Home সাহিত্য ও বিনোদন গল্প: নোনা জলের কাব্য

গল্প: নোনা জলের কাব্য

61

পলাশ কলি হোসেন শোভা:
ঝিঝি পোকার ডাকে কান ধরে যায় মদিনার। এত গহীন জঙ্গল আর অন্ধকার, কেমন ভয় ভয় করতে লাগে তার। কেমন ভৌতিক পরিবেশ, জোনাকির আলোতেও ভালো লাগে না মদিনার।
সেই কখন থেকে লেংড়া কাজী এসে বসে আছে। মদিনারে দেখে তো তাজ্জব!
তুই এইহানে? গ্রাম শুদ্ধা জানে তোরে কারা জানি তুইলা লইয়া গেছে!!

মদিনা কিছুই বলে না ছলছল করে চেয়ে থাকে লেংড়া কাজীর দিকে। ছোট বেলায় লেংড়ার হাঁটাচলা নিয়ে কত তামাশা ছড়া কাটতো, আজ সে নিজেই তামাশার পাএ হয়ে গেছে।

কই রে কই তোরা! ওই হারামজাদা গেদু গেলি কই বলেই হঠাৎ কাজীর দিকে চোখে পড়ে যায়,
ওহ্! আইছেন তাইলে? গেদু দৌড়ে এসে মোল্লার কাছ থেকে পোটলা গুলো নেয়। শোন্ খোরমা আনছি, বিয়া তো আবার খোরমা ছাড়া অইবো না,কথা বলতে বলতে ঘরে ঢুকে দেখে মদিনা মাটিতে পা বিছিয়ে মিহি সুরে কাদঁছে!

অত কান্দঁস কে,তোরে তো বিয়া করতাছি, ইজ্জত দিতাছি এইডা পছন্দ না?ওঠ, ওঠ জলদি কাপড়ডা পেজ দিয়া আয়। কি রে শরীলে তেল সাবান দেস নাই? নে জলদি কর?রাইত কইলাম বেশি বড় না। বলেই বারান্দায় এসে বসে।

ওই কাজী দেনমোহর দুই শো ট্যাকা লেখবা।
কাজী আমতা আমতা করে বলে, চেয়ারম্যান সাব, আমি তো বুঝি নাই আফনের বিয়া, গেদু তো কিছু কইলো না!!!
আরে গেদু কি কইবো? ক্যা আমারডা অইলে আপনে আইতেন না?

লেংড়া কাজী এবার ইকটু সাহস নিয়ে বলে, কতা সেইটা না, কতা অইলো আফনার ঘরে পাঁচ পাঁচটা ছাওয়াল পাওয়াল আছে, তাছাড়া সুলতানার মা অহনো বাঁইচ্চা আছে

ওই লেংড়ার বাচ্চা লেংড়া সুলতানার মা বাঁইচ্চা আছেঠিক আছে, হের শরীলডা তো বাঁইচ্চা নাই।হেই কবেই শেষ হইছে অহন আর যুইত পাইনা। আমারও তো সাধ আছে নাকি?জলদি বিয়া পড়াও মিয়া।
সাক্ষী লাগবো তো, সাক্ষী কই পাই কন তো?
ওই বেটা গেদুরে দেহোস না চোক্ষে?
আরও লাগে তো?

এবার ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে শফি মোল্লা, আরে বেটা ভুয়া নাম দে, এইডাও কইতে অইবো?
বিয়ে পড়ানো শেষ করে খোরমা খেতে খেতে কাজী বলে,
চেয়ারম্যান সাব কামডা কিন্তু বিবেচনায় অইলো না, এহন তয় আমি যাই।

হ যাও, গেদু হেরে ইকটু আগাইয়া দিয়া আয়,শোনো কাজী কাক পক্ষিও যেন্ না জানে তুমি এই হানে আইছিলা।বাকিটা আর কইলাম না।

মাটির ঘরের এক কোনে কুপি জ্বলছে চৌকিতে জড়সড় হয়ে মদিনা বসে আছে। তার কোন উপায় নাই। মোল্লা তার মা ভাইদের দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়েছে অন্তত ওরা না খেয়ে মরবে না, নিজের তকদীর এর লেখন মনে করে মেনে নিতে চেষ্টা করে সে।

পরাণ পাখি আমার, জাদুর পাখি কাছে আসো। পরমুহূর্তেই চিৎকার করে ডাকে, ওই গেদুর বাচ্চা কই গেলি,কিছু আছে খাওনের?
আছে তো, ঢেঁকি শাক আর আলু ভর্তা।

বাজে একটা গালি দিয়ে বলে, আইজ না খাওয়াইয়া রাখবি দ্যাখতাছি, ওই বান্দির বাচ্চা দুধ নাই?
আছে তো, দিমু?
আবার জিগাস ক্যান?জলদি আন্, শরীলডারে ইকটু বল বানাই।

গেদুর তো আর ভালো লাগে না মদিনারে লইয়া চেরমেন এর বিয়া বিয়া খেলা আর শোয়াশুয়ি। একে তো মাটির ঘর এতটুকুও ফুটা নাই যে সে লুকায়ে দেখবে তাদের।

দরজার এক কোনার ফুটাতে চোখ রাখে গেদু
মদিনার কাছ ঘেঁষে বসে পড়ে মোল্লা, পরাণ পাখি আইসো কলিজা আমার, বলে হাত বাড়তেই এক ঝাটকায় হাত সরিয়ে দেয় মদিনা
কি রে, অহনো সাপের লাহান ফোঁসফোঁস করতাছোস ক্যান? জানোস না তোর এহান থন বাইর হনের উপায় নাই।আমারে ভাতার হিসাবে মাইনা নে মদিনা, গায়ে গতরে আরাম পাবি।

চোখের নোনা জলে গাল ভরে যায়। মোল্লা জোর করে জড়িয়ে ধরে বিছানায় শুয়ে পড়ে।আর মদিনা চাচা নামক ভাতার কে নয়, অন্য কোন এক তাগড়া জোয়ান পুরুষ কে কামনা করতে থাকে।
দরজার ফুটা দিয়ে তা দেখতে দেখতে গেদুর শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে যায়।

পুবের আকাশটা সবে লাল হতে শুরু করেছে। জঙলবাড়ি থেকে বেরুতে বেরুতেই আকাশের দিকে তাকায় শফি মোল্লা। নাহ্ সূর্য উঠতে এখনো বেশ বাকি। তাড়াতাড়ি বাড়ির পথে হাটতে থাকে। মাথায় নানান চিন্তা । হুট করে বিয়ে করাটা কি ঠিক হলো? এত ভোরে পথে আবার কিছু ঘটবে না তো? মদিনারে গেদুর কাছে রাখাটা যুত হইবো তো? গভীর ঘুমে মদিনারে রেখেই চলে আসতে হলো শফি মোল্লা কে। মায়া লাগছে কেন মদিনার জন্য !! তার তো ভোগেই আনন্দ , মায়া তো কখনো কারো জন্য ই অনুভব করেনি! তবে কি…..
সালাম চেরমেন সাব এত বেইনা বেলা ঐ দিক থন আইলেন যে, কই গেছিলেন?
চমকে উঠে শফি মোল্লা, ওওহ্ তুই, বশিরা না? হেইরমই তো মনে হয়। আমারে চিনেন না আফনে?
কথা ঘুরিয়ে দিতেই মোল্লা বলে,তা নদীতে মাছ কেমন? পাইছস কিছু?
আছে তো একখান বোয়াল, চিতল আর রুই আছে দিমু নি
নদীতে কত মরা পচা ভাসে অহন কি আর এই মাছ খাওনের জো আছে।
চেরমেন সাব মরা মানুষ ভাসে এইডা কন। আমার আপনার লাশও ভাসতে পারে
ওই ছেড়া বদের বাচ্চা কার লগে কি কস বোঝোস?
তোর বাপ চাচারা আমারে মান্যি করে আর তুই…
বশির মজা করে বলে, চাচা আফনে এমনে একলা চললে তো বিপদ, তাই কইলাম আপনার বাহিনী কই?মোল্লা কথা বাড়ায় না। এত গোপনীয় একটা রাত কাটিয়ে এসেছে তা কোনভাবেই কেউ জানতে না পারে, বাড়ির দিকে হাটা দেয়, বশিরা বাড়িত মাছ গুলো দিয়া আসিস। মনে মনে ভাবে এর কপালে দুঃখ আছে।

আফনে আছিলেন কই? কইয়া যাইবেন না খোঁজ করতে কে জানি কইলো আফনেরে কাপড়ের দুকানে দ্যাখছে শাড়ি কিনতে, তো আমার শাড়ি কো? মহা বিপদে পরতে যাচ্ছে মনে করে সামলে নেয়, আরে শাড়িতো গঞ্জে মনের ভুলে রাইখা আইছি, শালারা মনে কইরা হাতে দিবো না।
বিলকিস বানু শাড়ির শোকে আর কোন কথা বাড়ায় না। আফনে কাপড় ছাড়েন আমি ভাত দিতাছি
আমি গা ধুয়া খামু সুলতানার মা।
কন কি এত ভোরে! শইল খারাপ করবো তো
কিছু অইবো না শরীলে ম্যালা বল পাইছি ।
বিলকিস বানু ঘর থেকে বেরুতেই মোল্লা ভাবে, বউটা তো খারাপ আছিলো না, এত খেয়াল রাখে। দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে। ভাবে আসলে শরীরের খিদা কোন মায়া মমতা মানে না।

বাজারের এই দিকটায় বেশ লোকজনের আড্ডা চলে জমশেদের চায়ের দোকানে।
আরে দ্যাশ এইবার স্বাধীন অইবোই। দেহো না কেমনে মারতাছে মিলিটারী গো
আরেকজন বল উঠে, কি কও রফিক মিয়া গ্রামের পর গ্রাম জ্বালায়া দিতাছে মানুষ মারতাছে, মিলিটারি কয়ডা মরতাছে? অত সহজ না স্বাধীন করন।আমাগো চেয়ারম্যান এর মত সব খানে এমুন সাচ্চা পাকিস্তানের তাবেদার থাকলে একশো বছরেও স্বাধীন হইবো না আমরা এক পাকিস্তানের লোক।
তর্ক যখন জমে উঠেছে ঠিক তখনই তিনটি ছেলে এসে দোকানের সামনে দাড়ায়। এদের কখনো গ্রাম বাসীরা দেখেনি। এরা কারা সবাই মনে মনে ভাবতে থাকে আর………. (চলবে)

-লেখক : অধ্যাপক (অব), মীরপুর গার্লস আইডিয়াল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, ঢাকা।