Home জাতীয় বিস্ফোরণ, অগ্নিকাণ্ড; রাজধানীর অধিকাংশ ভবনের সুরক্ষা নেই

বিস্ফোরণ, অগ্নিকাণ্ড; রাজধানীর অধিকাংশ ভবনের সুরক্ষা নেই

21

ডেস্ক রিপোর্ট: রাজধানীর অধিকাংশ ভবনের সুরক্ষা নেই। ঝুঁকিতে থাকা এসব ভবনে রয়েছে বিভিন্ন আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। সেপটিক ট্যাংক, স্যুয়ারেজ লাইন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে না। অথচ আবাসিক ভবনগুলোর অ্যাপার্টমেন্ট মালিক ও ভাড়াটিয়া, শপিংমল ও মার্কেটের দোকান মালিক ও ভাড়াটিয়ারা নিয়মিত রক্ষণাবক্ষেণের জন্য টাকা দিয়ে আসছেন। সেই টাকা সমিতির একশ্রেণির নেতারা খেয়ে ফেলেন, কাজের কাজ কিছুই করেন না। ভবনের মাটির নিচের জলাধারের ধারণক্ষমতা রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। তদারকি সংস্থাগুলোরও নজরদারি নেই।
এই প্রতিনিধি গতকাল গাউছিয়া মার্কেটে গিয়ে দেখতে পান, সেখানে শত শত এসি আছে, কিন্তু সেগুলোর সার্ভিসিং দীর্ঘদিন ধরে করা হয় না বলে কয়েক জন ব্যবসায়ী জানান। ইসলামপুর, গুলিস্তানসহ পুরান ঢাকার অনেকগুলো মার্কেটেরও একই অবস্থা। অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, ধানমন্ডিতেও অভিন্ন চিত্র। অনেকে রাতে মার্কেটগুলোতে অবস্থান করেন। দুর্ঘটনা ঘটলে ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হবে। ফায়ার সার্ভিসের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, সেপটিক ট্যাংক, স্যুয়ারেজ লাইন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করতে একাধিকবার সতর্ক করা হলেও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না। শুধু বড় কোনো অগ্নিকাণ্ড কিংবা বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণহানি ঘটলে তখন কিছুদিন আলোচনা হয়, দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়। এরপর সেটাও থেমে যায়। রাজধানীর ভবনগুলো সেপটিক ট্যাংক, স্যুয়ারেজ লাইন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসলাইন সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করছে কি না, সেটা দেখার জন্য সার্ভিলেন্স টিম বা ভিজিলেন্স টিম থাকার ওপর গুরুত্বারোপ করেন তারা।
২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যায় রাজধানীর মগবাজারে একটি তিনতলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে দুই শতাধিক লোক আহত হয়। মারা যায় ১২ জন। ঘটনাস্থলে অসংখ্য যানবাহন ও ভবন এই বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঐ বিস্ফোরণে আশপাশের অনেক ভবন কেঁপে ওঠে। গ্যাসলাইন লিকেজ থেকে ঐ বিস্ফোরণ হয় বলে তদন্তসংশ্লিষ্টদের ভাষ্য। ৭৯ আউটার সার্কুলার রোডের ‘রাখি নীড়’ নামের ঐ ভবনের নিচতলায় ছিল গ্র্যান্ড কনফেকশনারি, বেঙ্গল মিট ও শর্মা হাউজের দোকান। দোতলায় সিঙ্গারের শোরুম, তৃতীয় তলায় অনলাইন নিউজপোর্টাল ‘অপরাজেয় বাংলা’র কার্যালয়। বিস্ফোরণে ভবনটির ভেতর থেকে লোহার গ্রিল, আসবাবপত্রসহ বিভিন্ন অংশ ছিটকে এসে রাস্তায় পড়ে। দুটি বাসও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ ঘটনার পর রাজধানীর ভবনগুলোতে সেপটিক ট্যাংক, স্যুয়ারেজ লাইন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়টি সামনে চলে আসে। কিন্তু কিছুদিন পর এসব রক্ষণাবেক্ষণ মনিটরিং করার কার্যকর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। এ কারণে সম্প্রতি একাধিক বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। চলতি সপ্তাহের গত চার দিনে চারটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় এখন পর্যন্ত মারা গেছে ৩০ জন। যেখানে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবে একটি ভবনে বিস্ফোরণে তিন জন মারা যাওয়ার ক্ষতই এখনো শুকায়নি, সেখানে ঐ ঘটনার দুই দিন পরই বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে সিদ্দিকবাজার। গত মঙ্গলবার বিকালে পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারে সাততলা একটি ভবনে বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ২১ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত শনিবার বিকালে সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন-গ্যাস উৎপাদন কারখানায় বিস্ফোরণে নিহত হন সাত জন। ঐ দিন ভোরেই আবার রাজধানীর গুলশানেও এসি বিস্ফোরণে দগ্ধ হন দুই জন। তাদের মধ্যে গোপাল মল্লিক নামে এক জনের মৃত্যু হয়। এর আগেও দেশে অনেক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে। গত বছর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যু হয়। এর আগে গ্যাসলাইনের লিক থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে নারায়ণগঞ্জেও। ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণে ইমামসহ ৩১ জন প্রাণ হারান। গত ২ ফেব্রুয়ারি ভাটারায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে স্বামী-স্ত্রীর মৃত্যু হয়। গত ডিসেম্বরে মিরপুরে এসি বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে আরিয়ান নামে ১৪ বছরের এক কিশোর মারা যায়। ১২ জানুয়ারি সাভারে সিলিন্ডারের লিকেজ থেকে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে দগ্ধ হয়ে সাদিয়া নামে সাত বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়। গত ১৫ অক্টোবর রাজধানীর শ্যামপুরের জুরাইন কবরস্থান রোডে তিতাস গ্যাসের লাইনে কাজ করার সময় বিস্ফোরণে দগ্ধ হন পাঁচ শ্রমিক। সংশ্লিষ্ট সরকারি দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর উদাসীনতায় প্রায় প্রতিদিন ঘটছে এসব দুর্ঘটনা। অন্যদিকে দীর্ঘ হচ্ছে মৃত্যুর মিছিলও। যদিও কেন ঘটছে এসব ঘটনা, তা নিয়ে নেই বলার মতো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। বরং শোক প্রকাশ আর তদন্তের মধ্যেই রয়ে যাচ্ছে সীমাবদ্ধ। পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনায় এক এক করে সরকারি সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উদাসীনতার বিষয়টি আসছে প্রকাশ্যে। বুয়েটের একাধিক বিশেষজ্ঞ, রাজউকের শীর্ষ কর্মকর্তা ও সিদ্দিকবাজারের ঘটনার একাধিক তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত ক্যাফে কুইন ভবন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তবে শুরুতে ছিল তিনতলা ভবন। পরে তা আরও চারতলা বাড়ানো হয়। কিন্তু রাজউক কিছুই জানে না। তারা বলে, ভবনের মাটির নিচের জলাধার, পাইপলাইন, গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন প্রতি তিন মাস অন্তর রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়। কিন্তু অধিকাংশ ভবনে তা মানা হচ্ছে না। কোনো একটি ঘটনা ঘটলে টনক নড়ে। কিছুদিন পরে আর কোনো উদ্যোগ থাকে না। এটা দায়িত্বে গুরুতর অবহেলা। দায়িত্বে অবহেলায় জড়িত সংশ্লিষ্টদের মৃত্যুদণ্ডের আওতায় আনা উচিত বলে তারা জানান।
র‌্যাবের মহাপরিচালক এম খুরশীদ হোসেন বলেন, ‘পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনাটি নাশকতা কি না, তা খতিয়ে দেখছি।’ পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক বলেন, প্রতিটি ভবনের সেপটিক ট্যাংক, স্যুয়ারেজ লাইন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লাইন সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ প্রয়োজন, কিন্তু করা হচ্ছে না। অর্থাৎ, তারা দায়িত্ব পালন করেন না। বিশেষজ্ঞরা বলেন, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির অসংখ্য অবৈধ লাইন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে পুরো নগরে। ফলে অনেক জায়গায় লিকেজ তৈরি হচ্ছে, যা থেকে হতে পারে মারাত্মক বিস্ফোরণ। এছাড়া শহরের ভবনগুলোতে অভ্যন্তরীণ সংযোগ লাইনগুলোও নিয়মিত পরিচর্যা করা হয় না। ফলে প্রায়শই শর্ট সার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডের সূচনা হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে রাস্তার পাশের ভবনগুলো পর্যাপ্ত জায়গা না রাখায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইন, যা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে পুরো ভবনকেই। আবার স্যুয়ারেজের লাইন ঠিক না থাকায় বা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম না থাকার কারণে গ্যাস জমে যাচ্ছে সেপটিক ট্যাংকে। এর বাইরে শীতের শেষের দিকে এসি বিস্ফোরণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হলো নিম্নমানের এসি ব্যবহার করা এবং গরমের সময় কয়েক মাস বন্ধ রেখে সার্ভিসিং না করিয়েই এসি ব্যবহার করা। এছাড়া পুরোনো ভবনগুলোর ভেতরে একসঙ্গে অনেক এসি ব্যবহার করা হয় নির্ধারিত দূরত্ব না মেনেই। এগুলোর কোনো একটিতে গ্যাস লিকেজ হলে সবগুলোই বিস্ফোরিত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়।
ইত্তেফাক