল উচ্ছেদ মারফত। কমিউনিস্ট বিপ্লবের আতঙ্কে শাসকশ্রেণীরা কাঁপুক। শৃঙ্খল ছাড়া সর্বহারার হারাবার কিছু নেই। জয় করার জন্য আছে সমগ্র জগৎ।” সেই সঙ্গে তাঁরা দৃপ্ত আহ্বান জানান, “দুনিয়ার মজদুর এক হও।”[৪] যা সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে।
১৮৬৪ সালে লন্ডনে মার্ক্সের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ওয়ার্কিং মেনস অ্যাসোসিয়েশন’ (প্রথম আন্তর্জাতিক)। যে সংগঠনের সদস্যরাও ১৮৭১ সালে অংশ নেন প্যারি কমিউনে– যা ছিল সর্বহারাশ্রেণীর রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের প্রথম প্রচেষ্টা। এর মধ্যেই ১৮৬৭ সালে বার্লিনে প্রকাশিত হয় মার্ক্সের ‘পুঁজি’ (ডাস ক্যাপিটাল) গ্রন্থের প্রথম খণ্ড।
১৮৮৩ সালে কার্ল মার্ক্স প্রয়াত হন। এর পরে মার্ক্সবাদকে বিকশিত করেন এঙ্গেলস। যার উদ্যোগে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের মাধ্যমে এই মতবাদ প্রভাব বিস্তার করে। আর উনিশ শতকের শেষ দশকে, ইউরোপের শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের মূলস্রোত হয়ে ওঠে মার্ক্সবাদ।
লক্ষণীয় যে, মার্ক্সবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৮৪০–এর দশকে। ইউরোপে ততদিনে শিল্প বিপ্লব ঘটে গেছে। আর বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব চলমান। সর্বহারাশ্রেণীর আন্দোলন–সংগ্রাম ও সংগঠন ক্রমশই বিকশিত হচ্ছে। এই সমস্ত ঘটনাক্রম মার্ক্সীয় মতবাদের উদ্ভবের বস্তুগত ভিত্তি রচিত হয়েছিল।
লেনিন যেমনটা দেখান, মার্ক্সবাদের তিনটি উৎস– জার্মান দর্শন, ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং ফরাসী সমাজবাদ। আর এই তিনটি উৎসের ভিত্তিতেই মার্ক্সবাদের তিনটি উপাদান বিকশিত হয়। যা হল দর্শন, রাজনৈতিক অর্থনীতি ও বৈজ্ঞানিক সমাজবাদ।
মার্ক্স চিরায়ত জার্মান দর্শন অধ্যয়ন করেন। যদিও তিনি হেগেলের দর্শনের ভাববাদকে বর্জন করেন, তার থেকে গ্রহণ করেন দ্বন্দ্ববাদ। যা বিকাশের গভীরতম তত্ত্ব। আর লুডভিগ ফয়েরবাখের বস্তুবাদী দর্শন থেকে বস্তুবাদী উপাদান সংগ্রহ করেন। অার সমালোচনা করেন যান্ত্রিক বস্তুবাদের। দ্বান্দ্বিকতা ও বস্তুবাদের সমন্বয় ঘটিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।
মার্ক্সবাদ হচ্ছে সর্বহারার বিশ্ববীক্ষা। আর মার্ক্সীয় দর্শন হলো দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। যার অবস্থান সকল প্রকার ভাববাদ ও অধিবিদ্যার বিপরীতে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বস্তুকে প্রথমে ও চেতনাকে দ্বিতীয় স্থানে রাখে। আর মানুষের চিন্তার বাইরে বস্তুর স্বাধীন অস্তিত্ব স্বীকার করে। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ধারণা অনুসারে এই জগৎ অধিগম্য এবং তাই তা পরিবর্তনযোগ্য। বস্তু ও তার মধ্যে উপস্থিত গতি অনন্ত, তাদের মধ্যেকার সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য এবং একটি অপরটিতে রূপান্তরিত হয়।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োগ করে মার্ক্স মানব ইতিহাসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেন– ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা গড়ে তোলেন। আর মানব ইতিহাসের বিকাশের বিধি আবিষ্কার করেন। তিনি দেখান, উৎপাদনের বিকাশের নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক স্তরগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে শ্রেণীসমূহের অস্তিত্ব। শ্রেণীসংগ্রাম সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের দিকে চালিত করে। আর এই একনায়কতন্ত্রই শ্রেণীহীন সমাজ অভিমুখী রূপান্তর ঘটায়। আদিম সাম্যবাদী সমাজ, দাসব্যবস্থা, সামন্ততন্ত্র, পুঁজিবাদ, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের দিকে অগ্রগতির ক্রমপর্যায় চিহ্নিত করেন মার্ক্স–এঙ্গেলস। তাঁরা দেখান, শ্রেণী বিভক্ত সমাজে উৎপাদনের সম্পর্ক ও উৎপাদিকা শক্তির মধ্যেকার দ্বন্দ্বের অভিব্যক্তি ঘটে শ্রেণীসংগ্রামের মাধ্যমে। আর এই শ্রেণীসংগ্রামই মানব ইতিহাসের চালিকাশক্তি। কমিউনিস্ট ইশতেহারে যেমন বলা হয়েছে, “এযাবৎ বিদ্যমান সকল সমাজের ইতিহাসই শ্রেণীসংগ্রামের ইতিহাস।”
আর মার্ক্সীয় অর্থনীতির উৎস চিরায়ত অর্থশাস্ত্র, যার উদ্ভব হয়েছিল ইংল্যান্ডে। অ্যাডাম স্মিথ এবং ডেভিড রিকার্ডো মূল্যের শ্রম তত্ত্বের ভিত্তি স্থাপন করেন। আর মার্ক্স তা ধারাবাহিকভাবে বিকশিত করেন। তিনি দেখান, প্রতিটি পণ্যের মূল্য নির্ধারিত হয়– তা উৎপাদনে ব্যয়িত সামাজিকভাবে আবশ্যক শ্রমসময়ের পরিমাণের দ্বারা।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থাই হলো বুনিয়াদ, যার উপর রাজনৈতিক উপরিকাঠামো দাঁড়িয়ে আছে। বর্তমান পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রণালীর ও এই পদ্ধতি যে বুর্জোয়া সমাজ সৃষ্টি করেছে তার গতিশীলতার বিশেষ বিধি উদ্ঘাটন করেন মার্ক্স। তিনি দেখান, পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার মৌলিক দ্বন্দ্ব হচ্ছে উৎপাদনের সামাজিক চরিত্র বনাম ব্যক্তিগত মালিকানার দ্বন্দ্ব। সেই সঙ্গে তিনি উদ্বৃত্ত মূল্যের রহস্য উদ্ঘাটন করেন। মার্ক্স দেখান, পুঁজিবাদী উৎপাদনের প্রক্রিয়ার মধ্যেই নিহিত আছে শোষণ। শ্রমিকদেরকে কর্মক্ষম রাখতে যেটুকু মূল্য দরকার তার বাইরে উদ্বৃত্ত তৈরি করিয়ে সেই মূল্য আত্মসাৎ করে পুঁজিপতিরা। আর এই উদ্বৃত্ত মূল্যই পুঁজিপতি শ্রেণীর মুনাফা ও সম্পদের উৎস।
মার্ক্সের প্রধান রচনা ‘পুঁজি’–তে (ডাস ক্যাপিটাল) পুঁজিবাদী সমাজের চুলচেরা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ করা হয় এবং পূর্ববর্তী সামাজিক রূপগুলোর সঙ্গে তার গুণগত পার্থক্য তুলে ধরা হয়। স্পষ্টতই, মার্ক্সবাদ ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করে মানুষে–মানুষে সম্পর্ককে, দ্রব্যাদির মধ্যেকার সম্পর্ককে নয়। আর মজুরি–দাসত্বের বিরুদ্ধে লড়াই চালায় এই মতাদর্শ। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিকাশ প্রক্রিয়া এবং তার মধ্যেকার দ্বন্দ্বগুলোও ব্যাখ্যা করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠালাভের ভিত্তিই হলো ব্যক্তিগত অর্থলিপ্সা ও মুনাফা অর্জনের উদ্দেশ্য। যা অসাম্য সৃষ্টি করে। পুঁজির সঞ্চয়নের যুক্তির মধ্যেই এটা অন্তর্নিহিত আছে। আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদনের নৈরাজ্য বাড়ে ও চক্রাকারে সংকট দেখা দেয়।
সেই সঙ্গে মার্ক্স ফরাসী বিপ্লবী ও সমাজবাদী মতবাদ বিচার বিশ্লেষণ করেন। সাঁ সিমোঁ, চার্লস ফুরিয়ে এবং রবার্ট ওয়েনের মতো সমাজবাদীদের কাল্পনিক (ইউটোপিয়ান) সমাজতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষাকে বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর দাঁড় করান তিনি। বৈজ্ঞানিক সমাজবাদের মতবাদকে প্রতিষ্ঠিত করেন, যা হলো– শ্রেণীসংগ্রাম, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র ও সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠার তত্ত্বের সমাহার।
পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বুর্জোয়াশ্রেণীর মুখোমুখি সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণী। চলছে শ্রেণীসংগ্রাম। যা সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের দিকে চালিত করে। এই একনায়কতন্ত্র সর্বহারা শাসনের একটি রূপ। এই একনায়কতন্ত্র পুঁজির শাসন বলপূর্বক উচ্ছেদের একটি পদ্ধতি। যার অধীনে গড়ে ওঠে সমাজতন্ত্র; যা পুঁজিবাদ–উত্তর এক অন্তর্বর্তীকালীন সমাজ এবং সাম্যবাদের প্রথম পর্ব। যেখানে উৎপাদনের উপকরণের সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয়। যা মানব সভ্যতার এক নতুন ও উচ্চতর রূপ– শোষণহীন শ্রেণীহীন সমাজে উত্তরণের পথ প্রশস্ত করে। যে সাম্যবাদী সমাজে প্রত্যেক মানুষ কাজ করবেন তাঁর সাধ্য অনুসারে আর ভোগ করবেন তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী।
মার্ক্স সর্বহারার শ্রেণীসংগ্রামের রণকৌশলের পরিচালক নীতিরও রূপরেখা দেন। ইতিহাসের সর্বশেষ ও বিপ্লবীশ্রেণী– সর্বহারাশ্রেণী (প্রলেতারিয়েত), যাকে শিক্ষিত ও সংগ্রামের জন্য সংগঠিত করার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন তিনি। সর্বহারা শ্রমিকশ্রেণীর নেতৃত্বে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তুলতে তার নিজস্ব সংগঠন, অর্থাৎ সর্বহারার পার্টি গড়ে তোলার উপর জোর দেন। আর মার্ক্স দেখান, কমিউনিস্টরা শ্রমিকশ্রেণীর আশু দাবিদাওয়া অর্জনের জন্য যেমন লড়াই করেন, তেমনই চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে ভবিষ্যৎ সংগ্রামের জন্যও শ্রেণীটিকে প্রস্তুত করেন।
মার্ক্সবাদ কোনো আপ্তবাক্য নয়। তা হলো কাজের পথনির্দেশিকা। মার্ক্সোলজি– মার্ক্স তাঁর সময়কালে যা লিখতে পেরেছিলেন, তার পুনরাবৃত্তিকে অতিক্রম করেন প্রকৃত মার্ক্সবাদীরা। আর ইতিহাসের নতুন অগ্রগতি অনুযায়ী মার্ক্সীয় পদ্ধতি প্রয়োগ করেন তাঁরা। মার্ক্স যেমন নিজের দৃষ্টিভঙ্গিকে ক্রমাগত বিকশিত করে চলেন তাঁর জীবদ্দশায়। বিগত কয়েক দশক ধরে মার্ক্স এবং এঙ্গেলসের সম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি প্রকাশে যে কাজ চলছে তার থেকেও স্পষ্ট প্রতীয়মান মার্ক্সের চিন্তার এই উন্মুক্তমুখ গতিময়তা।
মার্ক্সবাদের সর্বজনীনতা যেমন আছে, তেমনই আছে তার নির্দিষ্টতা। একাংশ এই মতবাদের সাধারণ সত্যকে উপেক্ষা করে কেবলমাত্র তার নির্দিষ্ট বাস্তবতাকে বিবেচনা করেন। ফলে তাদের দক্ষিণপন্থী সংশোধনবাদী বিচ্যুতি হয়।
মার্ক্সবাদের মৌলিক নীতিগুলো যেমন– দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ, শ্রেণীসংগ্রাম, সশস্ত্র সংগ্রাম, সর্বহারার একনায়কতন্ত্র ইত্যাদির বিরোধিতা করেন তারা। আর অপর এক অংশ মার্ক্সবাদের প্রায়োগিক দিকটি উপেক্ষা করে কেবলমাত্র তার সাধারণ সত্যকে গ্রহণ করেন। ফলে তারা সঙ্কীর্ণতাবাদী বিচ্যুতির শিকার হন। অন্ধ গোঁড়ামির পথ ধরেন এবং শুধু যান্ত্রিকভাবে অনুকরণ করে চলেন। তবে প্রকৃত কমিউনিস্টরা সংশোধনবাদ ও সঙ্কীর্ণতাবাদী বিচ্যুতির বিরুদ্ধে লড়াই করেন। সেই সঙ্গে মার্ক্সবাদের মূল নীতিগুলো রক্ষা করেন ও নিজ নিজ দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী তা সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ করেন। দেশটির অভ্যন্তরীণ শ্রেণীশক্তিগুলোর ভিত্তির উপর নির্ভর করে বিপ্লবের পথ বেছে নেন– উপযুক্ত রণনীতি ও রণকৌশল নির্ধারণ করেন। আর তাঁরা শ্রেণী বৈষম্যের পাশাপাশি ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ কিংবা অঞ্চলের ভিত্তিতে বৈষম্য থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রামের উপরও জোর দেন। যার মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষকে সংগঠিত করে বিপ্লবী সংগ্রামকে জোরদার করেন।
স্পষ্টতই, সব ধরনের বুর্জোয়া, পাতি–বুর্জোয়া ও সুবিধাবাদী প্রবণতার বিরুদ্ধে লাগাতার আপসহীন লড়াই চালায় মার্ক্সবাদী বিপ্লবীরা। যা তীব্র শ্রেণীসংগ্রাম ও বিপ্লবের মধ্যদিয়ে বিকশিত হয়। আর এই মতাদর্শ পৃথিবীর দেশে দেশে বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করে। বিংশ শতাব্দীতে রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশে শ্রমিকশ্রেণী এই মতাদর্শের শিক্ষা সফলভাবে প্রয়োগ করে। এপথে শাসকশ্রেণীর রাজনৈতিক ক্ষমতা ধ্বংস করে। মার্ক্সীয় দর্শনের ভিত্তিতে গঠিত সকল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর পরবর্তীকালে অবশ্য পতন হয়েছে। তবে যেটা লক্ষণীয়, মার্ক্সবাদের মূল নীতিগুলো থেকে বিচ্যুতি এবং রূপায়ণে গুরুতর ত্রুটির কারণেই এই বিপর্যয় ঘটেছে।
লেনিন ও মাও সেতুং-এর মতাদর্শ– আজকের দিনের মার্ক্সবাদ
লেনিনের পরিচালনায় ও বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে রাশিয়ার বুকে সংগঠিত হয় নভেম্বর বিপ্লব। সাম্রাজ্যবাদের যুগে সমাজ সংক্রান্ত মার্ক্সবাদী বোঝাপড়াকে ও বিপ্লবী রূপান্তর অর্জনের লক্ষ্যাভিমুখী সর্বহারার রণনীতি–রণকৌশলের তত্ত্বগুলোকে আরও বিকশিত করেন লেনিন। সমাজতান্ত্রিক নির্মাণের প্রাথমিক নীতিরও রূপরেখা দেন তিনি। আর নতুন ধরনের পার্টি– লেনিনবাদী পার্টির সাংগঠনিক নীতিমালা তৈরি করেন। যার মধ্যদিয়ে লেনিন মার্ক্সবাদকে সামগ্রিকভাবে তার বিকাশের দ্বিতীয় পর্যায়, অর্থাৎ লেনিনবাদে উন্নীত করেন।
পরবর্তীকালে মাও সে–তুঙ দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের মাধ্যমে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পাদন করে আধা–সামন্ততান্ত্রিক ও আধা–ঔপনিবেশিক চীনকে মুক্ত করেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে, মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব পরিচালনায় অগ্রসর হন– সর্বহারার একনায়কতন্ত্রের অধীনে লাগাতার বিপ্লবের তত্ত্ব প্রবর্তনের মাধ্যমে। যার মধ্য দিয়ে মার্ক্সবাদ–লেনিনবাদের তৃতীয় স্তর রূপে বিকশিত হয় মাও সে–তুঙের মতাদর্শ– মাওবাদ। আর এইভাবেই গড়ে ওঠে এমএলএম মতবাদ; যা হলো আজকের দিনের মার্ক্সবাদ।
মার্ক্সবাদ এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক
মার্ক্সবাদ এক সামগ্রিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি। আর মার্ক্সীয় দর্শন হলো দ্বন্দ্বমূলক ও ঐতিহাসিক বস্তুবাদ। যা দুনিয়াকে সামগ্রিকভাবে দেখে ও গতিশীল কাঠামোর মধ্যে বিবেচনা করে। অপর কোনো দর্শনই তা পারেনা।
উত্তর–আধুনিকতাবাদ যেমন আজকের দিনের বুর্জোয়া দর্শন; যা সকল প্রগতিশীল সর্বজনীন মতাদর্শের চূড়ান্ত বিরোধিতাই করে। কিন্তু অ্যাস্ট্রো ফিজিক্স থেকে ন্যানো টেকনোলজি– বিজ্ঞানের সকল শাখাগুলোর ক্ষেত্রে বিকাশ ও অগ্রগতি মার্ক্সীয় দর্শনকে সমর্থন করে; আর পুঁজিবাদের দর্শনকে খারিজ করে। যা বর্তমান সময়ে দর্শনের ক্ষেত্রে মার্ক্সবাদের প্রাসঙ্গিকতাকে প্রমাণ করে।
এদিকে যেটা দেখা যাচ্ছে– অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এসেছে। তবে পুঁজিবাদী উৎপাদন পদ্ধতির মূলগত চরিত্রের তারতম্য ঘটেনি। যেমন পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত অস্থিতিশীলতা লক্ষণীয়। যেহেতু পুঁজিবাদের ক্রমবর্ধমান গতিতে বৃদ্ধি ঘটে (ক্যান্সারের মতো, ধারাবাহিকভাবে দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি কেবল মৃত্যুর দিকেই ঠেলে দিতে পারে), সেই বৃদ্ধি অনির্দিষ্টকাল ধরে বজায় রাখা যায় না।
সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজির দুনিয়াজোড়া তৎপরতাও লক্ষণীয়। আর পুঁজির ‘আদিম সঞ্চয়’–এর প্রত্যাবর্তন ঘটেছে। মনুষ্য শ্রম ও প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধে লুটপাট চলছে। সেই সঙ্গে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে দারিদ্র, অসাম্য ও বেকারত্ব। ধ্বংস হচ্ছে পরিবেশ। মার্ক্স তাঁর বিভিন্ন লেখাতেও পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন, পুঁজিবাদের মহাবিপর্যয় ও পরিবেশগত সংকটের মতো বিষয়গুলোর উল্লেখ করেছিলেন।
এদিকে যেটা লক্ষণীয়, সাম্রাজ্যবাদ বিশ্বকে কেন্দ্র ও পরিধিতে বিভক্ত করেছে; এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। আর এখনও পুঁজির কেন্দ্রীভবন ঘটে চলেছে। ধনী–দরিদ্রের বৈষম্য বাড়ছে। অক্সফামের সাম্প্রতিক এক রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৭ সালে বিশ্বজুড়ে সৃষ্ট সম্পদের ৮২ শতাংশই বিশ্বের জনসংখ্যার ধনীতম ১ শতাংশের পকেটস্থ হয়েছে। যখন ৩৭০ কোটি মানুষ, বিশ্বের জনসংখ্যার দরিদ্রতম অর্ধাংশের সম্পদ বৃদ্ধি হয়নি।
এর মধ্যেই সাম্রাজ্যবাদীদের নিজেদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বও বাড়ছে। বাণিজ্য যুদ্ধ বাঁধছে। তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে যুদ্ধ চলছে। আর মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার দোসররা সামরিক হস্তক্ষেপ করে চলেছে বিশ্বের নানা প্রান্তে। যখন পুঁজিবাদের সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে। যে সংকটের বোঝা চাপানো হচ্ছে জনসাধারণের ঘাড়ে। জনবিরোধী নয়া–উদারবাদী অর্থনৈতিক সংস্কার রূপায়ণ করা হচ্ছে। ফলে বাড়ছে জনবিক্ষোভ। যা দমন করতে মরিয়া শাসকশ্রেণী। শ্রমজীবী সমস্ত সাধারণ মানুষকে ভাগ করতে উঠে পড়ে লেগেছে তারা। যখন নানা রূপে নব্য ফ্যাসিবাদের উত্থান হচ্ছে। আর এইসব ঘটনার সুসঙ্গত ও সুসমন্বিত ব্যাখ্যা দিতে পারছে কেবল মার্ক্সবাদ। ফলে রাজনৈতিক অর্থনীতির ক্ষেত্রেও মার্ক্সবাদের প্রাসঙ্গিকতা উপলব্ধি করা যাচ্ছে।
সেই সঙ্গে সমসাময়িক বিশ্বের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতিও লক্ষ্য করছি আমরা। বুর্জোয়া গণতন্ত্র শুধু খাতায়–কলমে আনুষ্ঠানিক গণতন্ত্র। যেখানে প্রকৃত গণতন্ত্র মুষ্টিমেয় বিত্তবানদের হাতেই কুক্ষিগত থাকে। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের উপর পুঁজিপতিশ্রেণীর একনায়কতন্ত্র চলে। যার বিপরীত হলো সর্বহারার একনায়কতন্ত্র। যা জনসাধারণের কার্যকর ক্ষমতায়ন ঘটায়। বুর্জোয়া একনায়কতন্ত্রকে উচ্ছেদ করেই সর্বহারার একনায়কতন্ত্র কায়েম করা যায়। আর তার জন্য প্রয়োজনীয় বিপ্লবী সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয় শ্রমিকশ্রেণীর অগ্রণী বাহিনী– কমিউনিস্ট পার্টি বা ওয়ার্কার্স পার্টি।
ওয়ার্কার্স পার্টি বা কমিউনিস্ট পার্টি মার্ক্সবাদের দ্বারা পরিচালিত হয়। মাও সে–তুঙ যেমনটা বলেছেন, “মনে হয় যেন পার্টির মধ্যে একবার এসে গেলেই মানুষকে ১০০ শতাংশ মার্ক্সবাদী হতে হবে। বস্তুত সব মাপের মার্ক্সবাদী আছেন, যারা ১০০ শতাংশ, ৯০, ৮০, ৭০, ৬০ বা ৫০ শতাংশ মার্ক্সবাদী এবং এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা কেবলমাত্র ১০ বা ২০ শতাংশ মার্ক্সবাদী।” [মাও সে–তুঙ, ‘পার্টির অভ্যন্তরীণ ঐক্য সংক্রান্ত এক দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গি’, ১৮ নভেম্বর, ১৯৫৭]। কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে একদিকে যেমন ভুল–ত্রুটি সংশোধন করার জন্য সংগ্রাম চালানো জরুরি মার্ক্সবাদের নীতির ভিত্তিতে; অন্যদিকে তেমনই নমনীয়ভাবে ঐক্য গড়াও দরকার। ‘‘নীতির সঙ্গে নমনীয়তার সমন্বয় ঘটানো মার্ক্সবাদ–লেনিনবাদের একটি নীতি এবং তা হলো বিপরীতের ঐক্য’’। এভাবে দেশে দেশে শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি বা ওয়ার্কার্স পার্টি গড়ে তোলা জরুরি। আর সেই সঙ্গে শ্রমিক শ্রেণীর মতবাদের ভিত্তিতে এক নতুন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গঠনের প্রয়োজনও অনুভূত হচ্ছে। যখন পুঁজিবাদ–সাম্রাজ্যবাদ গুরুতর সামাজিক, আর্থিক ও পরিবেশগত সংকট সৃষ্টি করছে আর বিশ্বকে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে যাচ্ছে– একমাত্র বিকল্প সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদ। যে মানবমুক্তির পথ দেখাচ্ছে শ্রমিক শ্রেণীর মতাদর্শ। যা হলো আজকের দিনের মার্ক্সবাদ; যা এই সময়কালে আরও বেশি প্রাসঙ্গিক।।

-লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।