Home মতামত বিশ্বাস থেকে টলানোর ক্ষমতা ইবলিশেরও নেই!!!

বিশ্বাস থেকে টলানোর ক্ষমতা ইবলিশেরও নেই!!!

27

সরদার মোঃ শাহীন:

একটা জাতি টানা ২৪ বছর আন্দোলন, সংগ্রাম আর গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করে যখন দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতা লাভ করে, তখন সে স্বাধীনতা হয় মারাত্মক অনুভবের। শান্তি সুখের। মুক্তিকামী মানুষের মুক্তিলাভের সুখ। শতশত নেতাকর্মীর জেলজুলুমের কষ্টের কথা তখন আর তাদের মাথায় থাকে না। থাকে না লক্ষ প্রাণের আত্মত্যাগের কথাও। থাকে শুধু মুক্ত বাতাসে মুক্ত জীবন আস্বাদনের পরম সুখানুভূতি। আর থাকে অর্জিত স্বাধীনতাকে আগলে রাখার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা।

আর বাংলার স্বাধীনতা প্রাপ্তি তো কেবল একটি স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে নয়। ২৪ বছরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। বাংলা মুক্ত হবার পর বাঙালী জাতি কি উল্লেখিত আচরণগুলো সঠিক ভাবে করতে পেরেছে? স্বাধীনতা অর্জনের ৫২টি বছর পেরিয়ে এই প্রশ্নটি তো তোলাই যায়। বিশ্লেষণ করাই যায়। মুক্তিকামী জনতা মুক্তির জন্যে যেখানে যা করা লেগেছে, সব করেছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেভাবে লেগেছে সেভাবেই সাপোর্ট দিয়েছে। বিনিময়ে হারিয়েছে সম্ভ্রম আর জীবন। সে সব দিতেও একচুল কার্পণ্য করেনি অদম্য এই জনতা।

কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃত্ব কী করেছে? ৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত তারা ঐক্যবদ্ধ ভাবে চমৎকার নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন। কোন বিভেদ ছিল না। বিজয় লাভের পর থেকে বিভেদ এবং প্রচন্ড প্রতিকূলতা থাকলেও জাতির জনক তাঁর অনবদ্য ক্ষমতায় মোটামুটি সবদিকে সামলে নিয়ে স্বাধীনতাকে আগলে রেখে দেশগঠনে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। কিন্তু তারপর? যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি রাষ্ট্রকে নানাভাবে বিব্রত করে স্বাধীনতা লুন্ঠনকল্পে প্রতিকূলতা সৃষ্টিকারীরা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিলো। আর শুরু করলো স্বাধীনতাকে ধ্বংস করার জন্যে প্রচন্ড রকমের ভিন্নমাত্রার কুরাজনীতি।

যা থেকে এই জাতি আজও মুক্ত হতে পারেনি। গেল ৪৯টা বছর স্বাধীনতা বিরোধীরা শুধু কুকর্মের খেলা খেলেই গেছে। ওদের খেলার কথা, তাই খেলছে। তবে দুঃখ হয় স্বাধীনতা অর্জনকারীদের নিয়ে। এই ৪৯ বছরে স্বাধীনতার এই চেতনাধারীরাও বসে থাকেনি। তাদের অনেকেই চেতনাকে পুঁজি করে নিজেদের আখের গুছিয়েছে। স্বাধীনতা বিরোধীদের মোকাবেলার কৌশল নিয়ে সামান্য কাজও করেনি। করার সময়ই পায়নি। সকল সময় দিয়েছে কেবল নিজেদের ভাগ্য গড়তে।

এর সুযোগ নিয়েছে স্বাধীনতা বিরোধীরা। ধর্মকে সামনে এনে ভুলভাল বুঝিয়ে এরা জাতিকে স্বাধীনতা বিমুখ করেছে। করেছে পাকিস্তানমুখী। পাকিস্তানীমুখী করার লক্ষ্যে ভারতবিরোধীতার জোয়ার সৃষ্টি করেছে। আর বর্ণচোরা তৃতীয় ফ্রন্ট স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি সেজে খুবই কৌশলে স্বাধীনতার ইতিহাসে হাত দিয়েছে। হাত দিয়েছে স্বাধীনতার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির ইতিহাসে। ইতিহাসকে বিকৃত আর বিতর্কিত করে বড় সংগোপনে বাঙালীকে পাকিস্তানী ভাবধারায় বানাবার চেষ্টা করেছে।

তিনটি ধারার দু’টি ধারা দেশের বৃহৎ দু’টি রাজনৈতিক দল। দেশের এই দুই বৃহৎ রাজনৈতিক দলের একটি জন্মলগ্ন থেকে স্বাধীনতা নিয়ে রহস্যজনক আচরণ করে। স্বাধীনতার যুদ্ধে তাদের সরাসরি অংশগ্রহণ থাকলেও রক্ত দিয়ে কেনা এই স্বাধীনতাকে তারা সবচেয়ে বেশি তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে। স্বাধীনতাকে বিতর্কিত করে। স্বাধীনতাকে বিতর্কিত করার প্রয়াস কেবল তাদের সিনিয়ররাই করে, তাই নয়। আজও তাদের তরুণ নেতাকর্মীদের মাঝেও এ প্রয়াস বিদ্যমান। শুধু বিদ্যমান বললে কম বলা হবে। বরং আগের চেয়েও প্রকট আকার ধারণ করেছে।

আর ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’বলে তথাকথিত রাজনীতির নামে স্বাধীনতার চেতনাবাদীরাও মাঠে ময়দানে যেভাবে চিহ্নিত স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে হাত মিলিয়ে চলে সেটাও কম ন্যাক্কারজনক নয়। রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের মাখামাখি না থাকলেও অর্থনীতির ময়দানে তারা মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। স্বাধীনতা বিরোধীদের মাঝারো মানের এমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে চেতনার দাবীদাররা ভাগ বসায়নি। তারা এখন একসাথে খায়, একসাথে যায়।

এই খেয়েদেয়ে একসাথে মিশে যাওয়া ধারাটিই তৃতীয় ধারা। বিত্তবৈভবকে কোনমতে ধরে রাখার স্বার্থে ওরা এক সাথে থাকার ভান করলেও লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য থেকে তারা একটুও সরেনি। স্বাধীনতাকে নস্যাতকল্পে ওরা ওদের কর্মকান্ড চালিয়েই যাচ্ছে। এ কাজে চমৎকার ভাবে ব্যবহার করছে বিশ্বসেরা সত্য ধর্মকে। কোমলমতি মানুষদের বিভ্রান্ত করার জন্যে এর চেয়ে মোক্ষম অস্ত্র আর নেই। ধর্মের নামে এরা ইনিয়ে বিনিয়ে যাই বলে, আখেরে তাদের লক্ষ্য একটাই, যেভাবেই হোক স্বাধীনতাকে বিতর্কিত করে দেয়া।

ক’দিন আগে পাঠ্যপুস্তক নিয়ে তেমনি একটা অপচেষ্টাও জাতি দেখেছে। অস্বীকার করার কোন উপায় নেই, পাঠ্যপুস্তকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবার মত বেশ কিছু ভুল কিংবা অসংগতি ছিল। যা মোটেই কাম্য ছিল না। পাঠ্যপুস্তকে ভুলের ছড়াছড়ি, ইন্টারনেট থেকে হুবহু কপি করে পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভুক্ত করা, ভুল তথ্য, ইতিহাস বিকৃতি, ইসলামবিরোধী ছবিসহ নানা বিষয় ছিল। কিন্তু মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি হয়েছে বলে কিচ্ছু ছিল না। বরং উল্টোটি ছিল। পরিষ্কারভাবে লেখা ছিল, মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি হয়নি।

অথচ এটাকেই উল্টোভাবে প্রচার করে গুজব ছড়িয়ে দিল। হাটে, মাঠে, ঘাটে সবখানে ছড়িয়ে দিল। মানুষ বানর থেকে তৈরি, যৌনতা ও নগ্ন ছবি বইয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও গুজব ছড়ানো হলো। গুজবটা ছড়াতে ওরা সাহায্য নিল ডারউইনের মতবাদ বিষয়ক চ্যাপ্টারের ছবিটিকে। অথচ ওই চ্যাপ্টারেই পরিষ্কারভাবে বলা আছে, মানুষ বানর থেকে সৃষ্টি হয়নি। কিন্তু এদেশে তো আর বই খুলে নিজে থেকে কেউ দেখার চেষ্টা করে না। তাই গুজব ডানা মেলতে সুবিধা হয়েছে।

তবে ডারউইনের মতবাদ কিন্তু এদেশে নতুন নয়। আমরাও পড়েছি জীববিজ্ঞান বইয়ে। তাতে সমস্যা হয়নি। শুধু আমাদের আমলে নয়, বিবর্তনবাদ এদেশের পাঠ্যপুস্তকে ছিল সেই পাকিস্তান আমল থেকে। ৬৭ সনের বইতেই ছিল। দেশ স্বাধীন হবার পরেও এটা বাদ যায়নি। কিন্তু এবারই প্রথম এটা নিয়ে হৈচৈ করা হলো। শুধু করা হলো না একটিমাত্র কাজ। কেউই আমরা নিজেরা বইটি মেলে চেক করে দেখি নাই। দেখার চেষ্টা করি নাই যে, ওখানে আসলেই বানর থেকে মানুষের জন্ম হবার কথা বলা ছিল কি না।

ছিল সেক্স এডুকেশন নিয়ে। পৃথিবীর সব উন্নত দেশেই স্কুলে এসব পড়ানো হয়। প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই বাংলাদেশেও এর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাহলে ভুলটা করলো কোথায়? সেক্স এডুকেশন দেবেন, কিন্তু যৌন অনুভূতির কথা, নিরাপদ যৌনতার কথা বলতে পারবেন না? সেক্স এডুকেশন প্রদান করতে চাইলে কিশোর-কিশোরীদের উপযোগী তথ্য প্রদান করতে হবে। সে সব না জানলে কিশোর বেলায় মানসিক স্ট্রেস নিয়ে হস্তমৈথুন করবে, রসময় গুপ্তের লেখা রসালো বই পড়ে বিকৃত যৌনধারণা নিয়ে বড় হবে। বন্ধুদের সাথে গোপনে যৌনকর্মীর কাছে যাবে। বড়দের যৌন লালসার শিকার হবে।

তবে আশার কথা, বিষয়গুলো এখন ঝিমিয়ে গেছে। হৈচৈ থেমে গেছে। এখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন শিক্ষামন্ত্রী নিজেই। তিনি প্রথম যেদিন মিডিয়ায় এসে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে বললেন, সব গুজব। বানর থেকে মানুষের সৃষ্টির কথা বইতে কোথায়ও বলা নেই, বরং উল্টোটা আছে। সেদিনই যেন হুজুগে মাতাল বাঙালীর মাথায় বাজ পড়েছে। পাশাপাশি শিক্ষামন্ত্রী এও বলেছেন, এসব বইতে ইসলাম বিরোধী কিছু নেই। তারপরেও মিথ্যে গুজবের বাইরেও যেখানে টুকটাক যা কিছু আছে, আমরা কিচ্ছু রাখবো না। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির একটি করে দু’টি বই নতুন তৈরি করে দিব ।

স্বাধীনতার মাসে এসে দোয়া করি, এভাবেই দেশ এগিয়ে যাক, শত্রুরা সব নিপাত যাক। ২৭ বছরের প্রবাস জীবন আমার। এই সময়ে দেশ বিদেশ ঘুরে নিত্যদিন কত কিছুই তো দেখছি। তবে গত ১২ বছরে বাংলাদেশের যে মেগা প্রজেক্টগুলোর একের পর এক বাস্তবে পরিণত হওয়া দেখছি তা সত্যিই অভূতপূর্ব। সরকার চাইলেই একটা দেশের আমূল পরিবর্তন করতে পারে, বদলে দিতে পারে। গত কয়েক বছরে আমরা সেই পরিবর্তনগুলোই দেখছি।

তাই চলুন সবাই মিলে নিজস্বার্থ বাদ দিয়ে আগে দেশকে এগুতে দেই। স্বাধীনতার মাসে এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা। দেশ যত এগুবে, জাতি তত বেশি শিক্ষিত হবে। যত শিক্ষিত হবে, যারযার ধর্মে সে তত বেশি ধার্মিক হবে। প্রকৃত শিক্ষিত জাতিই পারে প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষায় শিক্ষিত হতে। আমরাও হবো ইনশাআল্লাহ্! আমরা যারা মুসলমান, আল্লাহ্ রাসুলে প্রচন্ড বিশ্বাসী মুসলমান। অন্তরে লালন করা বিশ্বাস নিয়ে আমাদের সামান্যতম সন্দেহ নেই। আমাদের বিশ্বাস থেকে আমাদেরকে টলানোর ক্ষমতা বিশ্বের কারো নেই। স্বয়ং ইবলিশেরও নেই !!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।