Home জাতীয় শিগগিরই বিদ্যুৎ ঘাটতি কাটছে না

শিগগিরই বিদ্যুৎ ঘাটতি কাটছে না

34

ডেস্ক রিপোর্ট: আগামী সেপ্টেম্বরের পর বিদ্যুৎ–ঘাটতি দূর হওয়ার আশা করছে সরকার। এ ক্ষেত্রে তিনটি কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র রামপাল, ভারতের আদানি ও পায়রা দ্বিতীয় ইউনিট থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।

তবে বিদ্যুৎ বিভাগ, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও সংশ্লিষ্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রামপাল ও ভারতের আদানি থেকে বিদ্যুৎ আসতে পারে আগামী বছরের শুরুতে। আর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি কয়েক মাস ধরে উৎপাদনে আছে। এ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ মূলত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যবহৃত হচ্ছে।

উচ্চপর্যায়ের দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, শীতের মৌসুমে অক্টোবর থেকে তাপমাত্রা কমতে শুরু করে। এ সময় বিদ্যুতের চাহিদা কমে যায় দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য তৈরি হলেও রামপাল এবং আদানির বিদ্যুৎ ওই সময় প্রয়োজন হবে না।

এর আগে ৭ জুলাই দেশের বিদ্যুৎ ও গ্যাস পরিস্থিতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত লোডশেডিং চলতে পারে।

তিনি আরও বলেছিলেন, ‘ওই সময়ের মধ্যে আদানি থেকে কয়লাভিত্তিক ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট এবং পায়রা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট থেকে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে। তখন লোডশেডিং কমে আসবে।’

তবে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে উপদেষ্টা একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা উল্লেখ করলেও গত শুক্রবার নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেওয়া এক পোস্টে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন, ‘আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিট ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হয়ে যাবে এবং একই সঙ্গে ভারতের আদানি পাওয়ার প্ল্যান্ট থেকে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু হলে চার হাজারের বেশি মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমাদের জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে।’

উৎপাদনে আছে পায়রার দুটি ইউনিট

উৎপাদনে আসা দেশের সবচেয়ে বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটির অবস্থান পটুয়াখালীর পায়রায়। ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি শুরু থেকে সঞ্চালন জটিলতায় পড়েছে। এ কেন্দ্রের ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম ইউনিট উৎপাদনে আসে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি।

আর দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদন শুরু করে একই বছরের ২৬ আগস্ট। তবে ঢাকার সঙ্গে সঞ্চালন লাইন তৈরি না হওয়ায় দ্বিতীয় ইউনিট অনেক দিন বন্ধ রাখা হয়। চুক্তি অনুযায়ী বিদ্যুৎ নিতে না পারায় টানা দেড় বছর ধরে জরিমানা দিতে হয়েছে পিডিবিকে। এরপর গত মার্চে বিকল্প উপায়ে দুটি ইউনিট চালু করেছে পায়রা বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ।

পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকানা সংস্থা বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি (বিসিপিসি) লিমিটেড সূত্র বলছে, বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্থায়নে একটি উপকেন্দ্র বসিয়ে পটুয়াখালী জেলায় ৯০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। এ ছাড়া বিকল্প সঞ্চালন লাইন ব্যবহার করে মার্চ থেকে খুলনা-যশোর এলাকায় এই কেন্দ্রের বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। চাহিদার ওপর নির্ভর করে দিনে ৯০০ থেকে ১ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে তারা।

আবার পেছাতে পারে রামপাল

বাগেরহাটের রামপালে ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনের পথে। এটি নির্মাণ করেছে বাংলাদেশ ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি।

২০১৬ সালের জুলাইয়ে এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গে চুক্তি করে পিডিবি। ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি ইউনিট বসেছে এখানে। এটি উৎপাদনে আসার সময় দফায় দফায় পেছানো হয়েছে। বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে আসার সংশোধিত সময় প্রথম ইউনিটের জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে আগামী ৩১ অক্টোবর এবং দ্বিতীয় ইউনিটের ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩।

তবে প্রকল্প সূত্র বলছে, এবার নির্ধারিত সময়েও উৎপাদনে আসার সম্ভাবনা কম। প্রথম ইউনিট নভেম্বরে উৎপাদনে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর দ্বিতীয় ইউনিটের উৎপাদনে আসার সময় পেছাতে ইতিমধ্যে পিডিবির সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে।
ডিসেম্বরের আগে আদানির বিদ্যুৎ নয়

ভারতের ঝাড়খন্ড প্রদেশের গোড্ডা জেলায় ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে আদানি পাওয়ার। আগামী ২৫ বছর এ কেন্দ্র থেকে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কিনে নেবে পিডিবি। সর্বশেষ জুন পর্যন্ত পিডিবির অগ্রগতি প্রতিবেদন বলছে, এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে ৭৪৮ মেগাওয়াট এবং আগামী বছরে আরও ৭৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আসার কথা রয়েছে।

তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আদানি এখন পর্যন্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রাথমিক পরীক্ষা করেনি। এর জন্য তারা বাংলাদেশ থেকে শিগগিরই কিছু বিদ্যুৎ নেবে। সব মিলে তাদের প্রথম ইউনিট চালু করতে আরও কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ আনার সঞ্চালন লাইনও ডিসেম্বরের আগে প্রস্তুত হবে না।

বিদ্যুৎ সরবরাহে তৈরি হয়নি সঞ্চালন লাইন

দেশের একমাত্র বিদ্যুৎ সঞ্চালন কোম্পানি পিজিসিবি সূত্র বলছে, বাগেরহাটের রামপাল ও পটুয়াখালীর পায়রা কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ঢাকায় বিদ্যুৎ আনার সঞ্চালন লাইন এখনো তৈরি হয়নি। ২০১৬ সালে নেওয়া হয় আমিনবাজার-মাওয়া-মোংলা ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন প্রকল্প। এ সঞ্চালন লাইনের দৈর্ঘ্য ১৬৪ দশমিক ৬ কিলোমিটার। এর মধ্যে পদ্মার অংশ হলো ৯ দশমিক ৪ কিলোমিটার। আর আমিনবাজারে ৪০০ কেভি সাবস্টেশন করা হচ্ছে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল। কয়েক দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বেড়েছে। আগামী বছরের জুনের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার কথা রয়েছে।

তবে ডিসেম্বরের মধ্যে ওই প্রকল্পের কাজ শেষ করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছে পিজিসিবি। প্রকল্প পরিচালকের কার্যালয় বলছে, মোংলা থেকে গোপালগঞ্জ পর্যন্ত কাজ শেষ হয়ে গেছে। মাওয়া থেকে আমিনবাজারের কাজও প্রায় শেষ। এ ছাড়া পায়রা থেকে আরেকটি সঞ্চালন লাইন এসে যুক্ত হয়েছে গোপালগঞ্জে। ঢাকায় আনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো পদ্মা। নদীর মধ্যে ৫টি টাওয়ারের কাজ শেষ হয়েছে। দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, প্রতিটি টাওয়ারে ২৫০ টন স্টিল লাগে। প্রমত্ত নদীতে বর্ষার সময় কাজ করা খুবই কঠিন। একটি টাওয়ার বসাতে অন্তত ৬০ দিন সময় লেগে যায়।

এ ছাড়া ভারতের আদানির কেন্দ্রের বিদ্যুৎ আনতে দিনাজপুরের রোহনপুর সীমান্ত এলাকা থেকে একটি সঞ্চালন লাইন আসছে বগুড়া পর্যন্ত। তিন মাস আগে লাইন টানার কাজ শেষ হয়েছে। তবে দুই পাশের উপকেন্দ্র এখনো তৈরি হয়নি। এটি নির্মাণ করছে চীনের ঠিকাদার সাংহাই ইলেকট্রিক কোম্পানি। দেশটিতে করোনা বিধিনিষেধের কারণে তাদের আসতে দেরি হয়। কাজ শেষ করতে ডিসেম্বর লেগে যেতে পারে।

এ বিষয়ে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, পায়রা ও রামপালের বিদ্যুৎ ঢাকায় আনার সঞ্চালন লাইন ডিসেম্বরে চালুর সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। আর আদানির বিদ্যুৎ বগুড়ায় এনে উত্তরবঙ্গে সরবরাহের লাইনটিও ডিসেম্বরে তৈরি হতে পারে।

ভরসার বৃষ্টি ও শীতের অপেক্ষা

গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় ৪ জুলাই সারা দেশে বড় ধরনের লোডশেডিং শুরু হয়। টানা চার দিন পর ঈদের ছুটি শুরু হলে কিছুটা স্বস্তি আসে। চাহিদা কমে যাওয়ায় বিদ্যুতের ঘাটতি কমতে থাকে।

এরপর বিদ্যুতের আবার চাহিদা বাড়তে থাকলে গত মঙ্গলবার এলাকাভিত্তিক এক ঘণ্টার লোডশেডিং শুরু করে বিদ্যুৎ বিভাগ। যদিও এটি মানা যায়নি। কোনো কোনো এলাকায় দিনে ছয় থেকে আট ঘণ্টার লোডশেডিং হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে জ্বালানির ব্যবহার কমাতে সব ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। কমানো হয়েছে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি।

কয়লার দামও বাড়ছে বিশ্ববাজারে। আপাতত লোডশেডিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। পরিকল্পিত লোডশেডিং এক ঘণ্টা থেকে বাড়িয়ে দুই ঘণ্টা করা হতে পারে। এর আগে শ্রাবণের বৃষ্টি বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমাতে পারে। আর শীত সামনে রেখে অক্টোবর থেকে তাপমাত্রা কমতে শুরু করলে স্বস্তি আসতে পারে।

এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শামসুল আলম বলেন, অক্টোবরের মধ্যে কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ বাড়ানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। তাপমাত্রা নিচের দিকে নামার পর চাহিদা কমলে লোডশেডিং থেকে মুক্তি আসতে পারে। তাই হয়তো শীতের ভরসায় আছে সরকার।
প্রথমআলো