Home সারাদেশ ১৭ বছর পর রাজশাহী কারাগারে ২ খুনি ঝুলল ফাঁসিতে

১৭ বছর পর রাজশাহী কারাগারে ২ খুনি ঝুলল ফাঁসিতে

183

মো.পাভেল ইসলাম মিমুল রাজশাহী : সতের বছর আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এস তাহের আহমেদকে হত্যার দায়ে দণ্ডিত দুই আসামি ড. মিয়া মোহাম্মদ মহিউদ্দিন এবং জাহাঙ্গীর আলমের ফাঁসি কার্যকর করা হয়েছে।

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে বৃহস্পতিবার রাত ১০টা ১মিনিটে তাদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় বলে সিনিয়র জেল সুপার আব্দুল জলিল জানিয়েছেন। ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানান তিনি।

দুই আসামির মধ্যে জাহাঙ্গীর ছিলেন, অধ্যাপক তাহেরের বাড়ির কেয়ারটেকার। আর মহিউদ্দিন ছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে তাহেরের সহকর্মী।

গবেষণা জালিয়াতির কারণে মহিউদ্দিনের পদোন্নতি আটকে দিয়েছিলেন তাহের। সেই ক্ষোভে মহিউদ্দিনের পরিকল্পনায় ২০০৬ সালে তাহেরকে হত্যা করে লাশ ম্যানহোলে ফেলে দেওয়া হয় বলে এ মামলার বিচারে উঠে আসে।

দুই আসামির ফাঁসি কার্যকর হওয়ার পর বৃহস্পতিবার রাতে অধ্যাপক তাহেরের মেয়ে, আইনজীবী সেগুফতা তাবাসসুম আহমেদ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “হত্যাকারীদের বিচারে প্রদেয় শাস্তি আজ কার্যকর হল, সত্যের জয় হল। ধন্যবাদ আপনাদের। সবাইকে কৃতজ্ঞত। ১৭ বছর বাবাকে বাবা বলে ডাকতে পারি না আমরা, ভাই আর আমি। সে এক নিদারুণ কষ্ট।”

দুই আসামির পরিবারের সদস্যরা গত মঙ্গলবার তাদের সঙ্গে শেষ দেখা করে যান। সেদিন জাহাঙ্গীরের পরিবারের ৩৫ সদস্য এবং মহিউদ্দিনের পরিবারের তিন সদস্য রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে তাদের সঙ্গে দেখা করেন।তার আগে থেকেই দণ্ড কার্যকরের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করে কারা কর্তৃপক্ষ। কেন্দ্রীয় কারাগারের পূর্ব দিকের দেয়ালের পাশে ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুতের কাজ শুরু হয় এক সপ্তাহ আগেই। নিয়ম অনুযায়ী জল্লাদ টিম গঠন করা হয়। প্রশিক্ষণ শেষে আট জল্লাদের ওই টিম একাধিকবার মহড়াও দেয়।

বৃহস্পতিবার দুটো কফিন নিয়ে আসা হয় কেন্দ্রীয় কারাগারে। তখনই জানা যায়, রাতেই কার্যকর হবে দুই আসামির ফাঁসি। সন্ধ্যায় কারাগারের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়, কারা ফটকে মোতায়েন করা হয় অতিরিক্ত পুলিশ ও কারারক্ষী।

লাশ গ্রহণ করার জন্য জাহাঙ্গীরের বড় ভাই সোহরাব হোসেনকে রাতে কারাগারে ডেকে আনা হয়। কারাগারের চিকিৎসক ডা. মিজান উদ্দিন ও ডা. জুবায়েরসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা পেছনের ফটক দিয়ে প্রবেশ করেন।

রাত ৯টার দিকে দুই আসামিকে জানানো হয়, রাতেই তাদের দণ্ড কার্যকর হবে। এরপর তাদের গোসল করিয়ে শেষ ইচ্ছা জানতে চাওয়া হয়। কারা মসজিদের ইমাম মুজাহিদুল ইসলাম তাদের তওবা পড়ান।

পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, তওবা করে নামাজও পড়েন দুই আসামি। সে সময় তাদের দুজনকেই স্বাভাবিক দেখাচ্ছিল।

জল্লাদরা নির্ধারিত সময়ে আসামিদের ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যান, পরিয়ে দেন কালো টুপি ও ফাঁসির দড়ি। সব আনুষ্ঠানিকতা সেরে দলের প্রধান জল্লাদ আলমগীল হোসেন ও তার সহযোগী জল্লাদ উজ্জল ফাঁসি কার্যকর করেন। নিয়ম অনুযায়ী, ফাঁসি কার্যকরের পর ৩০ মিনিট লাশ দড়িতে ঝুলিয়ে রাখা হয়। পরে ময়নাতদন্ত সেরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে মরদেহ।

রাজশাহী বিভাগের কারা উপ-মহাপরিদর্শক কামাল হোসেন, রাজশাহী জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা প্রশাসক শামিম আহমেদ, রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের বিশেষ সুপার মুহাম্মদ আব্দুর রকিব, রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাইদ মোহাম্মদ ফারুক, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সাবিহা সুলতানা, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. আব্দুল জলিল, জেলার নিজাম উদ্দিন, রাজশাহী কারা হাসপাতালের সহকারী সার্জন ডা. মো. মিজানুর রহমান, ডা. মো. জুবায়ের আলম, ফার্মাসিস্ট উমর ফারুক, ডেপুটি জেলার মুহাম্মদ আবু সাদাত ফাঁসি কার্যকরের সময় উপস্থিত ছিলেন।

দুটো অ্যাম্বুলেন্স আগেই কারাগারের ভেতরে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। সেগুলোতে করে দাফনের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় দুই আসামির মরদেহ। রাত ১২টায় তাদের লাশ কারাগার থেকে বের করা হয়। তাদের কবর খোঁড়ার কাজও আগে থেকেই সেরে রাখা হয়েছিল। জাহাঙ্গীরের দাফন হবে রাজশাহী নগরীর খোঁজাপুর কবরস্থানে। আর মহিউদ্দিনকে ফরিদপুরের ভাঙ্গায় তার গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে।

২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পশ্চিমপাড়া আবাসিক কোয়ার্টার থেকে অধ্যাপক তাহের নিখোঁজ হন। ওই বাসায় তিনি একাই থাকতেন। কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীর তার দেখাশোনা করতেন।দুদিন পর বাসার পেছনের ম্যানহোল থেকে অধ্যাপক তাহেরের গলিত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি তার ছেলে সানজিদ আলভি আহমেদ রাজশাহীর মতিহার থানায় অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন।

অধ্যাপক তাহেরের করা একটি জিডির সূত্র ধরে বিভাগের শিক্ষক মহিউদ্দিন ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী ছাত্রশিবিরের তৎকালীন সভাপতি মাহবুবুল আলম সালেহী, কেয়ারটেকার জাহাঙ্গীরসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর ৫ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তারদের মধ্যে তিনজন আদালতে জবানবন্দি দেন।

জবানবন্দিতে তারা বলেন, অধ্যাপক এস তাহের বিভাগের একাডেমিক কমিটির প্রধান ছিলেন। একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মহিউদ্দিন অধ্যাপক পদে পদোন্নতির জন্য কমিটির সুপারিশ চেয়ে আসছিলেন। কিন্তু গবেষণা জালিয়াতির কারণে অধ্যাপক তাহের তা দিতে অস্বীকার করেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে মহিউদ্দিন হত্যার পরিকল্পনা করেন।

বালিশ চাপা দিয়ে খুনের পর বাড়ির ভেতরে থাকা চটের বস্তায় ভরে অধ্যাপক তাহেরের লাশ বাসার পেছনে নেওয়া হয়। লাশ গুমের জন্য জাহাঙ্গীরের ভাই নাজমুল আলম ও নাজমুলের স্ত্রীর ভাই আবদুস সালামকে ডেকে আনা হয়। তাদের সহায়তায় বাসার পেছনের ম্যানহোলের ঢাকনা খুলে তাহেরের লাশ ফেলে দেওয়া হয়।

২০০৭ সালের ১৭ মার্চ শিবির নেতা মাহবুব আলম সালেহীসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২২ মে রাজশাহীর দ্রুত বিচার আদালত চারজনকে ফাঁসি ও দুজনকে খালাস দেয়।

দণ্ডিত অন্যরা হলেন- জাহাঙ্গীরের ভাই নাজমুল ও তার স্ত্রীর ভাই সালাম। তবে ছাত্রশিবিরের নেতা সালেহী ও আজিমুদ্দিন মুন্সি বিচারে খালাস পান। পরে দণ্ডিতরা হাই কোর্টে আপিল করেন। হাই কোর্ট মহিউদ্দিন ও জাহাঙ্গীরের রায় বহাল রাখলেও নাজমুল ও সালামের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়।

তাদের দণ্ড বৃদ্ধি চেয়ে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি শেষে ২০২২ সালের ৫ এপ্রিল আপিল বিভাগ হাই কোর্ট বিভাগের রায়ই বহাল রাখে। এরপর আসামিদের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদনও খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট।

শেষ ধাপে কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন করেছিলেন আসামিরা। ছয় মাস আগে রাষ্ট্রপতি সে আবেদনও নাকচ করে দিলে দণ্ড কার্যকরের সব বাধা কাটে।