Home খেলা সাবিনা, মাসুরাদের অপেক্ষায় সাতক্ষীরার মানুষ

সাবিনা, মাসুরাদের অপেক্ষায় সাতক্ষীরার মানুষ

65

নজরুল ইসলাম(তালা) সাতক্ষীরা: সকাল থেকে সাবিনা খাতুনের বাড়িতে সাংবাদিকদের ভিড়। সবাই সাবিনা সম্পর্কে জানতে চাচ্ছেন। অধিনায়ক সাবিনার পরিবারের খোঁজখবর নিচ্ছেন, ছবি তুলছেন, ভিডিও করছেন। নারী ফুটবল দলের অপরিহার্য ডিফেন্ডার মাসুরা পারভিনের বাড়িতেও সাংবাদিকেরা আসছেন। তাঁর দুই বোন, মা–বাবা মিলে গতকালের খেলা নিয়ে আলোচনা করছেন।
সাতক্ষীরা শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে বেতনানদীর তীরে বিনেরপোতা এলাকায় মাসুরাদের বাড়ি। মঙ্গলবার দুপুর ১২টার দিকে ওই বাড়িতে গিয়ে মাসুরার মা–বাবা ও দুই বোনের সঙ্গে কথা হয়। বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আনন্দে আত্মহারা মাসুরার বাবা মো. রজব আলী, ‘আমি আপনাদের বলছিলাম না, বাংলাদেশ শিরোপা জিতবে, দেখেন, ঠিক জিতেছে। আমি অনেক হিসাব–নিকাশ করে বলেছিলাম।’ রজব আলী একদমে কথাগুলো বললেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমি মেয়ের খেলায় আত্মহারা। মাসুরা যেভাবে ডিফেন্স আগলে রেখেছিল, তাতে নেপাল দল সুবিধা করতে পারেনি। তবে বাংলাদেশ দলের সবাই এখন ভালো খেলে, পরিণত দল। সাবিনা ও কৃষ্ণা রানী তো অপ্রতিরোধ্য।’
রজব আলী কখনো ফুটবল খেলেননি। কিন্তু ফুটবলের হিসাব-নিকাশটা ভালোই বোঝেন। খেলার আগের দিন মেয়েকে মুঠোফোনে বলেছিলেন, ‘আত্মবিশ্বাস রাখবি, ভেঙে পড়বি না, হতাশ হবি না। এখন তোদের দল আগের চেয়ে অনেক পরিণত। আমি বলছি, তোরাই জিতবি। বাংলাদেশের কাঁধে উঠবে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি।’
যদিও সামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বাবা রজব আলী শুরুতে চাননি মেয়ে ফুটবল খেলুক। তবে মেয়ের ছিল প্রচণ্ড ইচ্ছা আর জিদ। আর কোচ প্রয়াত আকবর আলীর অনুরোধ ও স্ত্রী ফাতেমা বেগমের চাওয়ার কাছে একসময় নতি স্বীকার করতে বাধ্য হন। এখন মেয়েকে নিয়ে গর্ব করেন তিনি। সবাই এখন তাঁকে চেনে মাসুরার বাবা হিসেবে।
রজব আলীর গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার কয়লা ইউনিয়নের আলাইপুর গ্রামে। তবে অল্প বয়সে সাতক্ষীরা শহরে এসে আর ফিরে যাননি। জীবন শুরু করেছিলেন খাবারের হোটেলে কাজ দিয়ে। পরে শহরের নানা জায়গায় চা–দোকান চালান। এখন পায়ে টানা ভ্যানে করে ফল-সবজি বিক্রি করেন। মাসুরারা তিন বোন। সবার বড় মাসুরা। মেজ মেয়ে সুরাইয়াকে বিয়ে দিয়েছেন। ছোট মেয়ে সুমাইয়া অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে।

মাসুরার মা ফাতেমা বেগম জানান, আজ (মঙ্গলবার) সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মুঠোফোনে কথা হয়েছে মাসুরার সঙ্গে। বলেছেন, কাল বুধবার ঢাকায় আসবেন। বাড়িতে কবে আসবেন, জানতে চাইলে বলেছেন, ছুটি পেলে। উত্তরে ফাতেমা বেগম বলেছেন, ‘কাল কেন, আজই দেশে চলে আয় তোরা। তোদের জন্য দেশের মানুষ সবাই অপেক্ষা করছে। আমি আর থাকতে পারছিনে।’
ক্যাডবেরি চকলেট আর নেপালি মেয়েদের ড্রেস আনতে বলেছে জানিয়ে ছোট বোন সুমাইয়া পারভিন (১৩) বলে, নেপালের দোকানপাট, বড় বড় ভবন—মুঠোফোনে সব দেখিয়েছে তাকে। মেজ বোন সুরাইয়া পারভিন (২০) বলেন, ‘আজ সকালে মার্কেটে যাওয়ার আগে জিজ্ঞাসা করছিল, “তোর জন্য কী কী আনব, খেলা দেখেছিস সবাই, বাবা কেমন আছে?” ওই সময় বাড়িতে না থাকায় বাবার সঙ্গে কথা বলতে পারেনি।’

এদিকে, যাঁর কাঁধে সওয়ার হয়ে দেশের মানুষের সাফ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্নটা বড় হয়েছিল, তিনি সাবিনা খাতুন। বাংলাদেশ নারী দলের অধিনায়ক সাবিনার নিজের শহর সাতক্ষীরার মানুষও অধীর অপেক্ষায় ক্ষণ গুনছেন, তাঁদের মেয়ে কখন ফিরবেন সাতক্ষীরায়। খেলা শেষ হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ আগে থেকেই শহরের সবুজবাগ এলাকায় সাবিনাদের বাড়িতে ভিড় জমতে শুরু করে। সাবিনার পরিবারকে অভিনন্দন জানান শহরের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। শিরোপা জেতায় আর মানুষের অভিনন্দনে আনন্দিত সাবিনার মা-বোনেরা। সাবিনার বড় বোন সালমা খাতুন খেলা শেষে বলেন, ‘সারা দেশের মানুষের মতো আমরাও উচ্ছ্বসিত। সবাই আসছে, অভিনন্দিত করছে। সাবিনার খোঁজখবর নিচ্ছে।’
বোন সালমা খাতুন জানান, সকালে কথা হয়েছে সাবিনার সঙ্গে। কথায় কথায় সাবিনা বলেছেন, বাবা বেঁচে থাকলে তিনি সবচেয়ে খুশি হতেন। এমন স্মরণীয় মুহূর্তে আকবর আলী স্যারের কথা খুব মনে পড়ছে তাঁর। স্যার আর বাবা বেঁচে থাকলে তাঁরা ভীষণ খুশি হতেন। সালমা খাতুন আরো বলেন, ‘আমাদের ছোটবেলাটা সংগ্রামের। বাবা ফেরিওয়ালা ছিলেন। তাঁর একার আয়ে সংসার চালানো খুব কষ্টের ছিল। বাবাও চাননি বোন ফুটবলে আসুক। সাবিনার সাবিনা হওয়াটা সব আকবর স্যারের অবদান। বোন এখন দেশ-বিদেশে খেলে। সব সময় গোল করে যাচ্ছে। এবারের টুর্নামেন্টে অনেক ভালো করছে। দুটি হ্যাটট্রিক করেছে। অবশ্য পুরো দলই ভালো খেলছে। সবকিছু মিলে খুবই গর্ব হচ্ছে ওর জন্য, ওদের জন্য।’ সাবিনার মা মমতাজ বেগম অস্থির হয়ে অপেক্ষায়, কখন বাড়িতে আসবেন সাবিনা। তাঁকে হাতে তুলে খাওয়াবেন।