Home জাতীয় বিড়ম্বনামুক্ত ঈদ-যাতায়াতের জন্য দরকার পরিকল্পিত কর্মযজ্ঞ: বিশিষ্টজনেরা

বিড়ম্বনামুক্ত ঈদ-যাতায়াতের জন্য দরকার পরিকল্পিত কর্মযজ্ঞ: বিশিষ্টজনেরা

38

নাজির আহমেদ সজল: ঈদ-যাতায়াত নিরাপদ ও বিড়ম্বনামুক্ত করতে হলে সড়ক, নৌ ও রেল- তিনটি গণপরিবহন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার অপরিহার্য। এজন্য শুধু ঈদ-কেন্দ্রীক পরিকল্পনা গ্রহণ করলে হবে না; বছরব্যাপি সুপরিকল্পিত কর্মযজ্ঞ চালাতে হবে। তবে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তরা ঠুটো জগন্নাথ হয়ে বসে থেকে কারিগরীজ্ঞানহীন কর্মকর্তাদের দিয়ে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করালে কোনোদিনই কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না। আজ সোমবার (৩০ মে) সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এক আলোচনা সভায় সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞসহ বিশিষ্টজনেরা এই অভিমত ব্যক্ত করেন।

ঈদ-যাতায়াত ব্যবস্থার উন্নয়নে ১৫টি সামাজিক সংগঠনের উদ্যোগে গঠিত ২১ সদস্যবিশিষ্ট নাগরিক পর্যবেক্ষণ কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে এই আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। প্রতিবেদনে সমগ্র গণপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে মোট ২৫টি সুপারিশ উত্থাপন করা হয়। এর মধ্যে সড়কখাতে জন্য ১২টি, নৌখাতের জন্য সাতটি ও রেলখাতের জন্য ছয়টি সুপারিশ করা হয়েছে।

অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটির সভাপতি হাজী মোহাম্মদ শহীদ মিয়া। আলোচনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মীর তারেক আলী, যুক্তরাজ্যের গ্লাসগোর ভি শিপ্স এর সাবেক প্রধান নৌপ্রকৌশলী মো. আবদুল হামিদ, নাগরিক পর্যবেক্ষণ কমিটির সদস্যসচিব আমিনুর রসুল বাবুল, সুন্দরবন ও উপকূল সুরক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক নিখিল চন্দ্র ভদ্র। সুপারিশমালাসহ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন নাগরিক পর্যবেক্ষণ কমিটির প্রধান সমন্বয়ক আশীষ কুমার দে।

অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস বলেন, দেশের কোথাও সুশাসন ও জবাবদিহিতা নেই। সাধারণ নাগরিকদের কল্যাণে রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রযন্ত্র যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ক্ষমতায় যাওয়া ও ক্ষমতায় টিকে থাকার লড়াই চলে। ঢাবির এই শিক্ষক আরো বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় বছরে ২০ হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও তা নিয়ে রাজনীতিবিদদের মাথাব্যথা নেই। এসব কারণে সড়ক, নৌ ও রেল তথা সমগ্র গণপরিবহনখাতে চরম অব্যবস্থাপনা ও বিশৃঙ্খলা বিরাজমান। শুধু ঈদে নয়, সারাবছরই আমাদের যাতায়াত ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ ও যন্ত্রণাদায়ক থাকে। এর বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজকে সোচ্চার প্রতিবাদী হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

ড. মীর তারেক আলী বলেন, আমাদের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিরাজমান বহুমুখি সমস্যার মধ্যে এবারের ঈদে নতুন সংকট সৃষ্টি করেছে মোটরসাইকেল। ঝুঁকিপূর্ণ এই বাহনে যাত্রী পরিবহন দুর্ঘটনার আশংকা বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। একইভাবে নৌপথে ঝুঁকি বাড়িয়েছে স্পিডবোট। বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, ঈদ-যাতায়াত নিরাপদ ও বিড়ম্বনামুক্ত করতে হলে সড়ক, নৌ ও রেল- তিনটি গণপরিবহনখাতকে ঢেলে সাজাতে হবে। এজন্য শুধু ঈদ-কেন্দ্রীক পরিকল্পনা গ্রহণ করলে হবে না; বছরব্যাপি সুপরিকল্পিত কর্মযজ্ঞ চালাতে হবে।

নাগরিক পর্যবেক্ষণ কমিটির সুপারিশমালায় বলা হয়, যেহেতু বছরে দুটি ঈদ উদযাপিত হবে, সেহেতু প্রতি বছর ঈদ-যাতায়াতেও সমস্যা হবে। তাই এমন পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ যাতে ঈদের আগে তড়িঘড়ি করে কোনোকিছু করতে না হয়। এ লক্ষ্যে নিম্নোক্ত সুপারিশগুলো উত্থাপন করা হলো।

সড়কপথের জন্য সুপারিশ :

১. সড়ক যোগাযোগের উন্নয়ন ও জনভোগান্তি লাঘবে ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বড় শহরগুলোর সঙ্গে সম্ভাব্য সকল জেলার বিআরটিসির বাস সার্ভিস চালু ও সেবার মান বৃদ্ধি।

২. সকল সড়ক-মহাসড়কের সংস্কার ও উন্নয়ন কাজ ঈদের ১৫ দিন আগেই সম্পন্ন করা।

৩. যেসব মহাসড়কে উন্নয়ন কাজ চলমান তা ঈদের ১৫ দিন আগে স্থগিত করে গাড়ি চলাচলের উপযোগী বিকল্প ব্যবস্থা করা।

৪. দুর্ঘটনা এড়াতে মহাসড়কে লক্কড়-ঝক্কড় বাস, তিন-চাকার যানবাহন ও দূরপাল্লার সড়কে যাত্রীবাহী মোটরবাইক চলাচল বন্ধ এবং মোটরবাইকে একাধিক আরোহী নিষিদ্ধ করতে হবে।

৫. নিরবিচ্ছিন্ন ও বিড়ম্বনামুক্ত সড়ক যোগাযোগের স্বার্থে পাটুরিয়া-দৌলতদিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ নৌপথে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ফেরি এবং ঘাট ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা নিশ্চিত এবং এসব নৌপথে ত্রুটিপূর্ণ লঞ্চ চলাচল ও অতিরিক্ত যাত্রী বহন রোধ।

৬. মহাসড়কে অনিবন্ধিত, ত্রুটিপূর্ণ ও বিপজ্জনক সব ধরনের যানবাহন নিষিদ্ধ এবং সড়ক সংলগ্ন অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ।

৭. বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক সড়ক, মহাসড়ক ও বিভিন্ন মহানগরীর ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকগুলো জরুরি ভিত্তিতে সংস্কার করা।

৮. বাড়তি ভাড়া আদায় বন্ধে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর ও বিআরটিএকে শক্তিশালী এবং দুটি সংস্থার ভ্রাম্যমান আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি।

৯. পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা-চট্টগ্রাম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মধ্যে যাত্রী ও যানবাহন চলাচল অনেক বেড়ে যাবে। তাই ঢাকা-মাওয়া-খুলনা মহাসড়কের ওপর বাড়তি নজরদারি আবশ্যক।

১০. বর্ষায় অতিগুরুত্বপূর্ণ ও জনবহুল টঙ্গী-জয়দেবপুর ১৩ কিলোমিটার সড়কের জলাবদ্ধতা নিরসনে জরুরিভাবে সেখানকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কার।

১১. ঈদের এক সপ্তাহ আগে মহাসড়কে ওষুধ, নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্য ও পচনশীল দ্রব্যবাহী গাড়ি ছাড়া সাধারণ পণ্যবাহী সব ধরনের গাড়ি চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা।

১২. সড়ক, মহাসড়ক ও আঞ্চলিক সড়কে পুলিশ ও র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য নিয়োগ এবং প্রচলিত আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ।

নৌপথের জন্য সুপারিশ :

১. ঢাকা থেকে বিভিন্ন উপকূলীয় জনপদ এবং সন্দ্বীপের কুমিরা-গুপ্তছড়াসহ সাগর মোহনায় বিভিন্ন নৌপথে বিআইডব্লিউটিসির যাত্রীবাহী আধুনিক জলযান চালু।

২. ঈদমৌসুমে রঙ লাগিয়ে লক্কড়Ñঝক্কড় লঞ্চ চলাচল বন্ধে ঈদ-পূর্ববর্তী ১৫ দিনের মধ্যে বার্ষিক সার্ভের (ফিটনেস পরীক্ষা) আবেদন করলে শিপ সার্ভেয়াররা যাতে দায়সারা সার্ভে করতে না পারেন সেজন্য ঈদের আগে ওই লঞ্চের ফিটনেস সনদ প্রদান বন্ধ রাখা।

৩. যাত্রীবাহী লঞ্চ, ওয়াটারবাস ও ট্রলারসহ সব ধরনের নৌযানের ফিটনেস যথাযথভাবে পরীক্ষার জন্য শিপ সার্ভেয়ারের শূন্যপদগুলোসহ নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের সকল শূন্যপদে অবিলম্বে অনুমোদিত জনবল নিয়োগ করতে হবে।

৪. ছাদে যাত্রী বহন ও ডেকে অতিরিক্ত যাত্রীচাপ ঠেকাতে লঞ্চমালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে ঈদের অন্তত: ১৫ দিন আগে সদরঘাট থেকে বিভিন্ন নৌপথে লঞ্চের সংখ্যা বাড়াতে হবে। তবে ঈদের এক সপ্তাহ আগে অন্য নৌপথের কোনো লঞ্চকে চলাচলের সুযোগ দেয়া যাবে না।

৫. নৌপুলিশ ও কোস্টগার্ডের তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি নৌপথে বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমান আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধি ও কার্যক্রম জোরদারকরণ।

৬. সকল নৌপথে অনিবন্ধিত ও ফিটনেসবিহীন স্পিডবোট চলাচল এবং ঝুঁকিপূর্ণ এই বাহনে অতিরিক্ত যাত্রী বহন বন্ধ করা।

৭. সকল লঞ্চ টার্মিনাল, ফেরিঘাট ও লঞ্চঘাটের ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন ও যাত্রীনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ।

রেলপথের জন্য সুপারিশ :

১. ঢাকার কমলাপুর ও চট্টগ্রাম রেলস্টেশনে টিকিট বিক্রির কাউন্টার সংখ্যা বৃদ্ধি এবং ঢাকায় পাঁচটির অধিকস্থানে টিকিট বিক্রির ব্যবস্থা।

২. কাউন্টারে সরাসরি টিকিটপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে জনভোগান্তি লাঘব।

৩. রেলওয়ের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের এ্যাপসের মাধ্যমে অনলাইনে টিকিটপ্রাপ্তির জটিলতা নিরসন।

৪. গত ঈদে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেখিয়ে টিকিট কিনতে হয়েছে। একই এনআইডি দিয়ে একই ব্যক্তির বিভিন্ন স্থান থেকে একাধিকবার টিকিট কেনার সুযোগ আছে কি-না, রেল কর্তৃপক্ষকে তা স্পষ্ট করতে হবে। যদি থাকে তাহলে টিকিট কালোবাজারি রোধে অবশ্যই তা বন্ধ করতে হবে।

৫. যাত্রীর চাপ বেশি- এমন রেলপথে ট্রেনের কোচ (বগি) এবং প্রয়োজনে ট্রেনসংখ্যা বাড়ানো; যাতে যাত্রীরা ছাড়ে চড়তে বাধ্য না হন।

৬. জননিরাপত্তা নিশ্চিত ও জনভোগান্তি লাঘবে কমলাপুরসহ জনবহুল রেলস্টেশনগুলোতে ঈদের এক সপ্তাহ আগে থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা ও ভ্রাম্যমান আদালতের কার্যক্রম জোরদার করা।