Home সাহিত্য ও বিনোদন সাতক্ষীরায় ঐতিহ্যবাহী গুড় পুকুরের মেলার শুভ উদ্বোধন

সাতক্ষীরায় ঐতিহ্যবাহী গুড় পুকুরের মেলার শুভ উদ্বোধন

72

প্রতাপ কুমার হোড়,সাতক্ষীরা প্রতিনিধি : সাতক্ষীরায় ৪শ বছরের ঐতিহ্যবাহী গুড় পুকুরের মেলার উদ্বোধন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার আয়োজনে সাতক্ষীরা শহরের শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত থেকে ফিতা কেটে মাস ব্যাপি গুড় পুকুর মেলার উদ্বোধন করেন সাতক্ষীরা পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র কাজী ফিরোজ হাসান।

গুড় পুকুরের মেলা উদযাপন কমিটির চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মানিক সিকদারের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, সাতক্ষীরা পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাজিম উদ্দীন, প্যানেল মেয়র-২ শেখ আনোয়ার হোসেন মিলন, পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা লিয়াকত আলী, পৌর নির্বাহী প্রকৌশলী নাজমুল করিম, পৌর কাউন্সিলর শেখ শফিক উদ দৌলা সাগর, শেখ মারুফ আহম্মেদ, আইনুল ইসলাম নান্টা, মহিলা কাউন্সিলর নুর জাহান বেগম নুরী, অনিমা রাণী মন্ডল, পৌর সমাজ উন্নয়ন কর্মকর্তা মো. জিয়াউর রহমান, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য সচিব নাজমুল হক রনি, আওয়ামী লীগ নেতা আবু আব্দুল্লাহ ছাক্কার সহ আরো অনেকে।

কথিত আছে, জনৈক রাজকর্মচারী আজকের পলাশপোলের মনসাতলায় (বটবৃক্ষতলে) বিশ্রাম নিতে গিয়ে তন্দ্রাছন্ন হয়ে পড়েন। দিনটি ছিল বাংলা সনের ৩১ ভাদ্র। হঠাৎ তিনি জেগে দেখেন, একেবারে কাছেই একটি সাপ ফণা তুলে তাকে ছায়া দিচ্ছে যাতে ঘুমাতে পারেন। সেই থেকে তিনি ওই বটতলায় সাপের দেবী মনসার উদ্দেশ্যে পূজা শুরু করেন এবং অন্যদেরও মনসা পূজা করতে বলেন। এ পূজার প্রসাদ পুকুরে ফেলে দেয়ায় এর পানি মিষ্টি হয়ে যায়। এ কারণে ওই পুকুরের নাম হয়ে পড়ে গুড়পুকুর।

অন্যদিকে অন্যরা বলেন, পুকুরে বেশি দিন পানি থাকত না। পরে স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে স্থানীয়রা সেখানে ১০০ ভাড় গুড় ঢেলে দিলে পুকুরে পানি ওঠে, তাই এমন নামকরণ। আরেকটি মত হচ্ছে, গৌর বর্ণে ব্রাহ্মণরা পুকুরটির মালিক ছিলেন। এ থেকেই গৌরদের পুকুর। কালক্রমে বিবর্তনের ধারায় গুড়পুকুর। নামের প্রেক্ষাপট যা-ই হোক, পুকুরের নামেই মেলা হয়ে আসছে কয়েক শতাব্দী ধরে। সম্ভবত দ্বাদশ শতাব্দীর প্রথম দিক থেকে হয়ে আসছে মনসা ও বিশ্বকর্মা পূজাও। এলাকার অনেকেই বলেন, ওই দুই পূজাকে ঘিরেই মূলত গুড়পুকুর মেলা। সাতক্ষীরার সবচে বড় লোকজ উৎসব এটি।

আবহমানকাল ধরে চলে আসা এ মেলায় পসরা সাজাতে একসময় ঢাকা ও কলকাতার পাশাপাশি বিলেতি ব্যবসায়ীরাও সমবেত হতেন বলে কেউ কেউ জানান। মেলা ঘিরে একসময় উৎসবের আমেজ বয়ে যেত সাতক্ষীরায়। এ মেলা মূলত সনাতন ধর্মালম্বীদের দুটি পূজাকে কেন্দ্র করে হলেও সেটি এ জনপদের মানুষের কাছে অসাম্প্রদায়িতার সেতুবন্ধনে পরিণত হতো। তাছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখত সাতক্ষীরার গুড়পুকুর মেলা। কোটি কোটি টাকার কেনাবেচা হতো মেলায়। বিশেষ করে কাঠের তৈরি আসবাবপত্র, বেত ও বাঁশের পণ্যের পাশাপাশি সাতক্ষীরার বিভিন্ন ফলদ, ঔষধি ও কাঠজাতীয় গাছের চারার চাহিদা ছিল উল্লেখযোগ্য। মেলা শুরুর ১৫-২০ দিন আগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা বড় বড় লঞ্চ-স্টিমার ও অন্যান্য যানবাহন বোঝাই করে তাদের মালপত্র নিয়ে আসতেন। পলাশপোলের মনসাতলা থেকে শুরু হলেও সাতক্ষীরা শহরের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকায় মেলা বসত।
মেলায় যাত্রা, সার্কাস, পুতুলনাচ, নাগরদোলা ও জাদু খেলার আয়োজন থাকত খুবই জমজমাট। তাছাড়া সারি সারি ভ্রাম্যমাণ মিষ্টির দোকানে বিক্রি হতো রসমন্ডি, পানতোয়া ও ছানা-সন্দেশ। মেলায় আগত দর্শনার্থীরা অন্যান্য কেনাকাটা শেষে মিষ্টি না কিনলে যেন তাদের কেনাকাটায় অপূর্ণতা রয়ে যেত।

২০০২ সালে মেলা চলাকালে শহরের একটি সিনেমা হলে এবং সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠানরত সার্কাসের প্যান্ডেলে জঙ্গিরা বোমা হামলা চালায়। এরপর ছয় বছর বন্ধ থাকে মেলা। ২০০৯ সাল থেকে আবারো শুরু হয় সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ জনপদের মানুষের প্রাণের এ মেলা। কিন্তু আগের সেই লোক গিজগিজ সরগরম গুড়পুকুর মেলা যেন এখন অতীত। এখনো বাংলা সনের ৩১ ভাদ্র এলে স্থানীয় প্রশাসন ও পৌর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে মেলার উদ্বোধন করা হয়। তাও আবার একটি ছোট্ট পার্কের মধ্যে। অথচ এক দশক আগেও কমতি ছিল না মেলার আয়োজনে। জঙ্গি হামলা ও বেপরোয়া চাঁদাবাজির পরিণতিতে ঐতিহ্যবাহী মেলাটি আজ হারিয়ে যেতে বসেছে।

এবারের মেলায় থাকছে প্রায় ৩০০ টি মতো বিভিন্ন পণ্যের দোকান। এছাড়া রয়েছে নাগর দোলা, ঘোড়ার গাড়ি, লৌহজাতদ্রব্য, বাঁশ ও বেত পণ্যের দোকানসহ বিভিন্ন প্রকার মিষ্টির দোকান।

সাতক্ষীরা গুড় পুকুরের মেলা ২০ দিনের জন্য অনুমতি দিয়েছে প্রশাসন। প্রতি বছর ভাদ্র মাসের শেষ দিনে এই মেলা বসে। মেলায় দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসেছে। গ্রামীণ লোকজ ঐতিহ্যের পশরা সাজিয়ে চলে বেচাকেনা।