Home বাণিজ্য ও অর্থনীতি বাংলাদেশে নতুন করে ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামবে

বাংলাদেশে নতুন করে ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নামবে

44

ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে আইএফপিআরআইয়ের পর্যবেক্ষণ

ডেস্ক রিপোর্ট: কোভিডের ধাক্কা সামলানোর আগেই বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় আঘাত হেনেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। যুদ্ধের প্রভাব মারাত্মক হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। বিশেষ করে খাদ্য, জ্বালানি ও সারের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি এরই মধ্যে সংশ্লিষ্টদের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধ শুরুর পর শুধু এ তিন পণ্যের ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধির কারণেই নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে পতিত হতে যাচ্ছে দেশের অন্তত ৫০ লাখ মানুষ।

বাংলাদেশের দারিদ্র্যে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব নিয়ে আইএফপিআরআইয়ের এ পর্যবেক্ষণ সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ: ইম্প্যাক্ট অব দি ইউক্রেন অ্যান্ড গ্লোবাল ক্রাইসিস অন পভার্টি অ্যান্ড ফুড সিকিউরিটি’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশ হয়েছে। এতে দেখা যায়, যুদ্ধ শুরুর পর থেকেই বিশ্বব্যাপী খাদ্য, জ্বালানি ও সারের দাম দ্রুত বেড়ে চলেছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, খাদ্যনিরাপত্তা ও দারিদ্র্যের হারে পণ্যগুলোর মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপক প্রভাব পড়ছে, যা এরই মধ্যে বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।

রুরাল ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড পলিসি অ্যানালাইসিস (আরআইএপিএ) মডেলের ভিত্তিতে পরিচালিত আইএফপিআরআইয়ের গবেষণায় উঠে এসেছে, যুদ্ধের সার্বিক প্রভাবে দেশের প্রকৃত জিডিপি কমেছে দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট। এর চেয়েও বেশি কমেছে কর্মসংস্থান, যার হার ১ দশমিক ৬ শতাংশ। খাদ্য, জ্বালানি ও সারের মূল্যে যুদ্ধের অভিঘাতে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসবে দেশের ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ। সেক্ষেত্রে সার্বিক দারিদ্র্যের হার বাড়তে যাচ্ছে ৩ দশমিক ৩ শতাংশীয় পয়েন্ট। শহরের চেয়ে গ্রামাঞ্চলেই এ অভিঘাত বেশি স্পষ্ট। যুদ্ধের প্রভাবে খাদ্য, জ্বালানি ও সারের মূল্য বাড়ায় গ্রামীণ দারিদ্র্য বাড়তে যাচ্ছে ৩ দশমিক ৮ শতাংশীয় পয়েন্ট। শহরাঞ্চলে এ হার ২ শতাংশীয় পয়েন্ট।

সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ভুট্টা, গম ও ভোজ্যতেলের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যগুলোর চাহিদার বড় অংশ আমদানির মাধ্যমে পূরণ করে বাংলাদেশ। এসব পণ্যের দাম ও আমদানি ব্যয় বেড়েছে। আবার স্থানীয় পর্যায়ে কৃষিপণ্য উৎপাদনের জন্য ফসলি জমিতে ব্যবহার্য সারেরও সরবরাহ বিঘ্নিত হয়ে দাম বেড়েছে। এর ধারাবাহিকতায় উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পেয়ে বেড়েছে উৎপাদিত পণ্যের দামও।

যুদ্ধের প্রভাব নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষের ওপরেই বেশি পড়তে যাচ্ছে বলে মনে করছেন নীতিনির্ধারকরা। তাদের ভাষ্যমতে, দেশে নতুন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তির বিষয়টি নির্ভর করবে যুদ্ধের স্থায়িত্ব এবং বর্তমান প্রবৃদ্ধির ধারা টিকে থাকার ওপর। দেশে বর্তমানে প্রবৃদ্ধি ইতিবাচক, ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ। আগামী বছর সাড়ে ৭ শতাংশ হওয়ার প্রক্ষেপণ রয়েছে। যদি প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকে তাহলে নতুন করে দারিদ্র্যের কোনো কারণ নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে যে মূল্যস্ফীতি, তার প্রভাব গ্রামীণ এলাকায় পড়বেই। এমনিতেও গ্রামীণ এলাকায় শহরের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। বর্তমানে দেশে যে মূল্যস্ফীতি, সেটিও যুদ্ধের প্রভাবেই। সারা দেশেই এর প্রভাব দেখা যাবে। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দরিদ্র মানুষ এক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি।

জানতে চাইলে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলমবলেন, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে প্রভাব দেখা যাবে দারিদ্র্যে। আমাদের আশা হলো মূল্যস্ফীতির প্রভাবটা কমে আসবে। প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, কিছু লোক দারিদ্র্যসীমার ওপরে চলে আসবে। মূল্যস্ফীতির কারণে কিছু মানুষ হয়তো দারিদ্র্যসীমার নিচে যাবে, কিন্তু সেটা পরিপূরণ হবে যদি আমাদের প্রবৃদ্ধির ধারা ইতিবাচক থাকে। সাড়ে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি যদি অর্জিত হয়, তাহলে আমরা প্রভাব কাটিয়ে উঠব। দারিদ্র্য বাড়া-কমার সঙ্গে প্রবৃদ্ধির হারের সম্পর্ক আছে। এ বিষয়টিও আমলে নিতে হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চলমান যুদ্ধের প্রভাব বৈশ্বিক। এর প্রভাব দেশ অনুযায়ী ভিন্ন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাইরের প্রভাবকগুলোর অভিঘাতের পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনার সুশাসনও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় পর্যায়ে বাজার নজরদারিও বেশ দুর্বল। এতে করে মূল্যস্ফীতি, আয়, কর্মসংস্থান ও দারিদ্র্যের মতো বিষয়গুলো নিয়ে বাড়তি উদ্বেগ থেকেই যাচ্ছে।

যুদ্ধ শুরুর পর গত পাঁচ মাসে ২১ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে এসেছে বলে পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) এক সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে পিপিআরসির নির্বাহী চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে খাদ্যবাজার অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে, সারেও যা দেখা গেছে। সব মিলিয়ে মূলত দামের ওপর প্রভাব দেখা যাচ্ছে। মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব পড়ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ একটি বাইরের প্রভাবক। সার্বিক পরিস্থিতির ওপর বাজার ব্যবস্থাপনাও একটা প্রভাব রাখে। দারিদ্র্যসীমার নিচে মানুষ যে পরিমাণেই আসুক না কেন, সেটা শুধু বাইরের প্রভাবকের কারণে না। এসব বহিঃপ্রভাবকের অভিঘাত নানা দেশে নানা রকমভাবে হচ্ছে। এটা নির্ভর করছে শক ব্যবস্থাপনার অভ্যন্তরীণভাবে কতটুকু ও কীভাবে করা হচ্ছে। শুধু বহিঃপ্রভাবকের কারণে সংকট প্রকট হচ্ছে, এমনটা নয়। এর সঙ্গে এখানকার বাজার ব্যবস্থাপনায় জনস্বার্থের বিষয়গুলো কতটুকু দেখা হচ্ছে এবং কতটা দক্ষতার সঙ্গে দেখা হচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ।

যুদ্ধের প্রভাব মোকাবেলায় সরকারি পর্যায়ে যে পদক্ষেপগুলো, সেগুলো এখন পর্যন্ত সঠিক পথেই আছে বলে মনে করছেন গবেষকরা। তবে শুধু সরকার নয়, পরিস্থিতি মোকাবেলায় সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে উচ্চ আয়ের মানুষের কৃচ্ছ্র সাধনের সচেতনতা বড় ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলেও মনে করছেন তারা। যদিও বাংলাদেশে বিষয়টির অভাব রয়েছে বলে মূল্যায়নে উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো বাংলাদেশে জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। জ্বালানি তেলের দামও বাড়ছে, যা অব্যাহত থাকবে। এক্ষেত্রে ডিজেলের দাম বাড়লে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে পরিবহন ব্যবস্থায়। পরিবহনে প্রভাব পড়লে কৃষিপণ্যের দাম বেড়ে যাবে। এরপর খাদ্যের দাম বাড়বে। এরই মধ্যে এগুলো বাস্তবে হতে দেখা যাচ্ছে।

আইএফপিআরআইয়ের কান্ট্রি রিপ্রেজেনটেটিভ সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. আখতার আহমেদ বলেন, বাংলাদেশেও যুদ্ধের প্রভাব দেখা যাচ্ছে। একেক দেশে এ প্রভাব একেক রকম। ভবিষ্যতে কী হবে এখনই সুনির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। বিষয়টি অনেকটাই নির্ভর করছে যুদ্ধ পরিস্থিতির ওপর। যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। এখন মনে হচ্ছে যুদ্ধ শিগগিরই শেষ হবে না। ইউক্রেন কৃষিজাত পণ্যের বড় সরবরাহকারী। কিন্তু এরই মধ্যে সরবরাহ বিঘ্নিত হয়েছে। গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। তাদের নিয়ন্ত্রণের প্রভাবে জ্বালানির দামও বেড়ে যাচ্ছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে গোটা বিশ্বের মতো বাংলাদেশকেও ভুগতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় অনেক ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে। যেমন ভর্তুকি বৃদ্ধির বিষয়টি আসতে পারে। কিন্তু এতে সরকারের ওপর চাপ বাড়বে। সরকারের সামর্থ্য বিবেচনায় নিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ ধরে রাখাও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান বিদ্যুৎ সংকট আরো কতটা প্রকট হবে সেটাও দেখতে হবে। শিল্পের ওপরও চাপ পড়বে। সরকারের পদক্ষেপগুলো এখন পর্যন্ত সঠিক পথেই এগোচ্ছে বলে আমি মনে করি। আমাদের রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। সামগ্রিকভাবে আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। সাধারণ মানুষের সহনশীলতাও গুরুত্বপূর্ণ। ভোগ কমাতে হবে। কৃচ্ছ্র সাধনের মানসিকতা এখন পর্যন্ত তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। সাধারণ মানুষের সচেতনতা দরকার। সেখানে সরকারের কতটুকুইবা করার আছে। এখন পর্যন্ত সাধারণ মানুষের সচেতনতার বহিঃপ্রকাশ দেখা যাচ্ছে না। উচ্চ আয়ের মানুষের সচেতনতা বেশি কাম্য। সবটা সরকারের পক্ষে সম্ভব না।

-বণিকবার্তা