Home সারাদেশ পার্বত্য চট্টগ্রামকে তথাকথিত “জেলায় উন্নীতকরণ” দিবসে খাগড়াছড়িতে আলোচনা সভা

পার্বত্য চট্টগ্রামকে তথাকথিত “জেলায় উন্নীতকরণ” দিবসে খাগড়াছড়িতে আলোচনা সভা

36

মুঘল, ব্রিটিশদের সাথে লড়াই করেই এ অঞ্চলের স্বাতন্ত্রতা অক্ষণ্ণ রেখেছিল পূর্বসূরীরা : অংগ্য মারমা

চট্টগ্রাম অফিস: মুঘল ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেই তৎসময়ে আমাদের পূর্বসূরীরা এ অঞ্চলের স্বাতন্ত্রতা অক্ষূণ্ণ রেখেছিল। আগামীতেও লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের পূর্বের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন ইউপিডিএফ’র অন্যতম সংগঠক অংগ্য মারমা।

আজ মঙ্গলবার (১ আগস্ট ২০২৩) সকাল ১০টায় খাগড়াছড়ি জেলা সদরে পার্বত্য চট্টগ্রামকে তথাকথিত “জেলায় উন্নীতকরণ” দিবস উপলক্ষে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি), হিল উইমেন্স ফেডারেশন ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের উদ্যোগে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন।

“ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের (১৮৬০-১৯৪৭) পরিণাম: পাহাড়ি জনগণের রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ, সংগঠন প্রতিষ্ঠা ও সংগ্রাম” শীর্ষক উক্ত আলোচনা সভায় প্রধান আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পিসিপির সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ও ইউপিডিএফ অন্যতম সংগঠক অংগ্য মার্মা। এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরা, চট্টগ্রাম মহানগর শাখার সভাপতি সোহেল চাকমা, খাগড়াছড়ি জেলা সভাপতি শান্ত চাকমা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সদস্য দয়াসোনা চাকমা ও গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সদস্য জুনেট চাকমা। সভা সঞ্চালনা করেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সাধারন সম্পাদক রুপান্ত চাকমা।

‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ নামকরণ সম্পর্কে ইউপিডিএফ সংগঠক অংগ্য মার্মা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম নামটি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের দেয়া। তারা নিজেদের শাসনকার্য চালানোর সুবিধার্থে আইন জারি করে তথাকথিত জেলায় উন্নীতকরণের নামে এ নামটি দিয়েছিল। কিন্তু এখানে বলা দরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম এক সময় বহিঃশক্তির নিয়ন্ত্রণমুক্ত স্বশাসিত রাজ্য ছিল। মুঘল কর্মকর্তারা এ অঞ্জলকে ‘কার্পাস’ মহল হিসেবে উল্লেখ করত। প্রাচীন লোককাহিনীতে ‘’সা- প্রেই কূল’, ফার্সি দলিলে ‘জুম মহাল বা জুম বঙ্গ’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৫৫০ সালে পর্তুগীজ ঐতিহাসিক জোয়াও ডি ব্যারেজ অঙ্কিত মানচিত্রে এ অঞ্চলকে ‘চাকোমাস’’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

তিনি আরো বলেন, এ অঞ্চলকে বহিঃশক্তি নিয়ন্ত্রণমুক্ত ও নিজেদের স্বাতন্ত্রতা বজায় রাখতে তৎকালীন আমাদের পূর্বসুরীরা মুঘল ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রাম করেছিলেন। ফলে তারা এ অঞ্চলের স্বাতন্ত্র্যতা অক্ষুণ্ণ রাখতে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর মুর্শিদাবাদের নবাবী পদ লাভের বিনিময়ে মীর কাশিম ১৭৬০ সালে ব্রিটিশদের সালে গোপন চুক্তির মাধ্যমে বর্ধমান, মেদিনীপুর ও চট্টগ্রাম ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে তুলে দেয়। কোম্পানির হাতে প্রশাসনিক দায়িত্ব হস্তান্তরের সময়ও কার্পাস মহল ব্রিটিশদের নিয়ন্ত্রনাধীনে ছিল না। সারা ভারতবর্ষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যভুক্ত হলে ১৮৬০ সালে ১ আগস্ট ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকরা কার্পাস মহলকে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’ নাম দিয়ে জেলায় রুপান্তর করে। এরপর ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জনগোষ্টীগুলো যাতে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে না পারে তার জন্য নানা আইন-কানুন ও বিধি-বিধান জারি করে।

অংগ্য মার্মা আরো বলেন, সে সময় ব্রিটিশরা কোনভাবেই লড়াইয়ে কুলিয়ে উঠতে না পেরে নিজেদের শাসন শোষনকে পাকাপোক্ত করতে এ অঞ্চলের রাজাদের তোষন করা শুরু করে। তারা রাজাদের রায়, বাহাদুর উপাধি সহ নানা উপাধিতে ভূষিত করে আস্তে আস্তে বিদ্রোহে নেতৃত্বদানকারী রাজাদেরকে সংগ্রাম থেকে দূরে ছড়িয়ে নিতে সক্ষম হয় এবং চুক্তিতে বশীভূত করে ফেলে। ফলে তারা ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত এ অঞ্চলে তাদের শাসনকার্য পরিচালনা করতে সক্ষম হয়।

ইউপিডিএফের নেতা অংগ্য মারমা তেজস্বিনী চাকমা রাণী কালিন্দীকে স্মরণ করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের ইতিহাসে চাকমা রানী কালিন্দীর ভূমিকা খুবই গুরত্বপূর্ণ। তিনি ব্রিটিশদের চাপিয়ে দেয়া শাসন মেনে নেননি। যার কারণে তৎকালীন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসক ক্যাপ্টেন লুইন ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে রাজ প্রাসাদে জোর করে ঢুকতে চাইলে রাণী কালিন্দীর রক্ষীরা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছিল। তিনি ক্ষমতাশালী ব্রিটিশ শাসক ক্যাপ্টেন লুইনের সাথে সাক্ষাৎ পর্যন্ত করেননি। শত প্রতিকূল পরিস্থিতির মাঝেও রাণী কালিন্দী তার শাসন পরিচালনা করেছিলেন এবং সাহসের সাথে তাঁর আত্মসম্মান ও মর্যাদাকে অক্ষুণ্ণ রেখেছিলেন।

বক্তারা বলেন, ব্রিটিশরা নানা আইন-কানুন জারি করে রাজনীতি, সংগঠন, সভা-সমাবেশ করার অধিকার ক্ষুণ্ণ করলেও চিরদিন কোন জাতিকে পদানত রাখা যায় না। ফলে ব্রিটিশ শাসনের শেষ দিকে এ অঞ্চলে ছাত্র-যুবকদের মধ্য থেকে সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। উন্মেষ ঘটেছিল রাজনেতিক চেতনার। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হওয়ার পরও এ অঞ্চলের মানুষের ওপর শোষণ-নিপীড়ন বন্ধ হয়নি। পাকিস্তান আমল থেকে বর্তমান পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের উপর চলছে দমন-পীড়ন। ফলে অধিকার প্রতিষ্ঠা ও অস্তিত্ব রক্ষার জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামের জনগণের লড়াই-সংগ্রাম চলমান রয়েছে।

সভায় বক্তারা, পার্বত্য চট্টগ্রামের সঠিক ইতিহাস চর্চার মাধ্যমে চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হতে এবং সংগ্রামী ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বেগবান করার আহ্বান জানান।