সরদার মোঃ শাহীন:
বলছিলাম আমাদের সমাজ তথা সমাজ ব্যবস্থার কথা। যে সমাজে জন্মেছি আমরা, কোনো সন্দেহ নেই; সমাজটা পশ্চাৎপদ। যথেষ্ঠ রকমের পিছিয়ে থাকা সমাজ ব্যবস্থা। জন্মসূত্রেই পিছিয়ে পড়া বড় অভাগা মানুষ আমরা। আমাদের জীবন যায় জীবনের ঘানি টানতে টানতে। তাই সমাজের কথা ভাবার সময় পাই না তেমন করে। সমাজের জন্যে সামাজিক কাজ করার ফুরসত আমাদের খুব একটা হয়ে উঠে না। হবে কেমন করে! জীবন তো যায় নিজ নিজ জীবন সংগ্রামেই।
সংগ্রামী বাঙালীর নিজের আর পরিবারের একটু ভালো থাকার চিন্তা করতে করতেই পুরো জীবনটাই নিঃশেষ হয়ে যায়। সমাজের জন্যে চিন্তা করার সুযোগ বা সময় কখনোই আর তেমন করে আসে না। অথচ সমাজবদ্ধ জীব হয়ে সমাজকে অবহেলা করে কিংবা সমাজের কথা না ভেবে পার পাবার সুযোগও আমাদের তেমন নেই। যার যতটুকু সময় বা সামর্থ্য আছে, তা দিয়েই সমাজের জন্যে কাজ করাটা জরুরি। সমাজকে একটা সুস্থ সামাজিক ব্যবস্থার আওতায় আনা জরুরি।
এর জন্যে যে উদ্যম সেটা জীবনের শুরু থেকেই কমবেশী সবার মধ্যেই থাকা আবশ্যক। উদ্যমের জন্যে সামর্থ্যটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো ইচ্ছাশক্তি। আমার অভিজ্ঞতা বলে, এই ইচ্ছাশক্তিটা জন্মগত; সকল তারুণ্যের মধ্যেই থাকে। থাকে না শুধু তারুণ্যকে উৎসাহিত করার পারিবারিক কিংবা সামাজিক উদ্যোগ। ভাগ্যক্রমে আমার ছিল। পারিবারিক ভাবে প্রেরণা পাবার গল্প কমবেশি আমার ছিল। তবে তারুণ্যের সব গল্পই এখন আর মনে নেই। জীবনের সব কথাই তো আর মনে থাকে না। মনে রাখা যায় না।
ক’দিন আগে বন্ধুতুল্য ছোট ভাই টিপুর সাথে হঠাৎ করেই দেখা। প্রায় চল্লিশ বছর পর দেখা। আমার চেয়ে এক ক্লাস জুনিয়র ছিল টিপু। কিন্তু চেনাজানায় কমতি ছিল না মোটেও। কমবেশি উঠাবসাও ছিল। সেদিন সিমেক ফাউন্ডেশনের প্রাঙ্গনে দেখাটা হয়ে গেল ভৈরমের সুবাদে। ভৈরম টিপুর সহপাঠী। দীর্ঘদিন ফ্রান্সে ছিল। আর টিপু কানাডাতে আছে বহুকাল। কানাডা প্রবাসী টিপু সাক্ষাতের শুরুতেই আমাদের দু’জনার শেষ সাক্ষাতের কথাটি মনে করিয়ে দিল।
খুব আগ্রহ নিয়েই বললো, ‘তোমার সাথে শেষ দেখা, টঙ্গিতে ইজতেমার মাঠে। হঠাৎ করে দেখলাম ইজতেমার মাঠে যাবার রাস্তায় এক লোক অনেকগুলো বোতল, গ্লাস আর ড্রামভর্তি পানি নিয়ে বসে আছে। আর রাস্তার লোকজনদের ডেকে ডেকে বলছে, আসেন সবাই পানি খান, গোসল করেন। ফ্রি পানি। পরে আমি তাকিয়ে দেখলাম, এ তো তুমি। তো ওদিন আমি ওখানে পানি খেলাম, ওযু করলাম। এরপর আমি সেখান থেকে চলে এলাম। তোমার সাথে আর আমার দেখা হয়নি এরপর।’
কথাগুলো শুনে ফেলে আসা দিনগুলোর কথা মনে পড়লো। প্রায় ভুলে যাবার মতই কথা। অনেক অনেক বছর আগের কথা। বয়স আর কতই বা তখন। কলেজে পড়ি। ১৬ কিংবা ১৭ হবে। আমাদের বাসা তখন টঙ্গীতে। আব্বার সরকারি কোয়ার্টারের সামনের রাস্তায় প্রতিবছর মুসুল্লী এবং পথচারীদের বিনামূল্যে পানি খাওয়াবার ইচ্ছে জাগলো মনে। ইজতেমার লাখ লাখ মুসুল্লীর ভীড়ে একটু পরিষ্কার এবং বিশুদ্ধ পানি তাদের জন্যে তখন ছিল অনেকটা মরুভূমির জলের মতই।
জল নিয়ে ভাবনা জগতে মনের কাজ শুরু হয়ে গেল। তাদের জন্যে নিয়ন্ত্রণহীন মনটা খচখচ করা শুরু করলো। ভেবে পাচ্ছিলাম না কিভাবে কি করবো। অবশেষে খুবই আগ্রহ নিয়ে মুরুব্বী গোছের দু’একজনের সাথে কথা বললাম। পরামর্শ করলাম। অবাক করা বিষয় হলো, খুব একটা পাত্তা পেলাম না। কেউ হেসে উড়িয়ে দিল আর কেউবা দিল টিটকারী। নিরুপায় আমি ময়মুরুব্বীদের কোনরূপ সহযোগিতা না পেয়ে শেষমেষ একা একাই নেমে পড়লাম।
আব্বার সহযোগিতাতেই নামলাম। কাজ তো তেমন কঠিন না। টেবিল গ্লাস যা আছে সব তো বাসায়ই আছে। তাই বাসা থেকেই নেয়া শুরু করলাম। বাসা থেকে নেয়া টেবিল, গ্লাস, বোতল আর পাশের বাসার একখানা ড্রাম নিয়ে রাস্তার পাশেই বসে পড়লাম। যেখানে বসেছি ঠিক তার পেছনেই বিশাল ঔষধের ফ্যাক্টরী, বিপিআই। ব্রিটিশ কোম্পানি। ভিতরটা ভারি সুন্দর। তকতকে, চকচকে করে সব কিছু সাজানো। টার্গেট করলাম ওদের পাপ থেকেই পানি নেবার।
কিন্তু টার্গেট করা যত সহজ, পানি পাওয়া তো ততো সহজ না। আবার ম্যানেজমেন্ট একটু রাজি হলে তেমন কঠিনও না। সমস্যা হলো সিকিউরিটিকে কোন রকমে ম্যানেজ করে ম্যানেজমেন্ট পর্যন্ত পৌঁছানো। বলতে হবে ভাগ্য খুবই প্রসন্ন ছিল। অতদূর যেতে হয়নি। সিকিউরিটি ম্যানেজার চাচা বেশ নরম মনের। তিনি আমার সামান্য অনুরোধেই সাড়া দিলেন। চোখের পলকে নিমিষেই পানির পাম্প থেকে পানি নেয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন।
প্রথমে আমি একাই ছিলাম। পানি পাবার পর লক্ষ্য করলাম প্রায় একই বয়সের আরো একজন জুটেছে আমার সাথে। শক্তি বেড়ে গেল আমার। দু’জনে মিলে কোয়ার্টারের বিভিন্ন বাসা থেকে এটাসেটা এনে আবডালে গোসল করার মত একটু জায়গাও বানিয়ে দিলাম। ক’দিন ধরে ভালভাবে গোসল না করতে পারা প্রচুর লোক মনটা ভরে গোসল করা শুরু করলো। পরনের লুঙ্গিটা একহাতে ধরে অন্য হাতে গায়ে পানি ঢেলে ঢেলে বলছিলো, আহ! শান্তি! বড়ই শান্তি!!
শান্তি মনে ঢক ঢক করে সবাই পানিও খেলো। অনেকেই ওযু করে মনভরে দোয়াও করতে শুরু করলো। কেউ কেউ টয়লেট আছে কি না জানতে চাইলো। দিতে পারলাম না। রাস্তার পাশে টয়লেট করে দেবার মত সামর্থ্য আমাদের ছিল না। তবে আশেপাশে জায়গা ছিল প্রচুর। খোলা জায়গা। তখনকার সময়ে খোলা জায়গায় প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে অভ্যস্থ আমার দেশের মানুষগুলো হাগু করতে না পারলেও হিশু করা শুরু করে দিল। প্রথমে একজন, দু’জন। এরপর লাইন পড়ে গেল।
বলাবাহুল্য অর্থের বিনিময়ে কোন কিছু করছিলাম না আমরা। সবকিছুই ছিল ফ্রি। কে শোনে, কার কথা। অনেকক্ষণ ধরে চেপে রাখার পরে বড় শান্তিতে হিশু করে টলটলা পরিষ্কার পানিতে ওযু করতে পেরে সবাই খুশিতে আমাদেরকে টাকা দেবার জন্যে জোরাজুরি শুরু করলো। আমরাও নাছোড়বান্দা। কোনভাবেই নেবো না।
এক সময় লক্ষ করলাম, একজন মুসল্লী দশটা নতুন গ্লাস এনে টেবিলে রাখছেন। জানতে চাইলাম গ্লাস আনার রহস্য। তিনি খুবই বিনয়ের সাথে বললেন, যেহেতু আমরা কোনোভাবেই টাকা গ্রহণ করছি না; তাই তিনি নিজের উদ্যোগেই গ্লাস কিনে নিয়ে এসেছেন। এনেছেন, যাতে করে গ্লাসের সংখ্যা বাড়ানো যায়। গ্লাসের সংখা যত বাড়বে, পিপাসিত মানুষেরা তত তাড়াতাড়ি পানি পান করতে পারবে। পিপাসিত তিনি একটু আগে এখানে পানি পান করে বড়ই তৃপ্তি পেয়েছেন ।
মানুষটির যুক্তির কাছে শুধু হার মানলাম না। শ্রদ্ধায় মাথা ন্যুয়ে এলো। সাদরে গ্রহণ করলাম তার গ্লাসগুলো। এরই মধ্যে আমার স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যাও বেড়ে গেছে। সবই আমার বয়সী; পোলাপানের দল। শুরু করেছিলাম ৪টা গ্লাস দিয়ে। বুঝতে পারছিলাম গ্লাস আরো দরকার। বুঝতে না বুঝতেই মনের চাওয়াটা আল্লাহপাকই পূরণ করে দিয়েছেন। এখন গ্লাস আমার ১৪টা।
এদিকে সমস্যা শুরু হয়ে গেছে। একের পর এক মুসল্লী পানি খাচ্ছেন আর জোর করছেন টাকা নিতে। তাদের একটাই কথা; টাকা নিয়ে বেশি করে গ্লাস আনেন। শত শত লোকের জন্যে ১৪টি গ্লাসে কোনভাবেই কুলায় না। অবশেষে প্রয়োজনের কাছে হার মানলাম। মুসুল্লীদের টাকায় পাশের বাজার থেকে আরো গ্লাস কিনে মোটামুটি শ’খানেক গ্লাসের ব্যবস্থা করে ফেললাম।
জীবনের শুরুতেই টিনএজার বয়সে খুব না ভেবেচিন্তে হুট করে এমনি এক সামাজিক কাজ করতে পেরে যত না তৃপ্তি পেয়েছিলাম, তার চেয়ে ঢের বেশি পেয়েছিলাম মনের জোর। আর পেয়েছিলাম প্রেরণা। ভাল কাজের প্রেরণা। সাথে কিছু বিশ্বাসও জন্মেছিল। জগতে যতদিন আছি, শুধু নিজের জন্যে বাঁচলেই হবে না। সমাজের জন্যেও বাঁচতে হবে। পরের জন্যে বাঁচতে হবে। আর মানতে হবে কবি’র লেখা বিখ্যাত দুটি লাইন, “পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি, এ জীবন মন সকলি দাও। সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।”
-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা ডট কম।