Home মতামত প্রজন্মের লক্ষ্যহীন জীবন উদ্দেশ্যহীন স্বপ্ন!

প্রজন্মের লক্ষ্যহীন জীবন উদ্দেশ্যহীন স্বপ্ন!

70

সোহেল সানি:

“ব্রিটিশের শাসন, পাকিস্তানের শোষণ, শেখ মুজিবের ভাষণ” – এ প্রবাদের কথা শুনেছি। ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও বাংলাদেশ চলছে তাদের রেখে যাওয়া দণ্ডবিধি আইনকানুনের আলোকে। আর পাকিস্তানী শোষণের অবসান ঘটলেও বাংলাদেশ শিশু থেকে কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পৌঁছেছে তাদেরই ভাবধারায়। যে দেশের প্রধানমন্ত্রী বিদ্রুপাত্মক ভাষায় বলতেন, “পূর্ববাংলার মুসলমানরা খাঁটি মুসলমান নয়, কেননা ওরা খৎনা করে না”। অবশ্য পাক প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনের বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যের রসাত্মক জবাব দেন পূর্ববাংলার তেজস্বী সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী তাঁর এক সম্পাদকীয়তে। তিনি লিখেন, ‘আমাদের মান্যগণ্য প্রধানমন্ত্রী নাকি তাঁর স্ত্রীর অভিজ্ঞতা থেকেই পূর্ববাংলার মুসলমানদের খৎনা না করার বিষয়টি জানতে পারেন।’
সেই স্ত্রীটির নামেই আমাদের দেশসেরা ভিকারুননিসা নূন স্কুল এন্ড কলেজ। লোভ সংবরণ করতে না পারায় এ প্রসঙ্গচ্যুতি।
যাহোক বাংলাদেশ অঙ্কুরেই হারায় তার জনককে। হারায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার মূল্যবোধকে।
শাসন-শোষণ! অবশিষ্ট থাকলো ভাষণ। বঙ্গবন্ধুর যে জ্বালাময়ী ভাষণ স্বাধীনতার অমোঘ মন্ত্র, তাকেই বাংলাদেশের শিশুতোষ মন থেকেই মুছে ফেলা হয়। যে ভাষণের সঙ্গে পরিচয় হয়ে ওঠেনি, একুশ বছর বয়সী ছাত্র, যুবক-যুবতীর। বরং উতালপাতাল করা যৌবনের জোয়ারে মনের গভীরে প্রোথিত হয়ে যায়, একুশ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় বেতার টিভিতে প্রচারিত প্যাঁচালী প্রপাগান্ডা। তথ্যপ্রবাহের বিরাজমান যুগে এ ধরনের অপসংস্কৃতি আর মিথ্যা প্রপাগান্ডা অস্থিমজ্জায় ঢুকিয়ে প্রজন্মকে বিভ্রান্তির আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দেয়া সম্ভব নয়। তার প্রমাণ শতভাগ পূর্ণ হবে যদি বর্তমান শিশু থেকে পঁচিশ বছর বয়সী যুবক-যুবতীর ওপর জরিপ চালালে। দেখা যাবে হামাগুড়ি খাওয়া দুই বছরের শিশুটির মুখে উচ্চারিত হবে, জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু তেমনিভাবে কিশোরকিশোরী, তরুণতরুণী ও যুবক-যুবতীর মুখের ভাষায় শুধু নয়, পোশাক-আশাকে, রঙঢঙে-আচার-আচরণে প্রস্ফুটন ঘটে বাঙালীত্বের ও লাল-সবুজের প্রতিচ্ছায়ায়। কিন্তু একুশ বছরে বেড়ে ওঠা যুবযুবতীরা বয়সে এখন পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই। যাদের ওপর সমীক্ষা চালালে দেখা যাবে তাদের অধিকাংশই বঙ্গবন্ধু বিদ্বেষী। তর্ক-বিতর্কে প্রাধান্য বিস্তারের খাতিরে শেখ মুজিবকে এরা মুখে বঙ্গবন্ধু বললেও মুক্ত হাওয়ায় ঠিকই ‘মরহুম শেখ মুজিব’ বলেন। ঠিক এভাবেই বঙ্গবন্ধুকে মৃত ঘোষণা করে। প্রকারান্তরে তারা জিয়াউর রহমানকে মৃত্যুঞ্জয়ী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতেই ‘শহীদ রাষ্ট্রপতি’ কথাটা ব্যবহার করেন। রাষ্ট্রপতি কথাটা তো একটা বিশেষণ বা ভাষার উপসর্গ, তাহলে ‘শহীদ’ হয় কিভাবে? তর্কের যুদ্ধে ধরে নিচ্ছি শহীদ রাষ্ট্রপতি। ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে জেনারেল মঞ্জুরের সামরিক অভ্যুত্থান কোন যুদ্ধ ছিল না। যুদ্ধ বলতে বুঝায় দুপক্ষের যুদ্ধ। সেদিনকারের অভ্যুত্থান এক পক্ষের ছিল বলেই অভ্যুত্থানকারী কোন সেনা সদস্যের নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটেনি। অভ্যুত্থানে নয়, যুদ্ধে কেউ মারা গেলে বলা হয় ‘শহীদ’ আর যুদ্ধ বিজয়ীকে বলা হয় ‘গাজী।’
মহান মুক্তিযুদ্ধে মৃত্যুবরণকারী অগণিত ত্রিশ লাখ বাঙালিকে বলা হয় শহীদ। ইসলামের যুদ্ধে বিজয়ী বীরদের ‘গাজী’ বলা হলেও আমাদের যুদ্ধজয়ী ও মৃত্যুবরণকারী প্রিয় মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় পদক হিসেবে দেয়া হয়, বীরশ্রেষ্ঠ, বীরউত্তম, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক। অর্থাৎ অগুনিত জনগণের মৃত্যুকে আত্মদান হিসাবে বিবেচনা করে ‘শহীদ’ হিসাবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। যুদ্ধরত অবস্থায় মৃত্যুবরণকারী মুক্তিবাহিনীর সদস্যদেরকেই ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা’ বলা হয়। অপরদিকে মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হলে উল্টো চিত্রটি ঘটতো। বিদ্রোহী ও দেশদ্রোহী হিসেবে পাকিস্তানের মার্শাল ল কোর্টে বিচারের মুখোমুখি হতে হতো- প্রবাসী মুজিব নগর সরকারের রাষ্ট্রপতি, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ, প্রধান সেনাপতি,সেক্টর কমান্ডারগণসহ উচ্চ থেকে নিম্নপদস্থ সকল সামরিক-বেসামরিক আমলা। স্বাধীনতার স্থপতি রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু-তো দেশদ্রোহী হিসাবে পাকিস্তানের মার্শাল ল কোর্টে ফাঁসির দন্ডে দন্ডিত শুধু নন,কারাগারে বন্দী ছিলেন। বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকারকারীরা এবং বিদ্রুপকারী বুকে হাত রেখে ভাবুন, যুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন নজরুল ও তাজউদ্দিনের মুজিবনগর সরকার পরাজিত হলে নিশ্চয়ই পাকিস্তান মার্শাল ল কোর্টে সর্বাগ্রে প্রধান সেনাপতি আর সেক্টর কমান্ডারদের মৃত্যুদন্ড হতো। যুদ্ধে পরাস্ত বিদ্রোহী সেক্টর কমান্ডারদের পাকিস্তানের সামরিক সেনাছাউনিতে অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থান করার তো সুযোগও থাকতো না। ক্ষমতার লিপ্সা মেজর হতে রাতারাতি বিগ্রেডিয়ার জেনারেল হয়ে ওঠা সিজিএস খালেদ মোশাররফ ও বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতা কর্নেল তাহেরের মৃত্যু মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে হলে অন্ততপক্ষে বীরউত্তমের স্থলে বীরশ্রেষ্ঠ পদকেই ভূষিত হতেন। একজন সেক্টর কমান্ডারের হাতে আরেকজন সেক্টর কমান্ডারের নির্মম মৃত্যুর ইতিহাস রচনার চেয়ে অধিকতর সম্মানের হতো যদি সময় সম্মুখের যুদ্ধে প্রাণ দিতেন। রণাঙ্গনে পঙ্গু হওয়া কর্নেল তাহের আজ ইতিহাসের চোখে আরেকজন সেক্টর কমান্ডার জিয়ার উত্থানের জন্মদাতা। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে সেই জিয়ার হাতেই ফাঁসিতে ঝুলেছেন কর্নেল তাহের। আর এর আগেই কর্নেল তাহেরের অভ্যুত্থানে প্রাণ দেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ। বঙ্গবন্ধুকে মুছে ফেলার চক্রান্ত চলে অন্ধকারের সেই দুই যুগের শাসন-শোষণের দ্বারা।
‘সাতচল্লিশে’ পাকিস্তানের স্বাধীনতায় ঘটে ব্রিটিশ শাসনের রক্তপাতহীন অবসান। পরাধীন হতে এক নদী রক্তের বিনিময়ে পূর্ব-পশ্চিমে দ্বিখণ্ডিত হয় ১ লাখ ৯৪ হাজার বর্গমাইলের বাংলাদেশ! ব্রিটিশ শাসনের অবসান হলেও তাদেরকে রেখে যাওয়া দণ্ডবিধির আদলে প্রণীত আইনকানুনেই পথ চলছে বাংলাদেশ।একাত্তরে একসাগর রক্তের বিনিময়ে পাকিস্তানী শোষণের অবসান হলেও রেখে গেছে আমলাতন্ত্র। বিরাজমান বাংলাদেশ সেই ঘটনাপ্রবাহের প্রতিক্রিয়া।পঁচাত্তোর প্রজন্ম-নব্বইত্তোর প্রজন্মের উদ্ভূত চেতন-অবচেতনের লড়াই। বঙ্গবন্ধুর ভাষণ আছে নেই চেতনা, মূল্যবোধ। -লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ।