Home মতামত মৃত্যুর পরেও ঝামেলা মুক্ত হতে পারলেন না তিনি!!

মৃত্যুর পরেও ঝামেলা মুক্ত হতে পারলেন না তিনি!!

54

ইঞ্জিঃ সরদার মোঃ শাহীন:

মিলিটারী শব্দটা সেই ৭১ সাল থেকেই আঁতকে ওঠার মত। মিলিটারী আসছে শুনলে সবারই পেটের ভাত হজম হয়ে যেত। তারপর শুরু হতো দৌঁড়। যে যেদিকে পারতো দৌঁড়াতো। দৌঁড়াতাম আমরাও। আম্মার হাত ধরে দৌঁড়াতাম। আমাদের বাসা বরাবর ছিল রেলস্টেশন। একবগীর ট্রেনে আসা খাকী পোশাক গায়ে রাইফেল কাঁধে রেলস্টেশনে বহুবার পাক মিলিটারী নামতে দেখেছি। আর আমরা ভয়ে দৌঁড়েছি মাইলের পর মাইল। না দৌঁড়ে উপায় আছে?
পাক মিলিটারী বলতে কথা! তাদেরকে পাঞ্জাবী মিলিটারীও বলতো। এই মিলিটারী নিয়ে সেই শিশুমনে যে ভয় ঢুকে আছে; আজো তা অমলিন। আজও মিলিটারী শব্দটি শুনলে আঁতকে উঠি। যদিও স্বাধীন বাংলায় শব্দটি আর চালু নেই, নেই পাক আমলের মত নির্মম দুঃশাসনও। স্বাধীন বাংলায় সদা জাগ্রত আছে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী। অতন্ত্র প্রহরীর মত দেশের ক্রান্তিকালে তাঁরা বরাবরই ভূমিকা রেখেছে। সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা দুর্ঘটনা মোকাবেলায়।
এসবের পরেও ঘটনার পরিক্রমায় একাধিকবার দেশের শাসন ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতেও তাঁদের দেখা গেছে। ২৪শে মার্চ, ১৯৮২। আমার এসএসসি’র শেষ পরীক্ষার সকাল। বাসার সামনে নিত্যদিন অপেক্ষায় থাকা রিক্সায় উঠতে যাবো। রিক্সাচালক মফিজ ভাইকে দেখলাম না। আশপাশ তাকিয়েও দেখলাম না। সাধারণত এমনটা হয় না। অবশেষে দেখা মিলল তার। মন বেশ ভার ভার মনে হলো। পরিবেশটাও যেন বেশ থমথমে। বিষয় কি? আশেপাশে তেমন লোকজন নেই। নিত্যদিনের মত সকালের গ্রামের বাজার গমগম করছে না। বাজার খালি খালি লাগছে। ঘটনা কি? জানতে চাইলাম তার কাছে।
মফিজ ভাই এদিক ওদিক তাকালো। এটা তার একধরণের মুদ্রাদোষ। ঘটনার গুরুত্ব বোঝাবার জন্যেই সে এটা করে। আজও আশেপাশে কেউ আছে কিনা ভাল করে দেখে নিল। এবং আমার কানের কাছে মুখ এনে খুব চিন্তিত মনে ফিসফিস করে বললো, “ঘটনা খারাপ। বড়ই খারাপ শাহীন বেডা। ঢাকায় আর্মি নামছে। মিলিটারী অহন গেরামেও আইবো। চোর বাটপার একটারেও আস্তা রাখতো না। পিডাইয়া পেটের গু বাইর কইরালবো। খালি গু না, হুতাইয়া মুতাইয়াও ছাড়বো।”
রেডিও শুনে বুঝলাম, ঘটনা আসলেই সত্যি। গান-বাজনা, সংবাদ পাঠ সবই বন্ধ। আছে শুধু থমথমে কণ্ঠের সরকারি ঘোষণা। তবে কোন্টা আসল সরকার, আর কোন্টা আসল নয়; তা বুঝতে অপেক্ষা করতে হলো ২ দিন। তবে এটা এই প্রথম না। ৭৫ থেকে ৮২। বাংলাদেশের ইতিহাসে মাত্র সাত বছরে রেডিও বেহাত হয়ে রীতি পাল্টে থমথমে অনুষ্ঠান প্রচার করেছে কম করে হলেও দশবার। সাধারণত ভোর রাতের দিকে রেডিও দখল হতো। এবং জনগণকে জানান দেয়া হতো যে ঢাকায় ক্ষমতার পালা বদল হয়েছে। আজও বারবার জানান দিচ্ছে। পতন হয়েছে সদ্য বিএনপির রাষ্ট্রপতি সাত্তার সাহেবের। বয়োবৃদ্ধ বিচারপতি সাত্তার সাহেব নিজ কাঁপা কণ্ঠে জনগণকে জানান দিচ্ছেন। বলছেন, “আমি আর না। আমি ফুট্টুশ। মার্শাল ল’ জারি হয়েছে দেশে। সামরিক ফরমানে ক্ষমতায় এরশাদ। সেনাবাহিনী প্রধান হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ।”
টানা প্রায় দশ বছর রাষ্ট্র ক্ষমতার সর্বোচ্চ পদে থাকা এই মানুষটি দু’বছর হলো ইন্তেকাল করেছেন। বলা যায় রাষ্ট্রীয় বড় সম্মান নিয়েই বিদায় নিয়েছেন এবং বয়সও পেয়েছেন ভাল। নব্বই বছর বাঙালীর জন্যে আলহামদুলিল্লাহ (!) অনেক ভাল বয়স। তিনি ভাগ্যবান একজন মানুষ। ভাগ্যবান তিনি সব দিক দিয়েই। জীবনকে যেমনি উপভোগ করেছেন লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে, তেমনি ক্যারিয়ারের শুরু থেকে শেষদিন পর্যন্ত ক্ষমতাকেও উপভোগ করেছেন। মাঝে জেলে থাকা ছয়টি বছর বাদ দিলে ক্ষমতাহীনতা তাঁকে কখনোই স্পর্শ করতে পারেনি।
রাজা না হলেও রাষ্ট্রপতি ছিলেন। রাজার মতই তো। জীবনও কাটিয়েছেন তিনি রাজা বাদশাহর মতই। রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ধপ্পাস করে পতনের পর টানা ছয় বছর ছিলেন জেলখানায়। মানসিকভাবে চরম নির্যাতিত হলেও জনগণের দ্বারা নির্বাচিতও ছিলেন। পাঁচ পাঁচটি আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। জেলে থেকেই নির্বাচিত হয়েছিলেন। গণ অভ্যুত্থানে পতিত কোন রাষ্ট্রনায়কের এমন বিশালভাবে নির্বাচিত হওয়া একটা রেকর্ড তো বটেই। তারপর শুধু উপরে উঠেছেন। ধাপে ধাপে মন্ত্রীর মর্যাদায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হয়েছেন। হয়েছেন সংসদে বিরোধী দলীয় নেতা। এটা জীবনের শেষ ইচ্ছা ছিল। ইচ্ছা পূরণ করেছেন আল্লাহ পাক। তবে ভীষণ ইচ্ছে ছিল বঙ্গভবনে ফিরে যাবার। পুনরায় রাষ্ট্রপতি হবার তীব্র বাসনা থাকার পরেও ইচ্ছেটা পূরণ হয়নি। না হয় না হোক। তাতে কি! এক সময় তো রাষ্ট্রপতি ছিলেন। মৃত্যুর সময়ও সংসদের বিরোধী দলের নেতা। তিনি কোন্ পদে ছিলেন না? সেনাপ্রধানও ছিলেন। ছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। উপ সেনাপ্রধান ছিলেন। আমৃত্যু সংসদ সদস্য ছিলেন। মন্ত্রীর মর্যাদায় ছিলেন। আজীবন ছিলেন দলের প্রধান। কেবল স্পীকার পদটা অলংকৃত করতে পারেননি। বেঁচে থাকলে বলা যায় না, হতেও পারতেন হয়ত।
ব্যবহার এবং কথাবার্তায় অত্যন্ত অমায়িক এবং খুবই মার্জিত স্বভাবের রুচিশীল মানুষ তিনি। যারা তাঁর খুব কাছে গেছেন তারাই অকপটে কথাটি স্বীকার করবেন। এটাও স্বীকার করবেন যে, খুব কাছে যাওয়া মানুষগুলোর বেশির ভাগকে তিনি দীর্ঘ সময়ের জন্যে ধরে রাখতে পারেননি। না রাজনৈতিক ভাবে কাছের, না ব্যক্তিগত কাছের। হয়ত এ কারণেই সুখী মানুষ ছিলেন না তিনি। প্রচন্ড বিলাসী জীবনের অধিকারী হলেও সুখ তাঁকে সব সময় ধরা দেয়নি। ব্যক্তি এবং পারিবারিক জীবনে তাঁর অশান্তির সীমা ছিল না।
জীবনের শেষ সময়গুলো কেটেছে অশান্তি আর আতঙ্কে। কাছের মানুষগুলোর দানবীয় থাবার আতঙ্ক তাঁকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে আমৃত্যু। বিশ্বাসী মানুষ তাঁর পাশে ছিল না বললেই চলে। সহমর্মিতার ছুঁতোয় যারাই কাছে এসেছে, তারাই কিছু না কিছু তাঁর কাছ থেকে লিখিয়ে নিয়ে গেছে। সময়টা বড় অসহায়ভাবে কেটেছে তাঁর। বয়স আর রোগের কাছে পরাস্ত ভারসাম্যহীন মানুষটির অসহায় মুখটি টিভি পর্দায় দেখেছে জনগণ। শেষ সময়টি তিনি কাটিয়েছেন প্রদর্শিত এবং অপ্রদর্শিত সম্পদ রক্ষাকল্পে। আর দুঃস্বপ্ন দেখেছেন প্রতিবন্ধী আদরের সন্তান এরিকের ভবিষ্যত নিয়ে।
অবশেষে তাঁর দুঃস্বপ্নই সত্যি হয়েছে। এরিক মিডিয়ার নিউজ আইটেম হয়েছে। এরিককে নিয়ে মহাখেলা শুরু হয়েছে এরশাদ পরিবারে। এ খেলার শেষ কোথায় কেউ জানে না। জনগণ জানে কেবল এরিকের জন্যে এরশাদ সাহেবের ট্রাস্ট করে যাবার বিষয়টি। আর তো কোন ট্রাস্ট তিনি করে যাননি। সম্পদ যা ছিল সবই ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়েছেন কাছের জনাদের। জনগণকে দিয়ে যাননি কানারত্তিও।
সারাজীবন তিনি যে জনগণ জনগণ করলেন, যে জনগণের মায়া ভালবাসা পুঁজি করে রাজনীতি করে গেলেন, রাষ্ট্র ক্ষমতা ভোগ করে গেলেন; সেই জনগণের জন্যে ট্রাস্ট করে দশটি টাকা রেখে যাবার উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করতে পারলেন না। শুধু তিনি কেন? কোন প্রতাপশালী রাজনীতিকই এই কাজটি আজ পর্যন্ত করতে পারেননি। করার মত বুকের পাটা ছিল না। সম্পদ ছিল। কিন্তু ইচ্ছাশক্তি ছিল না কারোরই।
ইচ্ছাশক্তি থাকলে এরশাদ সাহেব দানবীর মহসিনের মত সম্পদের একটা বড় অংশ বঞ্চিত জনতার কল্যাণে দিয়ে যেতে পারতেন। শতশত গরীব শিক্ষার্থীদের জন্যে শিক্ষাবৃত্তি চালু করে রেখে যেতে পারতেন। ঢাকায় না হোক, অন্তত রংপুরে একটা ভাল মানের হাসপাতাল করে যেতে পারতেন। ক্ষমতার প্রতিটি শাখায় বিচরণকারী এই মানুষটি না পারলে এ কাজ আর কে পারবে! অভাবী পলান সরকাররা যা করে দেখাতে পারলেন, সম্পদ এবং ক্ষমতাশালী এরশাদ সাহেব তা পারলেন না।
তবে, একেবারে কিছুই যে পারেননি তা নয়। তিনি পেরেছেন। ৯০ বছর কুতেমুতে প্রকান্ড সাইজের একখানা ঘোড়ার ডিম পেরেছেন। প্রাণের চেয়েও প্রিয় জনগণের জন্যেই পেরেছেন এবং দিয়েও গেছেন সেই জনগণকে। জনগণকে নিয়ে জীবনভর মায়া দেখানো বড়বড় মানুষেরা জনগণকে কেবল এই একটা জিনিসই দিতে পারেন। এতে জনগণও অখুশি হয় না। হবে কেন? অসহায় জনগণের জন্যে মন্দ কি! সোনার ডিম না হোক! ঘোড়ার ডিম! আফটারঅল ডিম তো!! এটাই বা কে দেয়! কয়জনে দেয়!!!