Home সারাদেশ অনুগল্প: অপেক্ষা

অনুগল্প: অপেক্ষা

27

শারত প্রভা মীরা: ভোর রাতের ট্রেনটা চলে গেলো কিছুক্ষণ। নিশুতি রাতের নিরবতা কিছু মানুষকে অস্থির করে তোলে।যেন এই নিরবতার মাঝে একটা ভুতুড়ে পরিবেশ থাকে।আর সেই অদ্ভুত পরিবেশ মানুষের ভেতর টাকে জাগিয়ে দেয়।ওরা ঘুমুতে পারে না। প্রকৃতি ওদের ঘুমুতে দেয় না। তেমনি একজন রাতজাগা পাখি সোহরাব হোসেন।

দেশের স্বনামধন্য একজন ল’ইয়ার তিনি।বেশ ক বছর আগে তিনি তার কর্মজীবন থেকে সেচ্ছায় ইস্তফা নিয়েছিলেন। এখন তার পুরোপুরি অবসর। জীবনে বড় হওয়ার নেশায় এতটাই বুঁদ হয়ে ছিলেন কখনযে যৌবন পেড়িয়ে গেলো সেদিকে খেয়াল ছিলো না।পুরোপুরি যে যৌবন তাকে ছোঁয় নি তা কিন্তু না তার জীবনেও রং লেগেছিল,ফাগুন এসেছিলো।

তখন তিনি সাফল্যের দোরগোড়ায় পা রেখেছেন।ভাবছেন তিন কূলে তো নিজের বলে কেউ নেই।এবার একজন নিজের মানুষ চাই।যে ভালোবেসে নিজেকে সবসময় আগলে রাখবে,সুখ দুঃখের সাথী হবে,পূর্নিমা রাতে জোঃস্না,সমুদ্র স্নান,বসন্তের ভোর,বৃষ্টির রাতগুলোতে যার হাতে হাত রাখা যাবে,যার শরীরের গন্ধে মাতাল হওয়া যাবে সময় অসময়।এসব ভাবা হয় ঠিকই কিন্তু ব্যস্ততার জন্য তেমন কাউকে খোঁজা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব ছিলো না।
যাই হোক….

সৃষ্টিকর্তার ইশারাতেই সোহরাব সাহেবের জীবনে ও ঘটলো দেবীর আবির্ভাব। কিন্তু এই আগমন খুব সহজ ছিলো না। সুরভী ছিলো এক সদ্য ডিভোর্সী নারী।তার ব্যবসায়ী স্বামীর অন্যায় অসৎ আচরণ,অপমান সহ্য করা সুরভীর মত আত্মমর্যাদা সম্পন্ন মানুষ মেনে নিতে পারে নি তাই ডিভোর্স। এসবের জের ধরেই সোহরাব সাহেবের সাথে সুরভীর পরিচয় হয়েছিলো।
আর সেই পরিচয় থেকেই ধীরে ধীরে বন্ধুত্ব এবং একপর্যায়ে এসে সোহরাব সাহেবের হৃদয় অঙ্গনে দেবী রুপে সুরভীর আগমন।

সুরভী দেখতে যে খুব সুন্দরী, তা নয়।কালো মতন ছিপছিপে শরীর,চুল কোমড় অব্দি আর একজোড়া ভয়ংকর রকমের সুন্দর আঁখি যুগল। এই তার রুপের বর্ননা। কেউ যদি ভুল করে হলেও কখনও তার চোখের দিকে তাকায় সে নির্দ্বিধায় তার প্রেমে পড়ে যাবে।সৃষ্টি কর্তা কখনও কাওকে নিঃস্ব করে পৃথিবীতে পাঠায় না।সবারই কিছু না কিছু বিশেষত্ব থাকে, যার দ্বারা সে তার বিপরীত মানুষগুলোর মন জয় করতে পারে।
আর অপরদিকে সোহরাব হোসেন সুদর্শন যুবক। কতশত নারী তার প্রণয়ের জন্য উন্মুখ হয়ে সে খবর হয়তো স্বয়ং সোহরাব সাহেব ও রাখেন না।

কিন্তু তিনি সুরভীর প্রেমে পড়েছেন।শুধু প্রেম নয় ভয়ংকর প্রেম।উনার সকাল,বিকাল,দুপুর,সন্ধ্যা, রাত,কাজ সব কিছু জুড়ে সুরভীর ছায়া।সুরভীর সাথে ১০ মি এর সঙ্গ তাকে সারাদিন ভালো রাখে।যেদিন সুরভীর সাথে কথা হয় না,সেদিন টা জনাবের খুব খারাপ যায়।কাজ করতে ভালো লাগে না,নাওয়া খাওয়া ভালো লাগে না। এককথায় দিন দিন সোহরাব সাহেব সুরভী কেন্দ্রীক হয়ে যাচ্ছিলেন।

এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো সময়।সময়ের সাথে দুজনের ভালো থাকা গুলো লিখা হচ্ছিলো দুজনের নামে।তারা একে অপরকে চিঠি লিখতো। সুরভীর মতে,এমন কিছু কথা থাকে যেগুলো চোখে চোখ রেখে কিংবা ফোনে বলা যায় না।সেগুলোর জন্য চিঠির আশ্রয় নিতে হয়।সোহরাব ও মেনে নিয়েছিলো সুরভীর ভাবনা কে।আর তাই হাজার ব্যস্ততার মাঝেও চিঠি লিখা চালিয়ে যেতো।

কিন্তু সৃষ্টিকর্তা যদি কারো ভাগ্যে ভালো থাকা লিখে না রাখেন তাহলে জোর করে কেউ ভালো থাকতে পারে না।
সেদিন ছিলো শুক্রবার…

সকাল থেকে সুরভী নিজের ঘরে নিজেকে তৈরি করতে ব্যস্ত।অনেক জানা শোনার পর আজ দুটি মানুষ বাঁধা পড়তে যাচ্ছে। দুটি মন তাই আজ খুব চঞ্চল। সোহরাব নিজেকে সাজিয়েছে সুরভীর পছন্দ মত।সুরভী পড়েছে সাদা শাড়ী,সাদা দোপাট্টা, অর্নামেন্টস গুলোও শ্বেত মুক্তোর।বিয়েতে স্বাভাবিক লাল রঙটাই প্রাধান্য পায়।কিন্তু সোহরাবের সাদা রঙ পছন্দ। সম্পূর্ণ সাদার সাজে সুরভীকে কার কাছে কেমন লেগেছে কে জানে কিন্তু সোহরাবের কাছে স্বর্গের অপ্সরার চাইতে কোনো অংশে কম মনে হয় নি। পড়ন্ত বিকেলের ক্লান্ত রোদ আর কিছু বন্ধু বান্ধবকে সাক্ষী রেখে চার হাত এক হলো।

এক পথভোলা বাঁধা পড়লো পথের টানে। সিলভার রঙের গাড়ীটা এসে সোহরাবের ফ্ল্যাটের সামনে দাড়ালো রাত ন টায়।সোহরাব নিজে তার প্রেয়সীর হাত ধরে নিয়ে গেলো তার আপন নীড়ে। দরজার কাছে গিয়ে সোহরাব পকেট থেকে চাবি বের করে দরজা খুলে দিলো।সুরভী ভেতরে প্রবেশ করে বেশ খানিকটা অবাক হলো।একা একজন মানুষ তার সব কিছু এতো পরিপাটি? দরজা লাগিয়ে দিয়ে সোহরাব এসে সুরভীর হাত ধরলো বললো,

আজ থেকে আমার এলোমেলো জীবনের চাবি তোমার হাতে দিলাম।এই তোমার সংসার,এখন থেকে তুমি তার দায়িত্ব বুঝে নাও।
সুরভী একগাল হেসে বললো,
আমার নয় জনাব,বলুন আমাদের সংসার।আমরা দুজনে মিলে আমাদের স্বর্গ রচনা করবো।
এই প্রথম দুটি মানুষ, দুটি মন এক হলো….

দেখতে দেখতে কেটে গেলো দু মাস।সব কিছু ভালো চলছে।দুটি মানুষ তাদের ছোট্ট সুখের সংসার।কি নেই সেখানে? সোহরাব চুটিয়ে কাজ করছে। একটার পর একটা কেস সলভ করছে।বাসায় ফিরে প্রেয়সীর প্রেম!! জীবনে আর কি চাই?
কিন্তু এ সুখ যে দীর্ঘস্থায়ী নয় তা কে জানতো?

একদিন বিকেলে কি এক জরুরি প্রয়োজনে বাইরে গিয়েছিলো সুরভী।তার আর ঘরে ফেরা হয় নি।ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে গিয়েছিলো সুরভীর কালো শরীর।সোহরাব কি কখনও ভেবেছিলো সেই ডাগর চোখের কালো হরিনীকে সে আর দেখতে পাবে না?
সেদিন পাগলের মত সব কাজ ফেলে সোহরাব ছুটে গিয়েছিলো হাসপাতালে। দাফন শেষ করে ফিরতে ফিরতে রাত ১১ টা।বন্ধু রা অনেকেই এসেছিলো বাসায়।এক দুজন রাতে থাকতে ও চেয়েছিলো।কিন্তু সোহরাব সবাইকে বিদায় দেয়।সুরভীর সাথে নাকি তার কথা আছে,সুরভী আসবে তার কাছে।সারারাত কান্না করেছিলো সেদিন।সুরভীর রান্না করা খাবার তখনও ফ্রীজে রাখা,শুধু মানুষ টাই নেই।বিছানায় সুরভীর গায়ের গন্ধ,ওর ব্যবহার করা কাপড় সব একসাথে জোড়ো করে পাগলের মত কান্না করেছিলো। কিন্তু সুরভী আসে নি,তার আসার কথা ছিলো না….

তারপর ধীরে ধীরে সোহরাব নিজেকে গুটিয়ে নিতে থাকে।এভাবেই কেটে যাচ্ছে বছরের পর বছর।
এই একাকী জীবনে সোহরাবের কাছাকাছি আর কোনো মেয়ে আসে নি তা কিন্তু না।সে নিজেই সকলের সাথে দূরত্ব বজায় রেখেছে।
এই পয়তাল্লিশ বছর বয়সে এসে আবার নতুন কোনো সুরভীকে তার প্রয়োজন হয় নি।

আজ তাদের বিবাহবার্ষিকী। সোহরাব সাহেব সারাদিন মসজিদে ছিলেন।সুরভীর মঙ্গল কামনায় গরীরদের মাঝে দান করলেন।সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে এলেন। বন্ধুরা দু একজন এসে কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গেছে।

এখন সময় শেষ প্রহর।উনি শাল জড়িয়ে ছাঁদের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছেন আকাশ পানে মুখ করে। হটাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। কল রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে কে যেন বলে উঠলো,

“তুমি এখনও ছাঁদে কী করছো?ঠান্ডা লাগছে না,তাড়াতাড়ি রুমে এসো।আমি অপেক্ষা করছি।”…..

কে ছিলো সেই ফোন কলের ওপাশে?….

-লেখক : শিক্ষার্থী বিবিএ, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।