Home শিক্ষা ও ক্যাম্পাস হাত সরিয়ে মেরে আমার কান ফাটিয়ে দেন হলের ফরিদ ভাই’

হাত সরিয়ে মেরে আমার কান ফাটিয়ে দেন হলের ফরিদ ভাই’

781

জাবি প্রতিনিধি: আমি কানে হাত দিয়ে বাচানোর চেষ্টা করলে হাত সরিয়ে মেরে কান ফাটিয়ে দেন পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৪ ব্যাচের ফরিদ ভাই।

আমি অসুস্থ হলে শুয়ে পড়ি কিন্তু তারা আমাকে বসতেও দেই নাই। ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলে যেতে দেয় নাই। আমি নাটক করছি বলে লাথি দেওয়ার চেষ্টা করে আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৬ ব্যাচের মোস্তাফিজুর ভাই। এমনটাই বলছিলেন ভুক্তভোগী শিক্ষার্থী সজীব আহমেদ। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ৪৮ ব্যাচের শিক্ষার্থী।
গত মঙ্গলবার (২১ মার্চ) রাত ১০ টা ৪০ মিনিটে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে গেস্টরুম চলাকালীন এলোপাতাড়ি চড় মেরে এই শিক্ষার্থীর কান ফাটিয়ে দেন শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি হাসান মাহমুদ ফরিদ( পরিবেশ বিজ্ঞান-৪৪) ও আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান (ইতিহাস-৪৪)। ছাত্রত্ব শেষ হলেও এই দুই নেতা অবৈধভাবে হলে অবস্থান করছেন।

ভুক্তভোগী সজীব আহমেদ বলেন, ঝামেলাটা শুরু হয়েছিল বহিরাগত একজনের সাথে। সে আমাদের বড়ভাইদের গেস্ট ছিল । এর ঝামেলার কারণে আমাদের গেস্টরুমে ডেকে ৪৮ তম ব্যাচের আমাদের অমানবিকভাবে নির্যাতন করা হয়। নায়িম (রসায়ন -৪৮) সিয়াম (প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ-৪৮) ও আমাকে কানে ইচ্ছেমত মারার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি কানে হাত দিয়ে বাচানোর চেষ্টা করলে হাত সরিয়ে মারধর করেছে ইতিহাস বিভাগের ৪৪ ব্যাচের ফরিদ ভাই। আমি অসুস্থ হলে শুয়ে পড়ি,কিন্তু তারা আমাকে বসতেও দেই নাই। ডাক্তারের কাছে যেতে চাইলে যেতে দেয় নাই। আমি নাটক করছি বলে আমি লাথি দেওয়ার চেষ্টা করে আর্ন্তজাতিক সম্পর্কবিভাগের ৪৬ ব্যাচের মোস্তাফিজুর রহমান।
ভুক্তোভোগী আরো জানায়, আমাকে জাবি মেডিকেলে নেওয়া পর ডাক্তাররা এনামে মেডিকেলে সুপারিশ করলে ঘটনা জানাজানি হওয়ার ভয়ে হলের বড়ভাইরা আমাকে যেতে দেইনি। পরে বন্ধুরা জোড় করে নিয়ে যায়। ডাক্তারা পরিক্ষা করে জানায় আমার কানের পর্দা অনেকটা ফেটে গেছে । একমাস পরে জানা যাবে শুনতে পাবো কীনা।
অভিযোগ দেওয়ার বিষয়ে ভুক্তোভোগী বলেন, ‘তারা ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী। তাদের কারোরই ছাত্রত্ব নেই। কার কাছে অভিযোগ দিবো।’

এদিকে রাত সাড়ে ১১টায় সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আল রাজিসহ কয়েকজন তাকে বিশ^বিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে যায়। কর্তব্যরত ডাক্তার উন্নত চিকিৎসার জন্য একটি বেসরকারী হাসপিতালে (এনাম মেডিকেল) হস্তান্তর করে। কর্তব্যরত ডাক্তার জানায়, একজন শিক্ষার্থীকে নিয়ে কয়েকজন এসেছিল। শিক্ষার্থীর কান দিয়ে রক্ত পড়ছিলো। পরে তাকে এম্বুলেন্সে করে এনাম মেডিকেলে পাঠানো হয়েছে।
এনাম মেডিকেল হাসপিতালের একটি প্রেসকিপসন প্রতিনিধির কাছে এসেছে। এতে রোগীকে তিন মাস কানে পানি না ঢুকানো, কানে তেলে ভেজা তুলা দিয়ে গোসল করা, পানিতে ডুব দিয়ে গোসল করা থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছে।
এর আগে ২১ মার্চ দুপুর সাড়ে ৩টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি দিবেন্দু দিব্যের সাথে দ্বন্দ্বে জড়ান হলের ছাত্রলীগ কর্মীরা। পরে তাকে হলের গেস্টরুমে তুলে এনে বেধড়ক মারধর করেন। এই ভুক্তোভোগী জাবি ছাত্রলীগের উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক আলরাজি সরকারের পরিচিত হওয়ায় হলের সিনিয়দের নিয়ে মিটিং হয়। মীমাংসা শেষে ভুক্তোভোগী ক্ষমা চেয়ে চলে যাওয়ার সময় হলের জুনিয়র কর্মীরা আবারও চড়াও হয় । এই ঘটনাসহ হলের অন্যান্য ঘটনা নিয়ে রাত সাড়ে ৮টায় শুরু হয় গেস্টরুম। চলে রাত ১টা পর্যন্ত।
গেস্টরুমে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন রসায়ন বিভাগের ৪৪ ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন, মার্কেটিং বিভাগের ৪৪ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আবুল কালাম আজাদ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ৪৪ তম ব্যাচের শিক্ষার্র্থী ও শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি শাহ পরান, একই বিভাগের ৪৫ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের ৪৫ তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ও উপ-ছাত্রবৃত্তি বিষয়ক সম্পাদক আল রাজি সরকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, রাত সাড়ে ৮ টা থেকে গেস্টরুম শুরু হয়। দুপুরে হলের সিনিয়রের অতিথির সাথে জুনিয়রদের খারাপ ব্যবহার করাকে কেন্দ্র করে চলতে থাকে গেস্টরুম। আনুমানিক রাত ১০ টা ৪০ মিনিটে ভূক্তভোগী সজীবের কানে এলোপাথাড়ি চড় মারে ফরিদ। এতে সজীবের কান ফেটে রক্ত বের হতে থাকে। সে কেঁদে কেঁদে অনুরোধ করে, ‘ভাই, আমাকে ছেড়ে দিন। আমি আর রাজনীতি করবো না। বাসায় চলে যাবো।’ এতে আরো ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আব্দুল্লাহ আল ফারুক ইমরান বলেন, ও নাটক করতেছে। ওরে তোল। আজকে এই গেস্টরুম থেকে ওর লাশ বের হবে।’
পরে সজীবকে নিয়ে মেডিকেলে যাওয়াার সময় হল গেটে বাধা দেয় ইমরান। ‘আগে দেখ সে নাটক করতেছে কিনা। ২০-৩০ মিনিট অবজার্ভ কর। তারপরে মেডিকেলে নিয়ে যা। আর এখন মেডিকেলে নিয়ে গেলে নিউজ হবে। তখন আমরা বিষয়টা হ্যান্ডেল করতে পারবো না।’ ইমরান এভাবেই জুনিয়রদের শ^াসাচ্ছিলেন বলেন মন্তব্য করেছেন হল গেটে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীরা।
এরপরে ইমরান সজীবকে হলগেটে আরো ১৫-২০ মিনিট আটকে রাখে । পরে সজীবের অবস্থা খারাপ হলে তাকে প্রথমে বিশ্ববিদালয়ের কেন্দ্রীয় মেডিকেলে এবং পরে সাভারের এনাম মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়।

অভিযুক্ত হাসান মাহমুদ ফরিদ বলেন, ‘তার কানে সমস্যা ছিলো । আমাদের মিটিং চলছিলো ।মিটিংয়ের মাঝে তার কান দিয়ে রক্ত পড়ছিলো ।তখন আমাদের ভাইয়েরা তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়।’
অভিযুক্ত ইমরান গেস্টরুমের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘ভুক্তভোগীর সারাদিন ক্লাস-এসাইনমেন্ট থাকার ফলে গেস্টরুমে এসে শারীরিক দূর্বলতা জনিত কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছে।’ গেস্টরুমের ব্যাপারে তিনি বলেন, রোজার আগে এটি আমাদের রুটিন গেস্টরুম। নির্দিষ্ট করা ছিলো না, আজকে আমাদের হয়েছে কাল হয়তোবা অন্যদের হবে। রোজায় সাংগঠনিক দিকনির্দেশনা দেয়ার জন্য এ গেস্টরুম।
অভিযুক্ত আবুল কালাম আজাদ বলেন, রোজার আগে কর্মীদের দিকনির্দেশনা দিতে গেস্টরুম ডাকি। এছাড়াও গেস্টরুমে কর্মীদের সমসাময়িক কিছু মারধরের ঘটনা বিষয়ে জানতে আমরা তাদের নিয়ে বসি।’
অভিযুক্ত দেলোয়ার হোসেন গেস্টরুমের বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, ‘রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের একজন গেস্টকে জুনিয়ররা মারধর করলে আমরা বিষয়টি সমাধান করি।’ কান ফাটানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কার কানের ভিতর কী ছিলো এটাতো আমরা জানি না। সে অসুস্থ ছিল ডাক্তার বললো । মারধরের কোন ঘটনা আমরা দেখি নি।’
অভিযুক্ত মোস্তাফিজুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি। অভিযুক্ত আল রাজি সরকার ঘটনার সাথে জড়িত নয় বলে জানান।
হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ওবায়দুর রহমান বলেন, আছরের নামাজের সময় উপস্থিত হলে বহিরাগতকে ধরে আনার বিষয়টি জানতে পারি। পরে ভুক্তোভোগী ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলি। তারা উভয় মীমাংসা হয়েছে জানালে আমি চলে আসি। এবং আমাদের ওয়ার্ডেনকে ঘটনাটি খোঁজখবর রাখতে বলি।
তিনি আরো জানান, রাতে হলের গেস্টরুমে সজীব নামে এক শিক্ষার্থীকে মারধর করেছে জেনেছি। ভুক্তোভোগী ছেলের সাথে কথা বলেছি। সে অভিযোগ দিলে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।