সরদার মোঃ শাহীন:
মাঝে মাঝে ভাবি, বেহেস্ত থেকে আদম এবং হাওয়া (আঃ) কে সরিয়ে না দিলে আদম হাওয়া দম্পতির সন্তানদের আজকের অবস্থা কী হতো! তাদের জন্মও কি বেহেস্তেই হতো! নাকি নিঃসন্তান হিসেবে কেবল তাঁরা দু’জনায় অনন্তকাল ধরে বেহেস্তেই দিনাতিপাত করতেন! এ ধরনের জটিল ভাবনা যখন পেয়ে বসে আমায়, তখন এর সমাধান খুঁজে পাই না। পাবার কথাও না। দুনিয়া নামক আধা বেহেস্ত আর আধা দোজখে বসে সব ভাবনার সমাধান পাওয়া যায়ও না।
দুনিয়া জটিল জায়গা। জটিল এর সকল কর্মকান্ড। মানবজাতি সারাদিন ব্যস্ত থাকে জটিল এসব সমস্যার সমাধান করতে। কখনো করতে পারে, কখনো পারে না। কিন্তু সমস্যা নিয়ে তাল করতে করতে জীবনটারই তালগোল পাকিয়ে দেয়। এবং তালগোল পাকানো জীবনটা কোন রকমে পার করে দেয়। পার করে দেয় মানে, বেঁচে যায়। মরে গিয়ে বেঁচে যায়। মানব জাতির বেঁচে যাওয়া মানেই মরে যাওয়া। মরে গিয়েই মানব জাতি সত্যি সত্যি বেঁচে যায়।
বেঁচে থেকে মরার চাইতে মরে যেয়ে বেঁচে থাকাই ভাল নয় কি? মইনুলের কথাই ধরুন। বেচারা মইনুল। জাতীয় স্মৃতিসৌধের অবহেলিত ডিজাইনার মইনুল! তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল ৭টা স্তম্ভে একটা জাতির সবচেয়ে গৌরবজ্জ্বল ইতিহাস তুলে ধরা! স্মৃতিসৌধের ডিজাইন করার সম্মানী পাবার কথা ছিল ২ লাখ টাকা, আয়কর চাওয়া হয়েছিল এর ৫০%, অর্থাৎ এক লাখ টাকা।
১৯৮২ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ জাতীয় স্মৃতিসৌধ উদ্বোধন করেন সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মানুষটাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। রাষ্ট্রীয় ভিভিআইপিরা চলে যাওয়ার পর তিনি সেখানে গিয়ে জনতার কাতারে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন তাঁর অমর সৃষ্টি! এমন দৃশ্য দেখার চাইতে মরে যাওয়াই কি উত্তম ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর। তিনি এখনো মরেননি। বেঁচে আছেন।
বেঁচে আছেন চিকিৎসাবিহীন অবস্থায় কোন রকমে কষ্টেক্লিষ্টে। কেউ তাঁর খোঁজ নেয় না। বড় একজন রাষ্ট্রীয় ব্যক্তিত্ব হওয়া সত্ত্বেও তাঁর চিকিৎসা তো দূরে থাক, সামান্য খোঁজটাও কেউ নেয়না সৈয়দ মইনুল হোসেনের। খোঁজ নেবার সময় কোথায়। খোঁজ নেয়া যাদের দায়িত্ব, তারা ব্যস্ত নানান কাজে। বিশেষ করে মোড়লীপনার কাজে। শহর, নগর, বন্দর যেমন তেমন, তাদের মোড়লীপনায় গ্রামগঞ্জের লোকজনও অতিষ্ট।
এরা দেশীয় মোড়ল। বিশ্ব মোড়লও আছে। তাদের জ্বালায় পুরো বিশ্ব অতিষ্ট। এইসব মোড়লদের মোড়ল হলো বিশেষ একটি দেশ। বাংলাদেশের একটি ভাল কাজে আজ পর্যন্ত এই মোড়লকে সাথে পাওয়া যায়নি। বরং তাদের মোড়লগিরিতে ভেস্তে যেতে বসেছিল আমাদের সে সব অর্জন। ৭১ এ স্বাধীনতার বিপক্ষে ছিল তারা। প্রচন্ড মোড়লগিরি করেও আমাদের স্বাধীনতা থামিয়ে রাখতে পারেনি।
সেই ক্ষোভ আজও তাদের মনে। উপরে উপরে বন্ধুত্বের ভান করলেও বাংলার অগ্রযাত্রা কখনো মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেনি। তার প্রথম প্রকাশ ঘটায় পদ্মাসেতু করার সময়। সে কী কঠিন সময় গেছে তখন বাংলার ভাগ্যাকাশে। দেশজুড়ে একটাই নিউজ, পদ্মাসেতুতে দুর্নীতির গন্ধ পেয়েছে বড়মোড়লের হাতের পুতুল বিশ্বব্যাংক। গ্রামীণ ও বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে একটা ঢাহা মিথ্যে এবং অসত্য অভিযোগকে সামনে এনে এমন কোন পথ নেই, যে পথে বাংলাদেশ তথা বাংলার জনগণকে হেনস্তা করেনি এই মোড়ল।
পারেনি। শেষমেষ পারেনি। পদ্মাসেতু করে দেখিয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা। কয়েক বছরে সবকিছু গুছিয়ে তিনি যখন সেতুর উদ্বোধন করলেন, মাথা খারাপ হয়ে গেল মোড়ল সাহেবের। এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সে এবং তার দেশীয় দোসর। মেনে নিতে পারছে না বাংলার অভাবনীয় এই উন্নয়ন এবং গতি। তাই আবারও বাগড়া বসিয়েছে। সরকার তথা দেশকে হাতের বগলের যাতাকলে রেখে ইচ্ছেমত নিষ্পেষিত করার নিমিত্তে স্বাধীনবাংলার গলা চেপে ধরার নতুন কৌশল নিয়েছে।
এবার হাত দিয়েছে র্যাবের গলায়। নোংরা অথচ কঠিন শক্ত হাত। বোঝাই যাচ্ছে উদ্দেশ্য সুদূরপ্রসারী। ওরা কেবল দাবার প্রথম চালটি দিয়েছে। হাতে চাল আরো আছে নিশ্চয়ই। একের পর এক চাল চালিয়ে যাবে। তাদের দাবী র্যাব অপরাধী। অথচ এই র্যাবই বাংলাদেশকে জঙ্গীবাদমুক্ত করেছে। যে জঙ্গীমুক্ত করা আমেরিকা কানাডার প্রথম দাবী। জঙ্গীমুক্ত বাংলাদেশ, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান, মাদকের বিরুদ্ধে অভিযান; কী না করে র্যাব!
খুব সাধারণ একটা উদাহরণ দিচ্ছি। ২০০০-২০০৪ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্রের জন্য দুর্বিষহ সময় ছিল। যখন চলচ্চিত্র ছিল অশ্লীলতায়পূর্ণ। অশ্লীল নায়ক নায়িকারা ছিল সেলেব্রিটি আর সুস্থ ধারার শিল্পীরা ছিল নির্বাসিত। সেই জায়গা থেকে আজ একটি অশ্লীলতাহীন চলচ্চিত্র পরিবেশ নিশ্চিত করা র্যাবের কৃতিত্ব। চলচ্চিত্রকে অশ্লীলতা মুক্ত করে হাজার হাজার সুস্থ ধারার শিল্পীর মুখে হাসি ফিরিয়ে দিয়েছে। এমনি আরো কত কি!
দুঃখজনক হলো, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের কথা বলে ওরা র্যাবকে অভিযুক্ত করেছে। অথচ বঙ্গবন্ধুর খুনীদের ফিরিয়ে দিচ্ছে না। বঙ্গবন্ধুর খুনি রাশেদ চৌধুরীকে যুক্তরাষ্ট্র এবং নূর চৌধুরীকে কানাডা আশ্রয় এবং প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছে অবিরত। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত এখনো পলাতক দু’জন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় রয়েছে এটা আমরা নিশ্চিত। ওদেরকে প্রশ্রয় দেয়াটা অপরাধ না। কারণ ওরা মোড়ল। ওরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। ফাঁসির আসামী নূর চৌধুরীকে কানাডায় রাখতে পারে রাজার হালে। কেবল টাকলা মুরাদ কানাডায় ঢুকতে পারে না।
এসবেই সব কিছু পরিষ্কার হয়। পরিষ্কার হয়, কোথায়ও একটা কিন্তুর উপস্থিতি আছে। এবং সব কিন্তু ঐ এক বিন্দুতেই মিলে। বিন্দু তো একটাই, তাই মিলে। সকল খেলাই ঐ বিন্দুতে। সকল খেলাই তার। দেশবিরোধী চরম ধ্বংসাত্মক খেলায় মেতে দেশের অশান্তি করে অলরেডী শান্তির বিশ্বপদকও জুটিয়েছেন। তারপরও অপেক্ষা! আর কত অপেক্ষা করবেন তিনি? ইতোমধ্যেই সাধের ব্যাংকটাও হাতছাড়া হলো। আর তো সহ্য হয় না! হবার কথাও না। বয়স বলতে কথা। বয়স তো দিন দিন শেষের দিকেই যাচ্ছে। এখনো কিছু না হলে আর কবে হবে!
মোড়ল সাহেবদের লক্ষ্যও এক। পছন্দের মানুষকে ক্ষমতায় বসানোর এখনই সময়। এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। ৫০ বছর আগে বাংলার স্বাধীনতা ঠেকানো যায়নি, ৫ বছর আগে পদ্মাসেতুও ঠেকানো যায়নি। এটা একটা কথা হলো! তলাবিহীন ঝুড়ি এভাবে তরতর করে এগিয়ে যাবে আর তারা বসে বসে দেখবেন! এটা কিছুতেই হতে পারে না। তাই ঠেকাতে হবে। ঠেকাবার এখনই সময়। এবার ঠেকাবে উন্নয়ন। শহর, গ্রাম এবং গ্রামান্তরে হতে চলা বাংলার উন্নয়ন।
ঠেকাঠেকির এই ঢামাডোলে বাংলায় আর শান্তি আসলো না; আসবেও না। শুধু বাংলা নয়, পৃথিবীর কোথায়ও শান্তি আর আসবে না। আসবে কি করে? তাবৎ দুনিয়ার মানুষ নিজেরাই তো শান্তি চায় না। চায় অনিষ্ঠি। অন্যের অনিষ্ঠি করতে যেয়ে প্রকারান্তরে নিজের অনিষ্ঠি ডেকে আনে। শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে অশান্তি প্রতিষ্ঠা পায়। যুদ্ধ বন্ধের নামে লাভ করে যুদ্ধের বিস্তার।
বড় আজব এই পৃথিবী। শান্তি অশান্তির সম উপস্থিতি এখানে। দোজখ বেহেস্তর সব উপাদান এখানে বিদ্যমান। এখানে বেহেস্তের দুধ আছে, আবার দোজখের আগুনও আছে। রহস্যময় ব্যাপার হলো, বেহেস্তের সেই দুধ খেতে হলে দোজখের কঠিন আগুনে গরম করেই খেতে হয়। দোজখ বেহেস্তের মাঝামাঝি এই পৃথিবী বলেই এমন করে খেতে হয়!!!