ডেস্ক রিপোর্ট: প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রে সরকার গঠনের পর রোহিঙ্গা ইস্যুতে অগ্রগতির আশা করেছিল বাংলাদেশ। প্রত্যাশা ছিল, মানবাধিকারকে পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রে রাখার অঙ্গীকার করা বাইডেন সরকার রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরব হবে। কিন্তু ১০ দিনের মাথায় মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারকে উত্খাত করে ক্ষমতা গ্রহণ করে সামরিক বাহিনী। তখন থেকে যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টি শুধু রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা সংকট নয়, পুরো মিয়ানমারের দিকে। এ মাসের মাঝামাঝি যখন আফগানিস্তান আবার তালেবানের কবজায় গেল, তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রথম ভাবনা আফগানিস্তান থেকে বিদেশি এবং ঝুঁকিতে থাকা আফগানদের দ্রুত বের করে আনা।

সরকারি সূত্রগুলো বলছে, রোহিঙ্গা ইস্যু অনেক জটিল। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের ঢলের কারণেই শুধু এই সংকট তৈরি হয়নি, বরং এই সংকট কয়েক দশকের পুরনো। ওই বছরের ২৫ আগস্টের পর মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের যে ঢল শুরু হয়, তাতে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগই কক্সবাজারে চলে আসে। যুগ যুগ ধরে আশ্রয় দেওয়া বাংলাদেশ আবারও রোহিঙ্গাদের জন্য সীমান্ত খুলে দেয়। বিশ্বসম্প্রদায় বাংলাদেশের মহানুভবতার জোরালো প্রশংসা করলেও এই ইস্যুতে বাংলাদেশকে প্রত্যাশার চাপে রেখেছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের জন্য পশ্চিমা বিভিন্ন দেশসহ বন্ধু রাষ্ট্রগুলো মানবিক সহায়তা পাঠালেও গত চার বছরে সংকট সমাধান করতে পারেনি। চীনের মধ্যস্থতা, রোহিঙ্গাদের রাখাইন রাজ্যে ফেরার পরিবেশ সৃষ্টিতে ভারতের সহযোগিতা, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চাপ—কোনো কিছুই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করাতে পারেনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুকে বিশ্বের অগ্রাধিকার তালিকায় রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল বাংলাদেশের জন্য। একের পর এক নতুন নতুন ইস্যু আসছে। এর পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কাজ করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের মুখে চুনকালি পড়া থেকে রক্ষা করেছে। বাংলাদেশ লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে প্রাণে বাঁচিয়েছে। বাংলাদেশ আশ্রয় না দিলে এটি হতো সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে বড় বিপর্যয়।

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহবান জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হলে পুরো অঞ্চলে উগ্রবাদের বিস্তার ঘটতে পারে। এতে এ অঞ্চলে শান্তি, বিনিয়োগ, ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হতে পারে।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা কার্যত থমকে গেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে মিয়ানমারে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখলের পর এই ইস্যুতে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা হয়নি। চীনের মধ্যস্থতায় আলোচনার উদ্যোগেও এখন পর্যন্ত সাফল্য আসেনি। তবে জবাবদিহি ইস্যুতে অগ্রগতি আছে। আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতের (আইসিসি) কৌঁসুলির দপ্তর রোহিঙ্গাদের ওপর সংঘটিত নিপীড়ন অনুসন্ধান করছে। আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আইসিজে) মিয়ানমারে বিরুদ্ধে গাম্বিয়ার মামলা চলছে। পরিস্থিতির দিকে আইসিজের দৃষ্টি আছে। আর্জেন্টিনার একটি আদালত গত সপ্তাহে একজন রোহিঙ্গা নারীর সাক্ষ্য নিয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো রোহিঙ্গা নিপীড়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত মিয়ানমারের কয়েকজন সামরিক কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গা ঢলের সময় পাতের ভাতও খাইয়ে দিয়েছে কক্সবাজারের স্থানীয় লোকজন। মিয়ানমারের সেনাদের নির্যাতনের শিকার যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য মানবতার হাত বাড়িয়ে কক্সবাজারবাসী তথা গোটা দেশবাসী চোখের জল ফেলেছে, সেই রোহিঙ্গারাই এখন হয়ে পড়েছে ‘গলার কাঁটা’। রোহিঙ্গাদের হাতেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে স্থানীয় বাসিন্দারা। কক্সবাজারবাসী এখন রোহিঙ্গাদের ‘যেমন গিলতেও পারছে না আবার ফেলতেও পারছে না’ অবস্থায় আছে।
মাত্র চার বছরের মাথায় সেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর লোকজনই কথায় কথায় এখন স্থানীয় লোকজনের ওপর প্রতিনিয়ত হামলে পড়ছে। খুন-খারাবি করছে। অপহরণ করে রোহিঙ্গাদের মুক্তিপণ আদায় এখন কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফে নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। রোহিঙ্গারা স্থানীয় বাসিন্দাদের ঘরবাড়িতে চুরি-ডাকাতি করছে সমানে। শুধু রোহিঙ্গাপ্রবণ সীমান্ত এলাকা উখিয়া-টেকনাফ নয়, কক্সবাজার শহর থেকে শুরু করে দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও বান্দরবান জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে রোহিঙ্গারা। এসব রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী কায়দায় এলাকায় প্রভাব বিস্তার করে সরকারি জায়গা-জমি জবরদখল করে নিচ্ছে।

এত দিন স্থানীয় মানুষ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের অপেক্ষায় ছিল। কিন্তু সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের পক্ষে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে বাংলাদেশে রাখার প্রস্তাব দেওয়ার পর থেকেই তারা ক্ষুব্ধ। কক্সবাজারের মানুষ এখন রোহিঙ্গাদের শুধু প্রত্যাবাসনই নয়, তাদের (রোহিঙ্গা) প্রতিরোধের ডাক দিয়েছে। গত ২১ আগস্ট কক্সবাজার শহরে স্থানীয় বাসিন্দাদের এক সমাবেশে রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধে গঠিত হয়েছে ‘কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি’। ওই সমাবেশে কক্সবাজার পৌর এলাকার ১২টি ওয়ার্ডের প্রত্যেক সমাজ ও মহল্লা কমিটির নেতারা উপস্থিত ছিলেন। স্থানীয় বাসিন্দা মাহবুবুর রহমানকে সভাপতি ও হোসাইনুল ইসলাম বাহাদুরকে সম্পাদক করে গঠিত হয়েছে এ কমিটি। আজ বুধবার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চার বছর পূর্তিতে অবিলম্বে প্রত্যাবাসনের দাবি জানিয়ে এবং রোহিঙ্গাদের প্রতিরোধের ডাক দিয়ে অবস্থান কর্মসুচি দিয়েছে ওই কমিটি।

অবশ্য দিবসটি উপলক্ষে শিবিরের রোহিঙ্গাদের আনুষ্ঠানিক কোনো কর্মসূচি পালনের ঘোষণা নেই। তবে গোপনে শুধু আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারণার জন্য আকস্মিক রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর পক্ষে শোডাউন হতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা করছে।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির অন্যতম নেতা অ্যাডভোকেট তাপস রক্ষিত জানান, সীমান্তবর্তী উপজেলা উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা রোহিঙ্গাদের কারণে এখন রীতিমতো ঝুঁকির মুখেই বসবাস করছে। শিবিরগুলো এখন স্থানীয় লোকজনের জন্য অনিরাপদ।

শিবিরের ভেতরে জঙ্গি তৎপরতার খবরাখবরেও স্থানীয় লোকজন চরম উৎকণ্ঠায় রয়েছে। রোহিঙ্গা শিবির পরিস্থিতি নিয়ে এলাকায় দিন-দিন নানা সন্দেহ ও আতঙ্ক বাড়ছে। গত ১৮ আগস্ট রাতে শিবিরে তিনটি পিকআপ ভ্যান ঢোকার চেষ্টা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী প্রতিহত করে দিয়েছে। তবে পিকআপে কী ছিল তা নিয়ে কেউ মুখ খুলছে না।-আমাদের সময়.কম