Home মতামত রাষ্ট্রপতির অনুমতি ব্যতীত ড. ইউনূসের নোবেল প্রাইজ সংবিধানের লঙ্ঘন!

রাষ্ট্রপতির অনুমতি ব্যতীত ড. ইউনূসের নোবেল প্রাইজ সংবিধানের লঙ্ঘন!

36

সোহেল সানি:

বিদেশি খেতাব প্রভৃতি গ্রহণ, নিষিদ্ধকরণ সম্পর্কিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩০ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রপতির পূর্বানুমোদন ব্যতীত কোনো নাগরিক কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের নিকট হইতে কোনো উপাধি, সম্মান, পুরস্কার বা ভূষণ গ্রহণ করিবেন না।’

সংবিধানে এ শব্দাবলীর স্পষ্টত, নির্দেশনা হইতেছে, বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুমতি লইয়াই যে কোনো নাগরিককে বিদেশি রাষ্ট্রের উপাধি অথবা পুরস্কার গ্রহণ করিতে হইবে। বাংলাদেশের এ যাবৎকালের ইতিহাসে এ বিষয়ে কী সন্নিবেশিত হইয়াছে, কিংবা কী সংযোজন ঘটিয়াছে, তাহা আমার নখদর্পণে নেই। অবশ্য, আমার ক্ষুদ্রজ্ঞান ভাণ্ডারে সঞ্চিত তথ্য-উপাত্ত বলিতেছে, বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব বলিয়া খ্যাতিমান নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ও তার গ্রামীণ ব্যাংককে ২০০৬ সালের ১ অক্টোবর নরওয়ের নোবেল শান্তি কমিটি যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে মনোনিত করিলেও তাহা বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ড. ইয়াজউদ্দিন আহমেদকে অবগত করা হয়নি। অন্য লোক-সাধারণের মতনই মহামান্য, গণমাধ্যম হইতেই নোবেলজয়ের খবরখানা অবগত হইয়াছেন। পাঠকসমাজের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করিতে পারে যে, রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দীন প্রয়াত হইয়াছেন, সুতরাং আমার উত্থাপিত অভিযোগের বিষয়বস্থ প্রমাণ অযোগ্য। এই ছলাকলায় পাঠকসমাজকে করজোড় প্রার্থনা করিব, আপনারা আপনাদের দৃষ্টিভঙ্গী বঙ্গভবনের দিকেই ফিরাইতে পারেন। কেননা, রাষ্ট্রপতির সহিত সাক্ষাৎ প্রার্থী দেশি-বিদেশি সকল ব্যক্তিবিশেষের উপস্থিতিই বঙ্গভবনের নথিপত্রে অন্তর্ভুক্ত হইয়া যায়, এবং ইহা বঙ্গভবনের চিরাচরিত একটি প্রবেশমান রেওয়াজ। ১৩ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ১৯ কোটি ৭২ লাখ) লাভকারী ড. মুহাম্মদ ইউনূস, হয়তোবা তাহার নোবেল জয়কে ‘বিশ্বজয়’ মনে করিয়া বাংলাদেশের সংবিধানে আরোপিত নাগরিক দায়িত্ব কর্তব্যের বিধিনিষেধকে হয় ভূলিয়া গিয়াছিলেন, নয় ‘গুরুত্বহীন বস্থ’ বলিয়া একে মস্তিষ্কেই প্রবেশাধিকার দেন নাই। এটাই তাহার বেলায় স্বাভাবিক হইতে পারে, কেননা নরওয়ের রাজধানী অসলোর সিটি হলে বিশ্ববরেণ্য বিদগ্ধজন এবং বহু রাষ্ট্রপ্রধানের সুরভিত উপস্থিতির রাজকীয় বর্ণাঢ্যের অভিজাত মিলনমেলা বলিয়া কথা। আলফ্রেড নোবেলের মহাপ্রয়াণ দিবসে অর্থাৎ ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ ডিসেম্বর ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কারটি দুই হস্তে কব্জা করিয়া অভিষিক্ত হইবার মুহূর্তে স্বদেশের মাটি ও মানুষের কথা ভূলিয়া যাইতেই পারেন। সাধারণের অজানা থাকিতে পারে, কিন্তু সংশ্লিষ্ট সুশীলরা অবশ্যই জানিয়া থাকিবেন, নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হইবার পূর্বে মনোনীত হইতে হয়। এজন্য অনেকে মনোনীত হইয়াও তাহা অধিকার করিতে পারেন নাই। এরকম ঘটনার উদহারণ দেওয়ার পূর্বে ড. ইউনূস প্রসঙ্গেই বলিয়া নেই। তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারে মনোনীত হইয়াছিলেন, ৩ ডিসেম্বর আর পুরস্কারটি তাহার হস্তে তুলিয়া দেওয়া হয়, ১০ ডিসেম্বর, সেই হিসাবে পুরো সপ্তাহখানেক পরে। প্রসঙ্গক্রমে বলিয়া ফেলি, অহিংসবাদের প্রবক্তা মহাত্মা গান্ধীও নোবেল শান্তি পুরস্কারে মনোনীত হইয়াছিলেন কিন্তু পুরস্কারের ভূষণ গায়ে জড়াইয়া বিশ্ববাসীর অভিনন্দন কুড়াইবার পূর্বেই মুসলিম বিদ্বেষী চরমপন্থি নথুরাম গডসে তাহার প্রাণ কাড়িয়া লয়। নোবেল উইলপত্র-এ ‘মরণোত্তর’ পুরস্কারদানের বিধি আরোপিত না হইবার কারণে মহাত্মা গান্ধীকে মনোনীত হওয়ার আনন্দ লইয়াই ঈশ্বরের কৃপায় অগ্নিকুণ্ডে জ্বলিয়া অমরত্ব লাভ করিতে হইয়াছে। ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে শান্তিতে কাউকেই নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় নাই, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ওরফে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী রবীন্দ্রনাথের উপাধিসিক্ত ‘মহাত্মা’র প্রতি শ্রদ্ধাবনত: এক বাণী প্রচার করিয়া।

রাষ্ট্রপতির সহিত সাক্ষাৎ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে ড. ইউনূসের সম্মুখে সময়ের কোনোপ্রকার অভাব ছিলো না। তিনি চাহিলেই নোবেল পুরস্কারে মনোনীত বা ভূষিত হইবার বিষয়টি স্বদেশের রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করিতে পারিতেন। পুরস্কারটি বিদেশের হইলেও নাগরিক হিসাবে স্বদেশকে উপেক্ষা করিবার কী কারণ থাকিতে পারে তাহা আমার বোধগম্য নহে। বরং এমন একটি বিশ্বজয়ের পুরস্কার, স্বদেশের মানুষকেই তো উৎসর্গ করিবার কথা। আর সেটাকেই তো মনে করা হইয়া থাকে, স্বদেশপ্রেম- দেশাত্মবোধ। যে দেশাত্মবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটাইয়াছেন রবীন্দ্রনাথ তাহার ‘স্বদেশ’ কবিতাখানায়। ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’ সে তো ‘স্বদেশ’ কবিতাখানার অন্তরেরই আদূরে পঙ্ক্তিমালা। যাহা লিখিয়াছেন, ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে, লর্ড কার্জনের প্রস্তাবে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ‘বঙ্গভঙ্গ’ আইন পাস করিয়া বঙ্গমাতার অঙ্গচ্ছেদ ঘটাইলে। গান্ধীর স্বদেশী আন্দোলনের মহীরুহ হইয়া উঠিয়াছিলেন, রবীন্দ্রনাথ। ‘আমি কান পেতে শুনি বাংলাদেশের হৃদয় হতে যখন আপনি… রচনাকালও স্বদেশী আন্দোলনকালীন। বঙ্গদেশের শাসক শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ‘বঙ্গ’-কে ‘বাংলা’ নামে রূপান্তর করিয়া প্রকারান্তরে বাংলা ভাষাকেও সুষমামণ্ডিত করিয়াছিলেন। বিবিসি বাংলা জরিপে ইলিয়াস শাহের নামখানা উচ্চারিত না হইলেও তিনি সেইকালে ‘শাহ বাঙালিয়ান’ উপাধিতেই ভূষিত হইয়াছিলেন। ইলিয়াস শাহের সেই বাংলা প্রদেশকে যিনি প্রথম ‘বাংলাদেশ’ নামে ডাকতে বাঙালির হৃদয়ে সঙ্গীতের সুর তুলিয়া দিয়াছেন, তিনি রবীন্দ্রনাথ। ১৯০৫ সালের ২৩ অক্টোবর ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি- তুমি এই অপরূপে বাহির হলে জননী।’ সঙ্গীতখানা রচনার আট বৎসরের মাথায় তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাইয়া বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে পরিচয় করাইয়া দেন। আর তিনিও হইয়া উঠিলেন বিশ্বকবি। বিশ্বকবির সেই হৃদয়ের সুরকে আরো শ্রুতিমধুর করিয়া তুলিয়াছেন, কবি নজরুল ইসলাম ‘বাংলাদেশ’ নামক প্রবন্ধখানা রচনা করিয়া।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রবীন্দ্র-নজরুলকে একীভূত করিয়া রাখিয়াছেন, স্বদেশের নাম বাংলাদেশ নামকরণ করিয়া, স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মা করিয়া। নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বই বটে, কিন্তু আজঅবধি তাহারে দেখিতে পাইলাম না, কোনো বীরোচিতবেশে।

জাতীয় কবির রণসঙ্গীতের ধ্বনিতে- তালে তালে হাঁটিবার কোন সামরিক কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠানে আর লালসবুজের জাতীয় পতাকা হাতে, জাতীয় সঙ্গীতের কণ্ঠধ্বনিতে! দেখিলাম না, ভাষা-শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনারের প্রভাতফেরিতে, কণ্ঠে তুলিতে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরীর ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভূলিতে পারি’- এই অমর ভাষাসঙ্গীতখানা!

রবীন্দ্রনাথ ‘আমার সোনার বাংলা’ ও ‘বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ এ দুইখানা সঙ্গীত রচনার ১৫ বৎসর পর শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। নজরুলের রণসঙ্গীতখানা ১৯২৯ খ্রিষ্টাব্দে রচিত ও সুরারোপিত সন্ধ্যা কাব্যগ্রস্থের অন্তর্গত একটি সঙ্গীত।

আর আমার সোনার বাংলা ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউনহলে পরিবেশিত হয় বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে। বিবিসি জরিপে সেরা বিশটি বাংলা গানের মধ্যে এটা প্রথম স্থান দখল করে। ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে স্থান দিয়াছেন শহীদ বুদ্ধিজীবী জহির রায়হান। ২০০৮ সালের বেইজিং অলিম্পিকে অংশগ্রহণকারী ২০৫টি দেশের জাতীয় সঙ্গীতের বিচারে দৈনিক গার্ডিয়ানের জরিপে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়া লয়। উরুগুয়ের জাতীয় সঙ্গীতখানা হইয়াছিল প্রথম। রবীন্দ্র-নজরুলের সেই ‘বাংলাদেশ’কে যিনি রক্তের আক্ষরে স্বাধীনতার মানচিত্রে আঁকিয়া দিয়াছেন, সেই বঙ্গবন্ধুর প্রতি নোবেল জয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিংবা কোন দিবসে ড. ইউনূস, কখনো- কোনোদিন ন্যূনতম শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিয়াছেন, এমন দৃশ্যের অবতারণ ঘটিয়াছে বলিয়া আমার জানা নাই। জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাইতে কিংবা তাহার হত্যাকাণ্ডে শোকার্ত হইতে যে ব্যক্তির হৃদয় সায় দেয় নাই, সেই ব্যক্তি নোবেল প্রাইজ পাইতে পারেন, ইহা বৈদেশিক বিষয়, কিন্তু তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা পদক লাভের অধিকারী হইতে পারেন না। কিন্তু ইহাও সম্ভব হইয়াছে।

সর্বদলীয় সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দ। ওই বৎসর ড. ইউনূস সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের বন্দনা করিয়া ‘স্বাধীনতা পদক’ হাতাইয়া লইলেন। যে বৎসর বিদ্রোহী যুবক নূর হোসেন সদম্ভে বুকে-পিঠে ‘গণতন্ত্র মুক্তিপাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক’ লিখিয়া পুলিশের গুলিকে আলিঙ্গন করিলেন। এরশাদের কাছ থেকে গ্রামীণ ব্যাংক করাইয়া নেওয়া ড. ইউনূস ১৯৭৮ সালে আরেক সামরিক শাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের কাছ হইতে ‘রাষ্ট্রপতি পদক’ অধিকার করিয়া লন।

ইউনূস সেন্টার সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭৮ সাল হইতে অদ্যাবধি ড. ইউনূস প্রায় ১৪৫টি পুরস্কার অর্জন করিয়াছেন। সর্বশেষ পাইয়াছেন জাতিসংঘ ফাউন্ডেশনের ‘চ্যাম্পিয়ন অব গ্লোবাল চেঞ্জ’ পুরস্কার। গত ৯ই ডিসেম্বর নিউ ইয়র্কে অনুষ্ঠিত ‘উই দ্য পিপলস’ অনুষ্ঠানে ড. ইউনূসকে এই সম্মাননা প্রদান করা হইয়াছে। পূর্বেই বলিয়াছি, নোবেল বিজয়ী দুই হস্তে কব্জা করিবার পরও বাংলাদেশের মহামান্যের সান্নিধ্য লইতে বঙ্গভবনে ছুটিয়া যান নাই। হয়তোবা অসীম ভাবমূর্তিতে উচ্ছ্বসিত হইয়া মনস্তাত্ত্বিকভাবে এমন আকাশসম অবস্থানে অবতরণ করিয়া ফেলিয়াছেন যে, তাহার কাম্য হইয়া উঠিয়াছিলো- তিনি কেনো মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ছুটিয়া যাইবেন? বরং স্বয়ং রাষ্ট্রপতিই তো তাহার স্বদেশে ফিরিবার খবর পাইয়া বিমানবন্দরে পৌঁছাইয়া যাইবেন এবং রাষ্ট্র তাহার সম্মানে বিছাইয়া রাখিবে বিমানবন্দর হইতে বঙ্গভবন পর্যন্ত লালগালিচা। যাহার উপর পা রাখিতেই বর্ষিত হইতে থাকিবে ফুলবৃষ্টি। বঙ্গভবনের গালিচায় কেবল নহে, গোটা রাজধানীর পুষ্পকাননে ফোটা সকল রংবেরঙের প্রজাতির ফুল তাহাকে শুভেচ্ছায় সুসিক্ত করিবে। কিন্তু বাস্তবে তাহা হয় নাই। হয়তো এই অপ্রাপ্তি হইতেই তাহার মাঝে রাজনীতিতে প্রবেশের ইচ্ছা অঙ্কুরিত হইতে দেখিয়াছি ওয়ান-ইলেভেনের সময় ইয়াজউদ্দিন-ফখরুদ্দিন-মঈনুদ্দিনের মাথার উপরে ভর করিয়া।

নোবেল পুরস্কার পৃথিবীর সবচেয়ে গৌরবসূচক ও সম্মানজনক পুরস্কার। ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দ হইতে দেওয়া অর্থাৎ প্রায় ৯৫ বছরের মধ্যে এ পর্যন্ত তিনজন বাঙালিকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করিয়াছে সুইডিশ একাডেমি। এর সূচনা হইয়াছিল কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গীতাঞ্জলি’ কাব্যের মাধ্যমে ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাইয়াছেন অমর্ত্য সেন এবং ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করিয়াছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

তন্মধ্যে ড. ইউনূস একটু ব্যতিক্রম। নোবেল পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে শুধু নহে, ড. ইউনূসের মার্কিন ক্ষমতার মূলে যে বিল ক্লিনটন ও হিলারি, সেই তাদের লইয়াই একটা কথা বলি। আশা করি সকলেরই মনে রহিয়াছে, শেখ হাসিনার ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদের শাসনামলে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বাংলাদেশ সফরে আসিয়াছিলেন। তিনি নিশ্চয়ই জানিতেন যে, ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রশ্নে পূর্বসূরি প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের ভূমিকার কথা। তাহার এটাও অজানা থাকিবার কথা নেহে যে, বাঙালি নিধনকল্পে মার্কিন সপ্তম নৌবহর আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়া বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত পৌঁছাইয়াছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের অষ্টম নৌবহরের হুমকিতে পশ্চাদপসারণ ঘটিয়াছিল। (পরবর্তীতে সেই মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনকেই মার্কিন আদালত আড়ি পাতা আইনে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করিয়াছিল) যাহাই ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে ঘটুক না কেনো, ১৯৯৯ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন যখন বাংলাদেশ সফরে আসিলেন, তখন তাহাকেও ছুটিয়া যাইতে হইয়াছিলো সাভার স্মৃতিসৌধে। স্বাধীনতার বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করিতে। কিন্তু নোবেল বিজয়ের পর ড. ইউনূস ছুটিয়া গেলেন না স্মৃতিসৌধে- শহীদদের শ্রদ্ধা জানাইতে! ১৯৮৭ খ্রিষ্টাব্দে রাষ্ট্রপতি এরশাদ কর্তৃক এরশাদ স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হইবার পরও কোনোদিন স্মৃতিসৌধে গিয়াছেন এমন তথ্য কেহ দিতে পারিবেন না। কী বলিব ড. ইউনূস মুক্তিযুদ্ধকালে দেশেই ছিলেন না। আর যিনি স্বাধীনতা পদক দিয়াছেন, সেই এরশাদও মুক্তিযুদ্ধকালীন ছিলেন ভূমিকাহীন। তবে মৃত্যুর আগে অনুতাপ করিয়া গেছেন। জাতীয় সংসদে দাঁড়াইয়া বলিয়া গিয়াছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আমি সেনাপ্রধান হতে পারতাম না, রাষ্ট্রপতি হতে পারতাম না, আমার দুঃখ নিয়ে মরতে হবে, আমারই কিছু লোকের বিরোধিতার কারণে আমি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ঘোষণা করতে পারিনি।’

কিন্তু এ সকল আচার-ব্যবহারে কোনোপ্রকার ফল লাভের কিছু নাই। এই সামরিক শাসক এরশাদই পূর্বসূরি সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনূসরণ করিয়া ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে স্বাধীনতাবিরোধী শর্ষীনার পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেন। জেনারেল জিয়া ওই স্বাধীনতাবিরোধী আবু সালেহকে স্বাধীনতা পদক দেন ১৯৮০ খ্রিষ্টাব্দে। ‘স্বাধীনতা পদক’ পাওয়া সেই শর্ষিনার পীর সমাজ ও শিক্ষায় কী সাংঘাতিক অবদান রাখিয়া ছিলেন, সেটা একটু বলছি। একাত্তরের নরঘাতক টিক্কা খানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করিয়া তার মাদ্রাসার সকল ছাত্রকে রাজাকার বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করিয়া দিয়াছিলেন। একাত্তরের ১২ নভেম্বর পাঁচ শতাধিক রাজাকারসহ শর্ষিনার পীর সালেহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে প্রাণ ভিক্ষা চাহিয়াছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে ২৫৬ পৃষ্ঠার পীর ও মওলানাদের সম্পর্কে লিখিতে গিয়া বলিয়াছেন, পূর্ব বাংলার বিখ্যাত আলেম মওলানা শামসুল হক সাহেব আমার ইউনিয়নে জন্মগ্রহণ করেছেন। আমার ধারণা ছিলো তিনি ইলেকশনে আমার বিরুদ্ধে যাবেন না। কিন্তু তিনি মুসলিম লীগে যোগ দান করলেন। জনসাধারণ তাকে খুবই ভক্তি করতো। কিন্তু স্পিডবোট নিয়ে ঘুরতে শুরু করলেন এবং এক ধর্মসভা ডেকে ফতোয়া দিলেন, আমাকে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না। ধর্ম শেষ হয়ে যাবে। শর্ষিনার পীর সাহেব… বরগুনার পীর সাহেব, শিবপুরের পীর সাহেব, রহমতপুরের শাহ সাহেব আমার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিয়া বলিলেন, আমাকে যে ভোট দিলে ইসলাম থাকবে না, ধর্ম শেষ হয়ে যাবে। শর্ষীনার পীর স্বাধীনতা পদক পাওয়ার পর স্মৃতিসৌধে যেমন শহীদদের শ্রদ্ধা জানাইতে যান নাই, ঠিক তেমনি ড. ইউনূসও যান নাই। তবে যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসিতে ঝুলে মৃত্যু হওয়া জামায়াতের আমীর মতিউর রহমান নিজামী ও সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোজাহিদ মন্ত্রী হিসাবে শপথগ্রহণ করিবার পর গাড়িতে জাতীয় পতাকা উড়াইয়া স্মৃতিসৌধে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করিয়াছিলেন।

প্রতিপক্ষ পাকিস্তানের কোনো রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান যখন বাংলাদেশে আসিয়াছেন, তাহারা স্বাধীনতার শহীদদের স্মরণ করিতে স্মৃতিসৌধে ছুটিয়া গিয়াছেন। এটাই রাষ্ট্রীয় শিষ্টাচার কিংবা কূটনৈতিক সংস্কৃতি। ব্যতিক্রম শুধু ড. ইউনূস। তিনি নিজেকে কখনো বাঙালি বলিয়া অভিষিক্ত করিয়াছেন কি না, তাহা অবগত হইতে পারি নাই। বরং বহু তথ্যউপাত্ত ঘাটাঘাটি করিয়া ক্লান্ত শ্রান্ত হইয়া পড়িয়াছি। আজব এক মানুষ তিনি। মাতৃগর্ভ হইতে তিনি তো মাতৃভূমিতেই ভূমিষ্ট হইয়াছেন- কোনো বিদেশি রাষ্ট্রের মাটিতে নহে। প্রথম ‘মা’ বলেই কণ্ঠে স্বর তুলিয়াছেন। কিন্তু সেই মায়ের ভাষার জন্য যাহারা জীবন দিয়াছেন, তাহাদের কী কখনোই শ্রদ্ধা কিংবা স্মরণ করিয়াছেন? বাংলা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা। এ তো এক সুমহান মর্যাদা। কিন্তু ড. ইউনূস শহীদ মিনার চত্বরে গিয়াছেন কী?

২০০৭ সালে বাংলাদেশে ওয়ান ইলেভেন সংঘটিত করিয়াছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ। তিনি রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে হটানোর প্রধান উপদেষ্টা পদে ড. ইউনূসকেই বসাইতে চাহিয়াছিলেন। কিন্তু তাহা নাকচ করিয়া দিয়াছিলেন ড. ইউনূসই। রাজনৈতিক দল গঠনের অভিলাষ ব্যক্ত করিয়াছিলেন। কিন্তু ব্যর্থতায় পর্যদস্থ হইয়া পড়েন। সাম্প্রতিক চারদিকের রটনা-রচনা, রাষ্ট্রপতি বা প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসিবার জন্য তিনি মার্কিন মুল্লুক চষে বেড়িয়েছেন। কিন্তু তাহার বিরুদ্ধে মামলার ছড়াছড়ি। বিচার চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা ও তাহার পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন ড. ইউনূসের বিচার স্থগিতকরণের দাবি জানান। এমনকি নোবেল বিজয়ীরা সেই দাবির দাবিদার। কী অদ্ভুত বিশ্বের শক্তিধর রাষ্ট্রের গণতন্ত্র!

জন মার্শাল যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিমকোর্টের প্রথম প্রধানমন্ত্রী বিচারপতি। মানুষের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে একটি মামলায় তাহার একটি অবিস্মরণীয় উক্তি প্রণিধানযোগ্য। অধিকারের অর্থ এই নয় যে, একজন অধিকার প্রয়োগ করবেন, আরেকজন অধিকার হরণ করবে। অর্থাৎ ‘যে কোনো ব্যক্তি প্রতিপক্ষের উপরে অধিকার প্রয়োগের পূর্বে যেনো শতবার ভেবে নেন, তার অধিকার যেনো হরণ না হয়ে যায়।’

জন মার্শালের দেশের সহিত বাংলাদেশের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের পথে ড. ইউনূসকে বড় কাঁটা মনে করা হইতে ছিলো। কিন্তু এক সেলফিকলা উদ্ভাবনের মাধ্যমে মনে করা হইতেছে যে, বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন মুল্লুকের হুঁশ ফিরিয়া আসিয়াছে। জাতির মনও প্রফুল্ল হইয়া উঠিয়াছে। অপসারণ ঘটিয়াছে মনটার উপর জগদ্দল পাথর হইয়া চাপিয়া থাকা আতঙ্ক-আশঙ্কা। ইহাতে মস্তিষ্কের কোষগুলোতে রক্ত পরিসঞ্চালন শুরু হইয়াছে। কারণ বাঙালিরা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র ভীতসন্ত্রস্ত হইয়া অগ্রসরমান অভিযাত্রায় বারবার হোঁচট খাইয়া আসিতেছে। সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় সেইসকল চক্রান্ত বাঙালিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধিয়া রাখিয়াছে, যুগের পর যুগ। মার্কিন প্রেসিডেন্টের সুমতিতে সেইসকল অনিষ্টের অপসারণ ঘটাইয়া গেলো। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক সৌহার্দ্যের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করিয়া দিয়াছে। জো বাইডেনের ‘সেলফি’ তো নহে এ যেন দ্বিপক্ষীয় সাংস্কৃতিক সম্প্রীতির যে শিল্পকলা, ঠিক তাহারই ন্যায় এটিও এক ‘সেলফিকল’। জো বাইডেন তাহার মুখাবয়বে যে হাসির ফল্গুধারা ছড়াইয়া দিয়াছ, তাহার মাঝেই অন্তর্নিহিত রহিয়াছে বাংলাদেশের জন্য এক সমীহবার্তা। যাহা নির্বাচনমুখী গণমানুষের মাঝে প্রবল আশার সঞ্চার করাইয়া দিয়াছে। সেলফিখানা নিছক মামুলি বিষয় নহে। ইহা কেবলই আমেরিকার দৃষ্টিগোচরিত এক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছায়া। বিলম্বে হইলেও বাইডেনের মনোজগতে উপলব্ধ হইয়াছে যে, ‘শেখ হাসিনার মতন করিয়া বাংলাদেশটাকে কেহই ভালোবাসিতে পারিতেছে না। সুতরাং, শেখ হাসিনাই তাহার অবশিষ্ট লক্ষ্য পূরণের পথে হাঁটুক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হইতে বিশ্ব গণমাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্টের এই অভিনব ‘সেলফিকলা’ বাংলাদেশের রাজনীতির ওপর বিরাট ইতিবাচক প্রভাব পড়িয়াছে। দেশবিদেশের গণমাধ্যমেও এটি একখানা বিরাট সমাচার এখন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হাতের মুঠোয় লইয়া এতদিনকার যে বিএনপি ঘরনার রাজনীতিতে সরীসৃপের ফোঁসফোঁস শব্দ আনাচে-কানাচেতে শোনা যাইতো, সেই তাহাদেরও সেলফি কান্ড রাশ টানিয়া ধরিয়াছে। বাইডেন খুব করেই যেন কথিত মিত্রদের তাজ্জবনে পাঠাইয়া দিয়া, তাহাদের কর্ণগহীনে নির্বাচনি বার্তাটাই ঢুকাইয়া দিয়াছেন। আর নহে অগ্নিসন্ত্রাসে সাধারণ নরনারী হত্যা, আর নহে সংখ্যালঘু ধর্ষণ, আর নহে রাজনৈতিক হত্যা। সর্বোপরি কোনোভাবেই আর নহে ‘পনেরো আগস্টে’র পুনরাবৃত্তি। নহে কোন আর কোন ‘একুশে আগস্ট’।

আসন্ন নির্বাচনের পূর্বে ইহা শেখ হাসিনার পক্ষে শক্তি সঞ্চারিত একটি অমোঘ মন্ত্র। উন্নয়নের মহাসড়কে প্রদীপ্তি না নিভাইয়া সৌহার্দ্যরে সৌন্দর্যেই শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ানোর কথাও উচ্চারিত হয়েছে ওই একঝলক কথোপকথনেই।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের এই সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যমূলক আচরণের মূলে অগ্নিমন্ত্রের কাজ হইয়াছে ভারতীয় ক্ষমতাসীন দল বিজিপির বাংলাদেশের পক্ষে বাইডেন প্রশাসনকে দেওয়া সাম্প্রতিক চিঠি। মার্কিন প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশ তথা শেখ হাসিনা প্রশ্নে ভারত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভূমিকা তো রহিয়াছেই। উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক এতটাই ফলপ্রসূ হইয়াছে যে, তাহা দুই প্রধানমন্ত্রীর চেহারা-সুরাতেই প্রোজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছে।

এটা না বুঝিবার আর কারণ নাই যে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রকারান্তরে ভারত সরকারের মতন মার্কিন প্রশাসনেরও শেখ হাসিনার পক্ষে চূড়ান্ত অবস্থানের এক কূটনৈতিক বার্তা।

বাংলাদেশ প্রশ্নে তথা শেখ হাসিনার বিষয়ে ঘূর্ণায়মান সংশয় ও সন্দেহের অবসান প্রশ্নে দ্বিপক্ষীয় আপস-মীমাংসা সেলফির মাঝেই নিহিত। সর্বোপরি বাংলাদেশের মানুষের রুদ্ধশ্বাসের আনুষ্ঠানিক অবসানের অবিশ্বাস্য কার্যকরণ হইল বাইডেনের এই সেলফিকলা। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই পরিস্থিতি প্রত্যক্ষ করছেন কীভাবে, তাহা তিনিই কেবল জানেন। বাংলাদেশ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বের সূত্রধর তো তিনি। বিশ্বময় অবিস্মরণীয় বিচরণ তার। তার সুবিশাল ভাবমূর্তি ফুটিয়া উঠিয়াছে দেড় শতাধিক বিশ্ব ব্যক্তিত্বের শিশুতোষ আবদারে। আসলে বৃদ্ধ হইয়া গেলে নাকি মানুষ শিশু মনোবৃত্তিতে প্রত্যাবর্তন করিয়া বসে। বিবেক-বুদ্ধি, বিবেচনা, শিক্ষা লোপ পাইয়া যায়। তাহারা শিশুর মতো অবুঝ হইয়া পড়িয়াছেন কি না, জানা নাই। কিন্তু শিশুর মতোই তাহাদের দাবি। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্রে। ইহার সংবিধান রহিয়াছে, আইন রহিয়াছে। কার্যবিধি রহিয়াছে। কেহ অপরাধ কর্ম সংঘটিত করিলে প্রচলিত আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারে সোপর্দ হইবেন। এটাই স্বাভাবিক। অপরাধী কি না, তাহার ফয়সালা হইবে নিজস্ব গতিতে চলয়মান বিচারিক আদালতে। কিন্তু বহু নোবেল বিজয়ী বন্ধু সাজিয়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মামলা স্থগিত করিবার জন্য বাংলাদেশের উপর চাপ সৃষ্টি করিবার দৃষ্টান্ত স্থাপন করিয়াছেন। তাহারা একটিবারও ভাবিয়া দেখিলেন না যে, এইটা নেহাৎ নীতিবিরুদ্ধ কাজ। একটি ভিন দেশের প্রশ্নে নীতিবিগর্হিত আচরণ। একটি রাষ্ট্রের উপর সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের নামান্তর। ঔদ্ধত্যমূলক অসংবেদনশীল হস্তক্ষেপ বটে। না জানিয়া, না বুঝিয়া স্রেফ ব্যক্তিপ্রেমে সমষ্টির সর্বনাশ করিবার উদভ্রান্ত নীতি তো মধ্যযুগীয় বর্বরতা। বাংলাদেশের বিচারিক আদালত ইউনূসের মামলা স্থগিতাদেশের দাবির প্রতি শুনানি করিতে গিয়া বিব্রতবোধ করিবেন কি না জানি না, তবে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের বিচারিক আদালত এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হইলে সমুচিত প্রতিত্তোর তাহারা পাইতেন। সাম্প্রতিক ড. ইউনূসের মামলা-মোকদ্দমার আইনি ভিত্তিমূল নিয়া বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠায় অনেক দিন পর সংবিধানের দিকে চোখ রাখিলাম। আর তাতেই কয়েকটি অনুচ্ছেদের ভাষা-পরিভাষার মর্মমূল আঁচ করিতে গিয়া বিস্মিত হইলাম। বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’

প্রসঙ্গত জো বাইডেনের প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে বিচারিক আদালতের সোপর্দ হইতে দেখিলাম দিন কতক পূর্বে। ঘণ্টা দেড়েক হাজতও খাটিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইনের শাসন আমাদের জন্য শিক্ষনীয়। আমাদের অন্ধকার চোখে আলোকচ্ছটা ছড়াইয়া দেয় তাহাদের বিচারকার্য।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ও লিওনিস্কি পরকীয়া প্রেমের পরিণতিও বিশ্ববাসী পরিলক্ষণ করিয়াছে। অভিশংসনের দাবি উত্থাপিত হইয়াছিল। সিন্ডিকেট ও সিনেট কক্ষে প্রধান বিচারপতি বসিয়া শুনানি অনুষ্ঠিত করিয়াছিলেন। ক্লিনটন দোষী সাব্যস্ত হইয়াছিলেন। দোষ স্বীকার করিয়া তিনি হাতজোড় করিয়া ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া ছিলেন। তখন তাহাকে ক্ষমা প্রদর্শন করিলেও ধিক্কার জানানো হইয়াছিল। আমেরিকার মতো ভারতেও আইনের শাসন বিশ্ববাসীর জন্য অনুসরণীয়। ভারতের এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বিদ্যুৎ দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হইয়াছিলেন। দণ্ডে দণ্ডিত হইয়াছিলেন, যাহা অবিস্মরণীয় এক রায়। ভারতের সুপ্রিমকোর্ট হাইকোর্ট বিভাগের কারাদণ্ডের পরিবর্তে এই মর্মে রায় প্রদান করিয়াছিলেন যে, অভিযুক্ত মন্ত্রীকে প্রতিদিন ভারতীয় জাতীয় গ্রস্থাগারে গিয়া মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী, নেতাজী সুভাসচন্দ্র বোস, নওরোজী দাদাভাই, গোপাল কৃষ্ণ গোখলে, ভ্রাতৃদ্বয় মওলানা মোহাম্মদ আলী ও মওলানা রহমত আলীর জীবনীগ্রন্থ পড়তে হবে। সকাল ৯ ঘটিকা হইতে বিকাল ৫ ঘটিকা পর্যন্ত। পুলিশি প্রহরায় ভারতীয় সেই মন্ত্রী ৫ বছর যাবত জাতীয় গ্রন্থাগারেই গ্রন্থ পড়িবার মাধ্যমেই তার শাস্তি ভোগ করিয়া প্রায়শ্চিত্ত করিয়াছিলেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে বিনয়ে বলিতেছি, আপনারা যাহারা বিশ্বনেতা তাহারা বিশ্ব শান্তি ও সমৃদ্ধির দেনদরবারে উপবিষ্ট। সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির মহা মিলনমেলায়। আপনাদের প্রতিই মনোযোগ বিশ্ববাসীর। কেন না, কেবল মার্কিন মুল্লুকের শুধু নহে, সাড়ে সাত শত কোটি আদম বা অ্যাডাম সন্তানের শ্বাসনিঃশ্বাসের নিশ্চয়তা পরাশক্তি নামক অক্সিজেনের উপর। আপনারা আগ্নেয়গিরি, আপনারা পারমাণবিক, যাহার উপরে দণ্ডায়মান বিশ্বের প্রতিটি প্রাণ। জো বাইডেন নিঃশব্দে সুচিন্তিত এক নজির স্থাপন করিয়া, নোবেলীয় বা ইউনূসীয় গোলকধাঁধায় না জড়াইয়া, সর্বোপরি ওবামা-হিলারির পথে না হাঁটিয়া যে বার্তাখানি- সেলফিকলার দ্বারা ছড়াইয়া দিয়াছেন। তাহা নিশ্চয়ই বাইডেনের বিজ্ঞানমনষ্ক চিন্তাধারার দ্রুততম প্রতিফলন। এই কর্মসম্পাদন করিয়া বাইডেন রিপাবলিকানদেরই কূটনৈতিক কর্মশৈলীতে সুনিপুণ শিল্পকলার সংযোজন ঘটাইয়া নবতর এক কৌশলের অবতারণ ঘটাইয়াছেন।

বাংলাদেশ-আমেরিকা সম্পর্কের অহেতুক টানাপড়েনের মূলে যে ইউনূসীয় প্রশ্ন বিষবৃক্ষের মতো বিশ্ব পরিমণ্ডলে নানাবিধ চক্রান্ত ষড়যন্ত্র কিংবা সংশয় সন্দেহের আমাদানি ঘটাইয়াছিল, তাহার মুখোশ উন্মোচন হইয়া গিয়াছে। জো বাইডেন এরকম একখানা কর্মসম্পাদনের মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রাকৃতমনস্ক চিন্তাধারার মসনদে বসিয়া পড়িয়াছেন।্ অভিবাদন, জো বাইডেন।

-লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস গবেষক