Home কৃষি বানারীপাড়ায় শস্য ভান্ডারের অতীত গৌরব ফেরাতে নানা উদ্যোগ

বানারীপাড়ায় শস্য ভান্ডারের অতীত গৌরব ফেরাতে নানা উদ্যোগ

32

বোরোর পরে এবার আমনেরও বাম্পার ফলণের আশাবাদ

রাহাদ সুমন,বিশেষ প্রতিনিধি॥ বরিশালের এক সময়ের শস্য ভান্ডার হিসেবে খ্যাত বানারীপাড়া উপজেলায় কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। এখানকার কৃষি ঐতিহ্য ফেরাতে উপজেলা কৃষি দপ্তর কার্যকরী নানা উদ্যোগ নেওয়ার ফলে দিন দিন বদলে যাচ্ছে গোটা উপজেলার কৃষি ক্ষেত্রের চিত্র। এই উপজেলায় চলতি মৌসুমে বোরো ধানের বাম্পার ফলণ হয়েছে। ঘুর্ণিঝড় মোখার আতঙ্কে এখানকার কৃষক-কৃষাণীরা আগাম ধান কেটে ফেলেছেন। তীব্র তাপদাহে কৃষক-কৃষাণীদের কষ্ট হলেও ইতোমধ্যে ধানের মাড়াই কাজও সম্পন্ন করেছেন। কৃষকদের সঙ্গে মনের আনন্দে কৃষাণীরা ধান শুকিয়ে গোলায় তোলার কাজে সহযোগিতা করেছেন। ধান বিক্রি করে আশাতীত মূল্য পাওয়ায় কৃষকদের চোখেমুখে হাসির ঝিলিক।
বোরো মৌসুমে এ উপজেলার কৃষকরা প্রচন্ড রোদ- বৃষ্টি মাথায় নিয়ে হাল চাষ দিয়ে বোরো ধান আবাদ করেন। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের ফলে কৃষকরা জমিতে সঠিক সময় পর্যাপ্ত পানি পেয়েছেন। এছাড়া পৌর শহরসহ উপজেলার ৮ ইউনিয়নে কৃষি অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা মাঠপর্যায়ে থেকে কৃষকদের সব রকম পরামর্শ প্রদান ও পর্যাপ্ত বীজ-সার পাওয়ায় এবার কোনো কিছুতেই কৃষকদের বেগ পেতে হয়নি। এছাড়া আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় উপজেলার সর্বত্রই বোরো ধানের ভালো ফলন হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠেছে।
উপজেলা কৃষি অফিস জানায়, ইরি-বোরো মৌসূমে পৌর শহরসহ ৮ ইউনিয়নে ৫ হাজার ৯৬০ হেক্টর জমিতে ২৫ হাজার মেট্রিক টন বোরো ধানের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এ বছর উৎপাদন হয়েছে ২৫ হাজার ৯শত ৫১.৪ মেট্রিক টন। যা লক্ষ্য মাত্রার চেয়েও প্রায় এক হাজার মেট্রিক টন বেশী। বর্তমানে স্বল্প পরিসরে আউশ ধান চাষ করা হয়েছে এবং,আমন ধানের বীজতলা তৈরীর কাজ চলছে। উপজেলায় মোট ৫ হাজার ৫৮০ হেক্টর আবাদযোগ্য জমিতে ২২ হাজার ৩২০ মেট্রিক টন আমন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ উপজেলায় বি-আর ২৮, বি-আর ২৯, হীরা , হাইব্রিড ৭৫, ৮১, ৯১, সবুজ সাথী, এসএলএইডএইচ, জাগরনীসহ বিভিন্ন প্রজাতির উচ্চ ফলনশীল ধান চাষ করা হয়। এদিকে হঠাৎ কিছু কিছু এলাকায় বিআর ২৮, ২৯, ধানে ব্লাস্ট রোগ দেখা দিলেও রোগবালাই আক্রান্ত থেকে ফসল রক্ষা করতে কৃষি বিভাগের তৎপরতায় তেম কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি ।
উপজেলার সৈয়দকাঠি ইউনিয়নের তালাপ্রসাদ গ্রামের কৃষক নিয়াজ মোর্শেদ জানান, তিনি ১৬ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশী ফলণ পেয়েছেন। ফলন বৃদ্ধিতে শুরু থেকেই উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও মাঠ পর্যায়ে দায়িত্বরত উপ-সহকারি কৃষি কর্মকর্তা তাকে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শসহ সার্বিক সহযোগিতা করেছেন।
বানারীপাড়া সদর ইউনিয়নের কৃষক ইয়ার হোসেন বলেন, এ মৌসুমে ৮ বিঘা জমিতে বোরো ধান চাষ করেন। সার-সেচসহ অন্যান্য সুবিধা পাওয়ায় এ বছর তার জমিতে ফলন ভালো হয়েছে। উচ্চ ফলনশীল ধান আবাদ করায় প্রতি বিঘায় তিনি প্রায় ৩০-৩২ মণ ধান পেয়েছেন। উপজেলার ইলুহার ইউনিয়নের কৃষক বাদল জানান, এ মৌসুমে তিনি ১০ বিঘা জমিতে উচ্চ ফলনশীল জাতের ধান আবাদ করেন। তবে এ মৌসুমে সার, বীজ, কীটনাশক ও ডিজেলসহ সবকিছুই বেশি দামে কিনতে হওয়ায় আবাদে তার খরচ বেশি হয়েছে। গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার তার জমিতে ভালো ধান হয়েছে। তবে কিছু জমিতে ব্লাস্ট রোগ আক্রমণ করায় কিছু ক্ষতি হয়েছে।
উপজেলার উদয়কাঠি ইউনিয়নের কৃষাণী অর্চনা বিশ^াস জানান দুই বিঘা জমিতে ধান চাষ করে তিনি প্রায় ৭০ মন ফলণ পেয়ে দারুন খুশি। উপজেলার চাখার,বাইশারী,সলিয়াবাকপুর ও বিশারকান্দি ইউনিয়নের বেশ কয়েকজন কৃষক জানান তাদের জমিতে বোরো ধানের বাম্পার ফলণ হয়েছে। তারা কৃষি অফিসের মাধ্যমে সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন বলেও জানান।
এদিকে কৃষি অফিস সুত্রে জানা গেছে, এ উপজেলায় কৃষকদের মাঝে জিনসমৃদ্ধ বঙ্গবন্ধু-১০ ও ব্রি- ধান চুয়াত্তর ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এছাড়া তেল ফসল এর উৎপাদন ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে সূর্যমুখী ৯৪ মেট্রিক টন, সরিষা ২৪০ মেট্রিক টন ও তিল চব্বিশ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের কৃষকদের বাড়ির আঙিনায় পুষ্টি বাগান স্থ্পান করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কৃষক তার পুষ্টি চাহিদা মিটিয়ে বাড়তি সবজি বাজারে বিক্রি করতে পারছেন। বানারীপাড়া উপজেলার কৃষকদের মাঝে পেয়ারা,আমড়া,ভুট্টা, মাল্টা ও লেবু জাতীয় ফলের গাছ লাগানোর ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে দেশের এক ইঞ্চি জমিও ফাঁকা থাকবে না এ স্লোগানকে সামনে রেখে উপজেলা কৃষি অফিস বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে সবজির বীজ বিতরণ করেছে ।
কৃষিকাজে সচেতনতা বৃদ্ধিতে উঠান বৈঠক ও মতবিনিময় সভাসহ বিভিন্ন কার্যকর কর্মসূচি পালণ করায় সফলতা এসেছে।
বানরীপাড়ার ভাসমান কৃষি এখন দেশের এক অন্যতম বিস্ময়ের নাম। উপজেলার বিভিন্ন পতিত ও জলাবদ্ধ জমিতে সারজন পদ্ধতিতে ফলের বাগানসহ বিভিন্ন মৌসুমী সবজি চাষ অব্যাহত রয়েছে। এ উপজেলায় স্থানীয় জাতের ধান চাষের পরিবর্তে রূপসী জাতের ধান চাষে কৃষকদের আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।
উপজেলার মোট জমি ১২ হাজার ৭৫ হেক্টর ,মোট আবাদযোগ্য জমি ৮ হাজার ৭৩৭ হেক্টর ,মোট আবাদী জমি ৮ হাজার ৩৮০ হেক্টর, মোট পতিত জমি ৩৫৭ হেক্টর। এদিকে উপজেলার এক ফসলি জমিকে দুই ফসলি জমিতে এবং দুই ফসলি জমিকে তিন ফসলি জমিতে রূপান্তর করতে উপজেলা কৃষি দপ্তরের কার্যক্রম অব্যাহত আছে।
এ বিষয়ে বানারীপাড়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা তনয় সিংহ বলেন, কৃষি বান্ধব সরকারের বোরো মৌসুমে কৃষকদের মাঝে উফশী বীজ ও সারের প্রনোদনা এবং মাঠ পর্যায়ে অফিসারদের ব্যাপক তদারকির ফলে এবছর বানারীপাড়ায় বোরো ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বানারীপাড়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, মৌসুমের শুরুতে সরকারিভাবে প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় এ উপজেলায় ৫ হাজারের ওপর কৃষককে উফসী ও হাইব্রিড ধানের বীজ এবং ডিএপি ও এমওপি সার প্রদান করা হয়েছে। এছাড়া কৃষকদের বিনামূল্যে ও ভর্তুকিতে অর্ধৈক মূল্যে পাওয়ার টিলার,পটেটো ডিগার,বেড প্লান্টার ও পাওয়ার থ্রেসারসহ ( ধান মাড়াই যন্ত্র) বিভিন্ন কৃষি উপকরণ দেওয়ায় এর সুফল পাওয়া গেছে।
ফলন বৃদ্ধিতে মাঠপর্যায়ে থেকে কৃষকদের বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ প্রদান করা হয় জানিয়ে তিনি আরও বলেন, উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে কিছু বোরো ধানের জমিতে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণে কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তারপরও এবার উপজেলার সর্বত্রই বোরো ধানের আশাতীত ফলন হয়েছে। চলতি মৌসুমে আমন ধানেরও বাম্পার ফলনের আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।