শান্তনু দে: মুক্তিযুদ্ধের পঞ্চাশ। কিন্তু বাংলাদেশের অর্ধশতকের অভিযাত্রায় এখনও মেলেনি কাঙ্খিত মুক্তি।
মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে এখন রয়েছে দু’টি শক্তিশালী মূল ধারা। একদিকে ধর্মনিরপক্ষ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি। অন্যদিকে ধর্মাশ্রয়ী বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদ রাজনীতি। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী শক্তি। দ্বিদলীয় রাজনীতি। একদিকে আওয়ামি লিগ। অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের তৈরি বিএনপি।
প্রথম ধারাটির নেতৃত্বে আপস সত্ত্বেও রয়েছে আওয়ামি লিগ। দ্বিতীয়টির নেতৃত্বে বিএনপি।
আওয়ামি লিগ ও বিএনপি দু’দলেরই শ্রেণিচরিত্র শেষবিচারে এক। দু’দলই লুটেরা-ধনিক শ্রেণির স্বার্থের প্রতিনিধি। দুর্নীতির রেকর্ড কমবেশি দু’দলেরই রয়েছে। তবে অসাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে রয়েছে পার্থক্য। বিএনপি মৌলবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা। জামাত তাদের প্রধান শরিক। আবার আওয়ামি লিগের সহযোগী থেকেছে জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি। কী অদ্ভুত মিল— জামাতের মতো জাতীয় পার্টিও ব্লাসফেমি (ধর্ম অবমাননা-বিরোধী) আইন চালু করার কথা বলে। বিএনপি প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান জামাতকে বৈধতা দিয়ে থাকলে, শেখ হাসিনা চরম প্রতিক্রিয়াশীল খেলাফতে মজলিসের সঙ্গে পাঁচদফা চুক্তি করেছেন, যা শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধের চেতনার বিরোধী নয়, গণতান্ত্রিক চেতনারও বিরোধী। হেফাজতে ইসলামকেও হাতে রাখার কৌশল অবলম্বন করেছেন। ইতিমধ্যেই পাঠ্যপুস্তক থেকে বাদ গিয়েছে রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রসহ অনেক নামকরা সাহিত্যিকের রচনা। এগুলি ছিল হেফাজতের দাবি। দেশের বিভিন্ন স্থানে ভাস্কর্য ভেঙেছে হেফাজতে। এটা হলো তাদের সঙ্গে আওয়ামি লিগের কৌশল করার পরিণতি। তবে আওয়ামি লিগ মুখে এখনও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বলে। যদিও এখানে কংগ্রেসের মতো প্রায়শই সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে আপস করে। বিএনপি’র সঙ্গে পার্থক্য বলতে এটুকুই। তবে এই পার্থক্যটুকুও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। বিশেষ করে শাহবাগ আন্দোলনের চাপে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসিকাঠে ঝোলানোর প্রশ্নে শেখ হাসিনার সরকারকে অবশ্যই সাধুবাদ জানানো উচিত।
এরশাদই সংবিধান সংশোধন করে রাষ্ট্রধর্মের ধারা যুক্ত করেছিলেন। ১৯৮৮-তে। সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী এনে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম বলে ঘোষণা করেছিলেন। রাতারাতি ইসলাম হয়ে যায় রাষ্ট্রধর্ম। বাকিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। ক্ষমতায় থাকার সময় এরশাদের অসংখ্য অপকর্মের মধ্যে এটি ছিল নিকৃষ্টতম। এবং সবথেকে বিপদজনক। যদিও, বাহাত্তরের সংবিধানকে সংশোধন করে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’কে বিলকুল ছেঁটে দিয়ে সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লা্হির রাহমানির রাহিম’ শব্দবন্ধটি বসিয়ে এরশাদকে এই রাস্তা সহজ করে দিয়ে গিয়েছিলেন জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম বছর থেকেই রাজনীতিতে জামাত ছিল নিষিদ্ধ। ১৯৭৫ সালে সামরিক অভ্যুত্থান, মুজিবর রহমানের হত্যার পর জিয়াউর রহমান এসে এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রথম পদক্ষেপ ছিল বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের বিরুদ্ধে। সংবিধানের ভূমিকায় ‘ধর্মনিরপেক্ষতা এবং ধর্মচারনের অধিকার’কে ছাঁটাই করে যুক্ত করেন ‘বিসমিল্লা্হ’।
একাত্তরের স্বপ্ন ছিল একটি যথার্থ গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজন ছিল সম্পদের ব্যক্তিমালিকানার জায়গায় সামাজিক মালিকানা প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করার।
তা হয়নি। স্বপ্নের বাস্তবায়নের দিকে এগোয়নি দেশ। বরং দূরে সরে এসেছে। এখানেই বামপন্থীদের প্রাসঙ্গিকতা।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী শ্রমিক-কৃষক-মধ্যবিত্ত মানুষ যে বাংলাদেশ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা আজও বাস্তবায়িত হয়নি। সেই স্বপ্ন হল ‘ভিশন-মুক্তিযুদ্ধ ৭১’। অর্থনৈতিক মুক্তি, বাকস্বাধীনতার মুক্তি এবং চাকরি-বাকরির সুযোগ। এই ‘ভিশন-মুক্তিযুদ্ধ ৭১’-এর ভিত্তির ওপরই বর্তমান সময়ের সুনির্দিষ্ট বাস্তবতায় তার নবায়ন চান বামপন্থীরা।
আশার কথা, বাংলাদেশের মানুষ ধার্মিক হতে পারেন, ধর্মান্ধ নন।-লেখক: সাংবাদিক ও কলামিষ্ট, কোলকাতা।