এম এইচ নাহিদ \ ‘খেলা হবে’-প্রথম উচ্চারণ নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমানের মুখে। পশ্চিমবঙ্গ ঘুরে আবার এসেছে বাংলাদেশে। এদেশের ক্ষমতাসীন ও মাঠের বিরোধী দলের নেতাদের মুখে এখন একটাই শ্লোগান ‘খেলা হবে’। সে ‘খেলা’ নাকি আসছে ডিসেম্বরেই হবে। কেউ ক্ষমতা টিকে থাকতে খেলবে, আবার কেউ ক্ষমতা দখলের জন্য খেলবে। টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ এবং মাঠের বিরোধী দল বিএনপি মরণ কামড়ে নেমেছে। এর বাইরে থাকা অন্যান্য দল জোট ভাঙা-জোট গড়ার হিসাব মেলাতে ব্যস্ত। সাম্প্রতিককালে নিজেদেরকে বাম দাবিদার কিছু বামপন্থীদের কর্মকাণ্ডে হচ্ছে, তারাও এ খেলার অংশীদ্বার হতে চায়! সেটা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী অপশক্তি পুনরুত্থান হলেও! ফলে ডিসেম্বরকে টার্গেট করে ‘শব্দ যুদ্ধ’ চলছে অবিরাম। নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের সম্মেলনে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, “ডিসেম্বরে আসল খেলা হবে।” ঢাকার এক সমাবেশেও একই সুরে বলেন, “খেলা হবে। ডিসেম্বরে সমুদ্রের গর্জন শুনতে পাবেন।”

অন্যদিকে বিএনপি সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম বলছেন,“সরকারের পতন ছাড়া ঘরে ফিরে যাব না।” তিনি আরো বলেছেন, “তারেক রহমান- জোবায়দা রহমান ফিরবেন বিজয়ী বেশে।” শুধু তাই নয়, বিএনপি নেতারা বলেছেন, ‘১০ ডিসেম্বরের পরে দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়।’ তাদের এ কথার কড়া জবাব দিয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা ও ১৪ দলের সম্বয়ক আমির হোসেন আমু। যুব লীগের প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রবীণ এই নেতা বলেছেন,“ধাক্কা দিলেই সরকার পড়ে যাবে এমনটা যারা ভাবছেন, আজকের সমাবেশ দেখলে তাদের চোখ খুলে যাবে। এ সরকারকে ধাক্কা দিলেই পড়ে যাবে না। যেকোনো ষড়যন্ত্রের দাঁত ভাঙা জবাব দেওয়া হবে।”

এখন পর্যন্ত মাঠের পরিস্থিতি শান্ত আছে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাধারণ মানুষের ভাবনা, এভাবে ‘শব্দযুদ্ধ’ই চলবে নাকি তা সহিংসতায় রূপ নিবে! উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় দেশের মানুষ। ডিসেম্বরেই হেফাজতের মহাসমাবেশ এবং দাবি আদায়ে কর্মসূচী ঘোষণার ইঙ্গিত সেই উৎকণ্ঠা আরো বাড়াচ্ছে। পরিস্থিতির অবনতি হলে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবের শঙ্কাও দেখছেন কেউ কেউ! ফলে সারা দেশের মানুষের চোখ এখন ডিসেম্বরে।

২০২৪-এর জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন কমিশন সেই ইঙ্গিত’ই দিয়েছেন। নির্বাচনের এখনো ১৪ মাস দেরি থাকলেও প্রস্তুতি নিচ্ছেন সকল রাজনৈতিক দল। একদিকে যেমন জোট-ভোটের সমীকরণ মেলানোর প্রস্তুতি চলছে, তেমনি চলছে মাঠ গোছানোর প্রস্তুতি। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি-সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেই সরকারের অধীনে নির্বাচন ও দলের চেয়ারপার্সনের মুক্তি প্রভৃতি দাবিতে বিভাগীয় সমাবেশ করছে। সমাবেশগুলোতে জনস্রোত দেখে দলটি বেশ আশাবাদী। তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হলো দলকে সুসংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ রাখা, অহিংস গণআন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে জনআস্থা গড়ে তোলা, মানুষকে রাজপথে নামানো, বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা, আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায় এবং জামাত ইস্যুতে অবস্থান স্পষ্ট করা।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সামনে মহাচ্যালেঞ্জ হলো নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা, নির্বাচন সম্পর্কে জনমনে আস্থা তৈরী, প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভাবমূর্তি গড়ে তোলা, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট নিরসন, আন্তর্জাতিক চাপ সামলানো, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে আনা এবং বিরোধী দলের আন্দোলন মোকাবেলা করা।

উভয় দলই মাঠে নেমেছে শক্তির মহড়া দিতে। চলছে সভা-সম্মেলন, শো-ডাউন, পাল্টা শো-ডাউন। বিএনপি কর্মীদের চাঙ্গা করে রাজনীতির মাঠে থাকা এবং বিরোধী রাজনীতির বিশ্বাসযোগ্যতার পরীক্ষা দিয়ে ক্ষমতায় যেতে বিভাগীয় সমাবেশ করছে সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি সমাবেশ হয়েছে। আরো হবে। ১০ ডিসেম্বর ঢাকায় সমাবেশ করে পরবর্তী কর্মসূচী জানাবে।

বসে নেই আওয়ামী লীগও। কেন্দ্রীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে তারাও জেলা-উপজেলা সম্মেলনের মাধ্যমে জনসমাগমের মহড়া দিচ্ছে। ইতোমধ্যে দলের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তীকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে ব্যাপক শো-ডাউন করেছে। ডিসেম্বরে ছাত্র লীগের সম্মেলন এবং সে মাসেই তারা দলের জাতীয় সম্মেলন করবে। সব মিলিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও মাঠ দখলে রাখার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ফলে বিএনপি যে কোনো কর্মসূচি’ই এক তরফাভাবে ডিসেম্বরে পালন করতে পারবে না, এটি মোটামুটি নিশ্চিত। আবার বিএনপির বাইরেও কিছু কিছু রাজনৈতিক দল আগামী ডিসেম্বর মাসকে ঘিরে কর্মসূচির পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে হঠাৎ করেই হেফাজত আগামী ১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় মহাসমাবেশ ডেকেছে। তারা ২০১৩ সালের মামলা এবং আটক হেফাজত নেতাদের মুক্তির দাবিতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটি স্মারকলিপি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং এই স্মারকলিপির পরপরই তারা ঢাকায় মহাসমাবেশ করবে। ডিসেম্বর বিজয়ের মাস। সেদিক থেকে আওয়ামী লীগ সাংগঠনিক কর্মসূচীর বাইরেও বিজয়ের মাস উদযাপনে নানা কর্মসূচী গ্রহণ করবে। তাই ডিসেম্বর যতই এগিয়ে আসছে ততোই ভাবনা বাড়ছে। প্রশ্ন উঠছে, রাজনীতিবিদদের এখনকার ভাষার আক্রমণ ‘শব্দযুদ্ধে’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি তা শক্তির মহড়া প্রদর্শন করতে গিয়ে সহিংসতায় রূপ নিবে! আবার এ প্রশ্নও আসছে বিএনপি সত্যি সত্যি’ই খেলায় আসবে, নাকি অতীতের মতোই ফাঁকা আওয়াজ দিচ্ছে! কারণ এর আগে তারা অবরোধ কর্মসূচী, ঈদের পরে কঠোর আন্দোলনের ঘোষণা দিলেও তা আর করতে পারে নি। এছাড়া বিরোধী অন্যান্য দলেওর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ। সেক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির গন্তব্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জিএম কাদের এবং রওশন এরশাদের পথ এরইমধ্যে আলাদা হয়ে গেছে, আবার ঐক্যের সমঝোতাও চলছে। তারা ক্ষমতাসীন দলের সাথেই জোটে থাকবে, নাকি বিরোধী জোটে যাবে-তা কোনোভাবেই এখন বুঝার উপায় নেই। অন্যদিকে বিএনপি’র পরম বন্ধু জামাতের ভূমিকা নিয়ে দুই ধরনের আলোচনা রয়েছে। নিবন্ধন চাওয়া বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি-জামাতের ছায়া সংগঠন-এমন গুঞ্জনও চলছে। সব সমীকরণ মাথায় রেখেই ডিসেম্বরকে টার্গেট করছে বিএনপি।

স্বস্তির বিষয় হলো, পরিস্থিতি এখনো লাগামছাড়া হয়ে যায় নি। কেবল ‘শব্দ আক্রমণ’ চলছে। কিন্তু এভাবে চলতে চলতে মুখোমুখি হলে তা সংঘাতে রূপ নিবে! তেমনটাই হওয়ার আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

অন্যদিকে ভবিষ্যৎ রাজনীতির গতিপ্রকৃতির উপর নির্ভর করছে দেশের ভবিষ্যৎ। দেশ এখনই বেশ সংকটে। ডলারের সংকট, মূদ্রাস্ফীতি-মূল্যস্ফীতির সংকট, দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতি, লাগামহীন লোডশেডিং, জ্বালানি মূল্যে অস্থিরতা। সুখবর নেই বার্ষিক রিজার্ভে। সামনে বিশ্বমন্দার শঙ্কা। তার উপরে রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি বাড়ে তাহলে দেশ আরো ভয়াবহ সংকটে পড়বে। উৎপাদন ব্যহত হবে, পণ্যপরিবহণে সংকট সৃষ্টি হবে, জনজীবনে অস্থিরতা বাড়বে। সবমিলিয়ে সামনে এক কঠিন সময় আসছে! রাজনৈতিক দলগুলোর এখন পর্যন্ত কর্মসূচী ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা টিকে থাকার জন্য। জনজীবনের দুর্ভোগ লাঘব এবং তাদের জন্য স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে কেউ কোনো কর্মসূচী দিচ্ছে না। তাহলে প্রশ্ন উঠে এ খেলা কার জন্য! মনে রাখতে হবে রাজনীতির গতিপথ কখনো কখনো অর্থনীতি’ই ঠিক করে দেয়। সেই অর্থনীতিই যদি দুর্বল হয়ে যায় তাহলে রাজনীতির ভবিষ্যৎ কী হবে! এরকম একটি সংকটের মুখোমুখি অবস্থানে কতিপয় রাজনীতিবিদদের ‘শব্দযুদ্ধ’ ও রাজনীতি এখন পুরোমাত্রায় মাঠে গড়ানোর অপেক্ষায়।