Home সারাদেশ প্রবেশনে মুক্তি তাঁদের দিয়েছে নতুন জীবনের দিশা

প্রবেশনে মুক্তি তাঁদের দিয়েছে নতুন জীবনের দিশা

27

ডেস্ক রিপাের্ট: ‘আদালতের দেওয়া নির্দেশ যথাযথভাবে মেনে চলছি। ভবিষ্যতে এ ধরনের আর কোনো অপরাধে জড়াব না। আমার মা খুবই অসুস্থ। তাঁকে দেখভাল করার আমি ছাড়া কেউ নেই। এখন মায়ের সেবা করছি। মা ভীষণ খুশি, আমিও নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখছি। এখন বুঝি, জীবন কত সুন্দর।’

বরিশাল নগরের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের চৌমাথা এলাকায় এক যুবক এসব কথা বলছিলেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি মেহেন্দীগঞ্জের দাদপুর এলাকায়। গত বছরের জুনে মাদক আইনের একটি মামলায় ছয় বছরের সাজা হয়েছিল এই যুবকের।

আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে প্রবেশনে জামিনের আবেদন করেন তিনি। গত বছরের ১৫ জুন বরিশাল জেলা ও দায়রা জজ আদালতের তৎকালীন বিচারক কে এম রাশেদুজ্জামান তিনটি শর্তে তাঁকে প্রবেশনে জামিনের আদেশ দেন।

এভাবে বরিশালে গত তিন বছরে মাদক সেবন, মারামারিসহ লঘু অপরাধে সাজা পাওয়া ২৬৫ জন আদালতের নির্দেশে প্রবেশনে মুক্তি পেয়ে মা-বাবার সেবা, বৃক্ষরোপণসহ নানা ভালো কাজ করে নিজেদের সংশোধনের চেষ্টা চালাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে ৭০ জন এরই মধ্যে আদালতের শর্ত পূরণ করায় দণ্ড থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে ফিরেছেন স্বাভাবিক জীবনে।
এই ৭০ জনের মধ্যে সম্প্রতি একজন একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মকর্তা পদে চাকরি পেয়েছেন, একজন একটি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন, দুজন বিদেশে যাচ্ছেন। এভাবে তাঁরা মাদকের অভিশাপ ও সামাজিক অপরাধ থেকে মুক্ত হয়ে নতুন জীবনের পথ খুঁজে পেয়েছেন।

বরিশাল নগরের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের ওই যুবকের প্রবেশনে জামিনের আদেশে বিচারকের দেওয়া শর্ত ৩টি হলো—দ্বিতীয়বার আসামি এ ধরনের অপরাধে জড়িত হবেন না, অসুস্থ মায়ের সেবা করবেন এবং ১০০টি ঔষধি, ফলদ ও বনজ গাছ রোপণ করবেন।

আগামী দুই বছর তাঁর সব কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করবেন সমাজসেবা অধিপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তা। ওই তিন শর্তের কোনো ব্যত্যয় ঘটলে আদালতকে তিনি বিষয়টি জানাবেন। এরপর সেই থেকে ঘোষিত দণ্ড কার্যকর হবে।

আদালত ও জেলা সমাজসেবা কার্যালয় সূত্র জানায়, ২০২০ সাল থেকে ২০২২—এই তিন বছরে বরিশালের বিভিন্ন আদালত থেকে লঘু অপরাধে সাজা পাওয়া ২৬৫ জনকে ১৯৬৪ সালের প্রবেশন আইনের ৫ ধারায় বিভিন্ন শর্তে প্রবেশনে মুক্তি দেন আদালত। তাঁদের মাদক সেবন, মাদক বহন, মারামারির মতো লঘু অপরাধে প্রথমবার সাজা হয়েছিল।
এ তালিকার অন্তত ৭ জন নারী, ৬৫ জন শিশু ও বাকিরা পূর্ণবয়স্ক। প্রবেশন পাওয়ায় সামাজিক মর্যাদা অক্ষুণ্ন থাকার পাশাপাশি নিজের ভুল শুধরে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছেন তাঁরা। এতে খুশি তাঁদের পরিবারের সদস্যরাও।

মারামারির একটি মামলায় ছয় মাসের সাজা হয়েছিল বরিশাল নগরের কাজীপাড়ার এক তরুণের। পরে সামাজিক কাজে অংশগ্রহণের কয়েকটি শর্তে তাঁকে প্রবেশনে মুক্তি দেওয়া হয়। আদালতের শর্ত পূরণ করে গত বছরের শেষ দিকে তিনি পুরোপুরি মুক্তি পান। এরপর একটি বেসরকারি ব্যাংকে চাকরির পরীক্ষা দিয়ে কর্মকর্তা পদে যোগ দেন সম্প্রতি। তিনি বলেন, প্রবেশনে মুক্তির শর্তগুলো তাঁর জীবনবোধকে বদলে দিয়েছে।

বরিশালের বাবুগঞ্জের একটি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) নির্বাচনে সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন একজন। মাদক আইনের একটি মামলায় তাঁর দুই বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। প্রবেশনের শর্ত হিসেবে তাঁকে সমাজের অবহেলিত মানুষের সেবা করার শর্ত দেওয়া হয়। শর্ত পূরণ করে মুক্ত হওয়ার পর তিনি নির্বাচনে অংশ নেন।

ওই ইউপি সদস্য বলেন, সামাজিক কাজ করতে গিয়ে তিনি মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান। এরপর তাঁরাই তাঁকে নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে জনপ্রতিনিধি বানিয়েছেন।

বরিশালের আদালত থেকে প্রবেশন পাওয়া দুই শিশুর সঙ্গেও কথা হয়। তাদের একজন দশম শ্রেণি এবং আকেজন একাদশ শ্রেণিতে পড়ে। তারা বলে, ‘আদালত আমাদের পথ দেখিয়েছে।’

প্রবেশন পাওয়া ব্যক্তিদের সার্বিক কার্যক্রম নজরদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের প্রবেশন কর্মকর্তা সাজ্জাদ পারভেজকে। আজ সোমবার তিনি বলেন, বরিশাল জেলায় প্রথমবার লঘু অপরাধ করেছেন, এমন ২৬৫ জনকে ৩ বছরের জন্য শর্ত সাপেক্ষে প্রবেশনে মুক্তি দিয়েছিলেন আদালত। তাঁদের কার্যক্রম নিয়মিত নজরদারি করা হচ্ছে। এরই মধ্যে আদালতের শর্ত পালন করে জেলায় ৭০ জন পুরোপুরি দণ্ডমুক্ত হয়েছেন।

এটিকে অসাধারণ উদ্যোগ বলে মনে করছেন আইনজীবীরা। বরিশাল জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সাবেক সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) এ কে এম জাহাঙ্গীর বলেন, লঘু অপরাধে দণ্ডতি ব্যক্তিরা কারাগারে গুরুতর অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের সঙ্গে থাকলে তাঁরাও ভয়ংকর অপরাধী হয়ে উঠতে পারেন। এর ফলে এ প্রক্রিয়া ঠেকাতে প্রবেশন একটি অনন্য পদক্ষেপ। সংশোধনের সুযোগ দেওয়ার পর নতুন পথের দিশা পেয়েছেন ২৬৫ জন লঘু অপরাধী। সুযোগ পেলে তাঁরাও আলোর পথে ফিরে আসতে পারেন, এটা তারই উদাহরণ।
প্রথমআলো