Home মতামত প্রান্তজনের জেল জীবনঃ ৯ম কিস্তি

প্রান্তজনের জেল জীবনঃ ৯ম কিস্তি

93

সাইফুল ইসলাম শিশির: জুয়েল কোদাইকানাল ক্রিশ্চিয়ান কলেজ- কেসিসি থেকে বিএস ডিগ্রি অর্জন করে।কলেজে বিদায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ডক্টর স্যামুয়েল আব্রাহাম। তাঁর সামনে দু’টো কথা বলার সুযোগ পেয়ে সে ভীষণ উজ্জীবিত। ৪ বছর মাদুরাই অবস্থান কালে তার দেখা অনগ্রসর- পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবন জীবীকার মর্ম্মন্তুদ কাহিনী – দুঃখে যাদের জীবন গড়া। সব দুঃখ বঞ্চনার কথা উঠে আসে।
জলঅচল, জাতপাত, বাল্য বিবাহ, যৌতুক প্রথা যেখানে সমাজ অগ্রগতির প্রধান বাধা। ডক্টর আম্বেদকারের সূচিত পথ আশার আলো দেখিয়েছিল বটে, কিন্তু ব্রাহ্মণ্যবাদের চতুরতায় সেই দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি ভারতীয় সমাজ। ১০ কোটি লোক দলিত। যাদের মাথা গুঁজবার ঠাঁই নেই। শিক্ষা- দীক্ষার ব্যবস্থা নেই। চোখে মুখে আশা নেই- আলো নেই। লবণ চাষিদের পায়ে আজও দগদগে ঘা। জেলেপল্লীতে উনুন জ্বলে না। ক্ষুধায় উদর জ্বলে। পশ্চাৎপদ সেই সব জীবন জীবীকার কথা। অপার বিস্ময়ে মন্ত্রমুগ্ধ দর্শক- শ্রোতা। অনেকের চোখের জল চিকচিক করে।
রাজউক-এ ডিজাইন বিভাগে তার কর্মজীবন শুরু। চাকরি তার পায়ে বেড়ি পরাতে পারেনি। সময় পেলেই সে ছুটে যায় দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে, বাউল সন্ন্যাসীদের আখড়ায়।
শতাব্দীর গোড়ার দিকে সাংস্কৃতিক মন্ত্রনালয়ের উদ্যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাউল মেলা অনুষ্ঠিত হয়। শাহ আবদুল করিম, ফকির হুমায়ুন সাধু, মমতাজ বেগম, শফি মণ্ডল, টুনু টুন বাউল- কুষ্টিয়া, রব ফকির- কুষ্টিয়া, আজমল শাহ- ফরিদপুর, পাগলা বাবুল- ফরিদপুর, লতিফ শাহ- চুয়াডাঙ্গা প্রমুখ এর সাথে তার পরিচয় ঘটে।
হুমায়ুন সাধু তাকে মঞ্চে উঠে দোতারা বাজাতে বলেন। সাধুর ইচ্ছাই নির্দেশ মনে করে সে দোতারা হাতে দাঁড়িয়ে যায়। কয়েক হাজার মানুষ নিরব- নিস্তব্ধ হয়ে তার বাজানা শোনে। জুয়েলের ভাষায়, “আমি বাজাচ্ছিলাম না। মনে হচ্ছিল কে যেন আমাকে দিয়ে বাজিয়ে নিচ্ছে।”
তারপর গিটার নিয়ে সে ঝংকার তোলে, শাহ আবদুল করিমের “তোমারে পুষিলাম কত আদরে, মাটির পিঞ্জিরায় সোনার ময়না রে –“
রাধারমণ দত্তের – আমার বন্ধু দয়াময় তোমারে দেখিবার মনে লয় —
হাসন রাজা – লোকে বলে বলেরে ঘরবাড়ি বালানা আমার-
হালিম শাহ – আমাকে আপন করে নাও, তা নাহলে বন্ধু তুমি নিজেই আপন হয়ে যাও।
মাঠের কোণে জুয়েল এবং অনুশীলা দাঁড়িয়ে চা পান করছিল। এমন সময় এক মেয়ে এসে বলে, আমি ফাতেমা আক্তার সুমি, গ্রামঃ গোপীনাথপুর, জেলাঃ ফরিদপুর। ইডেন কলেজে অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। আমি আপনার একজন ভক্ত। বাউল মেলায় আপনার দোতারা বাজানো দেখেছি। আমার ইচ্ছা দোতারা বাজানো। আপনি যদি আমাকে শেখান খুব ভালো হয়। দু’চার কথা বলে সেদিন তাকে বিদায় করে দেয়।
তারপর আরও দুএক বার সে আড্ডায় এসেছে। একান্ত ইচ্ছা সে দোতারা শিখবে। সেই আগ্রহকে আর ফিরিয়ে দিতে পারিনি জুয়েল। তারপর থেকে সে নিয়মিত আসতো। বাড়ি ফিরতে দেরি হবে তাই সে হোস্টেলে সিট নেয়।
অল্পদিনের মধ্যেই সুমি দোতারা রপ্ত করে ফেলে। সুর তোলে আমাকে আপন করে নাও, তা নাহলে বন্ধু তুমি নিজেই আপন হয়ে যাও। ইংগিতটা বুঝতে পারে জুয়েল। জীবনের অনেকটা পথ সে একাই পাড়ি দিয়েছে। মনের কোণে একটু হলেও অতৃপ্তি কাজ করে। তাই মনের ভিতর গুণ গুণ করে – “ঘর করলাম নারে আমি সংসার করলাম না। আউল বাউল ফকির সেজে ভেক নিলাম না। মনের ঘরে প্রবেশ করে মনেকে কাছে পেলাম, জন্মদিনের মতো আজও শিশু থেকে গেলাম। ভালো মন্দের কোন কিছু হিসাব নিলাম না।”
চালচুলোহীন ছন্নছাড়া জীবন। বয়সের বিষয়টাও সামনে চলে আসে। মনের ভিতর দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাজ করে। অথচ সুমি এসব কিছুই মানতে নারাজ। তার কথা “মানিয়ে নেয়ার দায়িত্ব আমার।’
একদিন কথাটা সুমির মায়ের কানেও যায়। হঠাৎ করেই পরিবেশটা ঘোলাটে হয়ে ওঠে। সুমিকে ঘরে আটকে ফেলে। ভয়ভীতি দেখায় মারধর করে। জোর করে অন্যত্র বিয়ে দেবার চেষ্টা করে। কিন্তু কিছুতেই কিছু কাজ হয়না। সুমি ধনুক বাঁকা বেঁকে বসে। সুযোগ পেলেই সে জুয়েলের আড্ডায় চলে আসে। অগত্যা তার পরিবার থেকে তাকে সেফকাস্টোডিতে পাঠায়।
৪০ দিন পর সুমি বের হয়েই সটান জুয়েলের অফিসে চলে আসে। জুয়েল তো বিস্ময়ে হতবাক। তাড়াহুড়ো করে দু’জন বেরিয়ে পড়ে। কোথায় যাবে, কোথায় উঠবে কিছুই মাথায় আসেছেনা। সুমি রহস্যেভরা চোখে তাকায়, “আমিতো পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম বাউল! এবার তোমার পালা।”
দিনমান ঘুরে দুজন কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে পৌঁছায়। সুরমাএক্সপ্রেসে চেপে বসে অজানার পথে।
চলবে —-

৬ জুন ২০২১ খ্রিস্টাব্দ
লেক সার্কাস, উত্তর ধানমণ্ডি
ঢাকা — ১২০৫

*মতামত বিভাগে প্রকাশিত সকল লেখাই লেখকের নিজস্ব ব্যক্তিগত বক্তব্য বা মতামত।