Home জাতীয় এক লাখ মামলার জালে সরকার

এক লাখ মামলার জালে সরকার

46

ডেস্ক রিপোর্ট: সরকারের মাথার ওপর বছরের পর বছর ঝুলছে প্রায় এক লাখ (৯৪ হাজার ১৫০) মামলা। এসব মামলায় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারণী বিষয়ের সঙ্গে রাষ্ট্রের কয়েক হাজার কোটি টাকার স্বার্থ জড়িত। রাষ্ট্রপক্ষের সক্রিয় উদ্যোগের অভাবে মামলাগুলো সহজেই নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এতে সুযোগ নিচ্ছে অনেক স্বার্থান্বেষী মহল। শুধু তাই নয়, অর্থসংক্রান্ত মামলার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তারাও বিরোধী পক্ষকে সহযোগিতা করছেন-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের।

এসব চক্র ভেঙে মামলা পরিচালনার যাবতীয় কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসাবে ইতোমধ্যেই মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি উচ্চ পর্যায়ের আন্তঃমন্ত্রণালয়ের কমিটি কাজ শুরু করেছে। কমিটির প্রথম বৈঠকে মন্ত্রিপরিষদ সচিব সব মামলার তথ্য একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে ব্যবস্থাপনার নির্দেশ দিয়েছেন। এটি তৈরির প্রাথমিক কাজ চলছে। এতে প্রত্যেকটি মামলার প্রথমে থেকে সর্বশেষ সব তথ্য-উপাত্ত সংযোজন করা হবে। সংশ্লিষ্ট মামলা নিয়ে আইন কর্মকর্তারা আপডেট থাকবেন। ফলে কেউ তথ্য গোপন করে আদালতকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না।

সূত্র জানায়, সরকারের সব মন্ত্রণালয়-বিভাগ এবং ৬৪টি জেলার মামলা সম্পর্কিত সব তথ্য এখন মন্ত্রিপরিষদের হাতে। এর আগে সরকারি মামলা নিয়ে এত বড় উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। গত বৃহস্পতিবার মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে ৮ সচিবের উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছে। বৈঠকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ৯৪ হাজার ১৫০টি অনিষ্পন্ন মামলার তথ্য উপস্থাপন করা হয়। এর মধ্যে প্রায় দুই হাজার মামলাকে ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’ মামলা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

গুরুত্বপূর্ণ মামলা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কয়েকটি মানদণ্ড ঠিক করা হয়েছে। এর মধ্যে অতি গুরুত্বপূর্ণ মামলার তালিকায় রয়েছে-আইন, অধ্যাদেশ, রাষ্ট্রপতির আদেশ, বিধি, প্রবিধি এবং সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পরিপত্র ও নীতিমালাকে চ্যালেঞ্জ। আরও আছে-ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানগত গুরুত্ব বিবেচনার সরকারি সম্পত্তি সংক্রান্ত মামলা। জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প, কেপিআই সংক্রান্ত মামলা। গণমাধ্যমে বহুল আলোচিত মামলাগুলোকেও অতি গুরুত্বপূর্ণ তালিকার মামলায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

অন্যদিকে ক্রয়, ইজারা, লিজ, নিলাম, ক্ষতিপূরণ, বকেয়া ও আর্থিক দাবি সংক্রান্ত মামলাগুলো সাধারণ তালিকায় থাকছে। তবে এগুলোর মধ্যে বিপুল আর্থিক মূল্য আছে-এমন মামলাকে গুরুত্বপূর্ণ তালিকায় রাখা হচ্ছে। এছাড়া চাকরি সংক্রান্ত ব্যক্তিগত প্রতিকার, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর বিষয়ক মামলাগুলোকেও সাধারণ তালিকায় রাখা হয়েছে।

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, সবচেয়ে বেশি অর্থাৎ ১৬ হাজার ৭৩টি মামলার বেড়াজালে আছে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ। অন্যদিকে মাত্র ২টি মামলা নিয়ে সর্বনিম্নে রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ। আর এক হাজারের বেশি মামলা আছে এমন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সংখ্যা ১৬টি। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগের মামলা ১১ হাজার ৪০৫টি, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১১ হাজার ৩৮৬টি, জননিরাপত্তা বিভাগের ৫ হাজার ৩৮টি, অর্থ বিভাগের পাঁচ হাজার ১০টি, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ৪ হাজার ৬০৩টি। এর বাইরেও হাজারের বেশি মামলা থাকা দপ্তরগুলোর মধ্যে রয়েছে, রাজশাহীর বিভাগীয় কমিশনার, সড়ক পরিবহণ ও মহাসড়ক বিভাগ, ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশন, পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ, খাদ্য মন্ত্রণালয় ও কৃষি মন্ত্রণালয়।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এতদিন সরকার সংশ্লিষ্ট মামলা ব্যবস্থাপনায় কেন্দ্রীয় কোনো উদ্যোগ ছিল না। মন্ত্রণালয়গুলো নিজস্ব উদ্যোগে মামলা পরিচালনা করে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মামলা সংক্রান্ত জ্ঞানের অভাব, অবহেলা এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলার বিপক্ষ পার্টির কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে কেউ কেউ সরকারকে মামলায় হারিয়ে দেওয়ার মতো কাজ করছেন বলে অভিযোগ আছে। তাই মামলা সংক্রান্ত অব্যবস্থাপনা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ এই উদ্যোগ নিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন অনুবিভাগ। অন্যদিকে আইন মন্ত্রণালয় থেকে প্রত্যেক মন্ত্রণালয় ও বিভাগে মামলা সংক্রান্ত বিষয়ে ফোকাল পয়েন্ট অফিসার ঠিক করে দেওয়া হবে। যিনি ওই মন্ত্রণালয়ের মামলা সংক্রান্ত সব কাজে সহযোগিতা করবেন। অন্যদিকে সলিসিটর উইংয়ে একেকজন অফিসারকে কয়েকটি করে জেলার দায়িত্ব দেওয়া হবে। যাতে মাঠ প্রশাসন থেকে আসা মামলার বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। অভিযোগ আছে সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার তথ্য সলিসিটর উইং থেকে উধাও হয়ে যায়।

আরও জানা গেছে, মামলার তথ্য পাওয়ার প্রক্রিয়াটিও অনেক কঠিন ছিল। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে আইন অনুবিভাগকে অগুরুত্বপূর্ণ করে রাখা হয়েছে। এই জায়গায় কাজ করা বেশির ভাগ অফিসারই ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করেন না। অনেকে মামলা সংক্রান্ত কাজের প্রক্রিয়াও বোঝেন না। এ কারণে তথ্য পেতে সমস্যা হয়েছে। অবশেষে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আইন অনুবিভাগ তালিকা তৈরি করেছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ এক হাজার ৯৯৭টি মামলাকে চিহ্নিত করে বিশেষ উদ্যোগের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। গত বছর আগস্টে এ সংক্রান্ত উদ্যোগ প্রথম নেওয়া হয়েছিল। করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতির কারণে তখন আর এগোয়নি।

জানা গেছে, পুরোনো অনেক মামলায় নতুন দায়িত্ব নেওয়া অফিসারদের বিব্রত হতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে সরকারি পক্ষের সঠিক উদ্যোগের অভাবে মন্ত্রণালয়ের সচিবদের আদালত অবমাননার মুখে পড়তে হয়। এগুলোর মূল কারণ মামলা সংক্রান্ত তথ্য ঠিকভাবে আদালতে না যাওয়া। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এই উদ্যোগটিতে সফটওয়্যারের মাধ্যমে মামলার হালনাগাদ তথ্য জানা থাকলে এসব ঘটনা ঘটবে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সূত্র জানায়, গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ওই বৈঠকে কমিটির বেশির ভাগ সদস্য উপস্থিত থাকলেও অ্যাটর্নি জেনারেল ছিলেন না। অ্যাটর্নি জেনারেল অফিস থেকে কোনো প্রতিনিধি পাঠানো হয়নি। সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা নিষ্পত্তির জন্য অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের উদ্যোগ গুরুত্বপূর্ণ। বৈঠকে এই অফিসের প্রতিনিধি না থাকায় বৈঠকে সংশ্লিষ্টরা হতাশা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, অ্যাটর্নি জেনারেল সরকারের প্রতিনিধি। তিনি বা তার অফিসের কোনো প্রতিনিধি বৈঠকে উপস্থিত থাকলে মামলা সংক্রান্ত কার্যক্রম নিষ্পত্তি বেগবান হতো।

সংশ্লিষ্টদের মতে, সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলায় সরকার পক্ষে যারা আইনজীবী থাকেন তারা সামান্য সম্মানী পান। অন্যদিকে সরকারের বিপক্ষ পার্টি বিপুল টাকা বিনিয়োগ করেন। ফলে অনেক মামলায় সরকার পক্ষের আইনজীবী, অনেক ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অফিসের কেউ কেউ ম্যানেজ হয়ে যান। ফলে জনস্বার্থ রক্ষা পায় না। তাই মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ উদ্যোগটি সফল হলে এ ধরনের চাতুরতা ধরা পড়বে। অন্যদিকে সরকার পক্ষের আইনজীবীদের সম্মানী বাড়ানোর বিষয়েও মত দেন বৈঠকে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন মঙ্গলবার বলেন, গণমাধ্যমে মন্তব্য করা উচিত হবে না। এ ব্যাপারে অভ্যন্তরীণভাবে সংশ্লিষ্টদের জানাব।-যুগান্তর