Home মতামত নো ম্যানস ল্যান্ড কাকে বলে?

নো ম্যানস ল্যান্ড কাকে বলে?

21

তমাল কান্তি সাহা:

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণী নাট্যচর্চা কেন্দ্র আয়োজিত ২৯তম নাট্যোৎসব সম্পন্ন হয়েছে। উৎসবে ঢাকার ‘সময় নাট্যদল’ পরিবেশন করে তাদের জনপ্রিয় প্রযোজনা ‘ভাগের মানুষ’। সাদাত হোসেন মান্টোর গল্প থেকে এটি নাট্যরূপ দিয়েছেন মান্নান হীরা। আর নির্দেশনা দিয়েছেন আলী যাকের।
গত ২৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় নদীয়ার কল্যাণীতে ঋত্বিক সদনে নাটকের প্রদর্শনীটি দেখেছি। নাটক দেখে কিছু ভাবনা মনে এলো।
মানব সভ্যতার চোখে কৃষ্ণপক্ষের রাত্রির তমসা ঘন হয়ে এলে ভাগ অঙ্কটি গণিতবিদ্যা ছেড়ে রাষ্ট্রীয় জীবনে ভাগের মানুষ অথবা মানুষের ভাগ হয়ে যায়। একটি ব্যক্তিগত নাম শেষ পর্যন্ত হয়ে দাঁড়ায় একটি ভূখণ্ড বা একটি স্থানিক নাম, যা ছিল একদা কারুর জননী জন্মভূমি। বিষাণ সিংয়ের নাম হয়ে যায় পাকিস্তানের একটি জায়গার নাম টোবা টেক সিং। কারণ যে বাস্তভিটের জল বাতাস, যে মাটির উর্বরাশক্তি তাকে লালন পালন করেছে সেই উপাদানিক ঐশ্বর্য নির্মাণ করেছে তার দেহের রক্ত মাংস তো বটেই তার শ্বাস-প্রশ্বাস চলাচলের পথ সুগম করেছে। সে তার জনয়িত্রী মাটিকে ছাড়বে কেন?
কে পাগল, কারা পাগল?পাগল কি সত্যি উন্মাদ? তার মধ্যে রয়েছে তো দেশচেতনার উন্মাদনা! ক্ষমতায়ন বা মসনদ লাভ করবার জন্য যারা দেশকে দ্বিখন্ড করে তারা মানসিক উন্মাদ, না যারা তথাকথিত মানসিক চিকিৎসালয়ে বিভিন্ন দৈহিক বিভঙ্গে আচার-আচরণে কথাবার্তায় প্রকৃত সত্যকে উন্মোচন করে তারা মানসিক বিকারগ্রস্ত? প্রকৃত খুনি হয়েও বাঁচবার তাগিদে যে পাগলখানায় আশ্রয় নেয় পাগলের অভিনয় করে সে তবে কি? পাগলের কল্পনা শক্তি কি তথাকথিত সুস্থ মানুষের চেয়েও সুদূর প্রসারিত নাহলে পাগলেরা কিভাবে যথাক্রমে মোহন চাঁদ করম চাঁদ গান্ধী, উইনস্টন চার্চিল, মোহাম্মদ আলী জিন্না, স্ট্যালিন, হিটলার,অথবা বার এট ল হয়ে যায়!

পাগলের ভেতর কি দেশপ্রেম, জন্মভূমির প্রতি ভালবাসার উজ্জীবন থাকে? তার মধ্যে কি তাকে শ্লেষ তির্যক ব্যঙ্গের ধ্রুপদী সত্য নিহিত থাকে! না হলে সে কেন বারবার উচ্চারণ করবে হিন্দুস্তান পাকিস্তান! হিন্দুস্তান পাকিস্তান? পাকিস্তান হিন্দুস্তান! পাকিস্তান হিন্দুস্তান? পাকিস্তানের অবস্থান কোথায়? আকাশের দিকে! হিন্দুস্তানের অবস্থান কোথায়? মাটির দিকে! তার চেতনায় হিন্দুস্তান পাকিস্তানের কোন অস্তিত্বই নেই।

পাগলরা জানে শুধু, তার দেশ ভারতবর্ষ এবং এটা আদি অকৃত্রিম সত্য। তাহলে হিন্দুস্তান শব্দটি এলো কোত্থেকে! পাকিস্তান শব্দটি এলো কোত্থেকে? তারা পাগল হলেও ভাবতে থাকে, যখন প্রকৃত ক্ষমতার পাগলদের মধ্যে এই দেশ সম্পর্কিত চেতনা থাকে না। তারা তো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রলোভনে হিংস্র উন্মত্ত পাগল, দাঙ্গায় রক্তাক্ত তাদের হাত।

পাগলদের দেশ কোথায়? তারা তো জাত পাত ধর্ম বর্ণের ঊর্ধ্বে। তাদের একটাই পরিচয় তারা জন্মভূমি পাগল। তাদের অনুভব একটাই এই দেশ এই মাটি এই আশ্চর্য পাগলদের। ধর্মের নয়, সম্প্রদায়ের নয়, মন্দির মসজিদ গুরুদুয়ারা গির্জা নয়, মানুষের অস্তিত্বেই দেশের অস্তিত্ব।
দেশাত্মবোধের প্রকৃত অনুভবে টোবা টেক সিংরা চায় না দেশ ভাগ। তাই হিন্দুস্তান-পাকিস্তান বিভাজন এই দস্যুর বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে টোবা টেক সিং পড়ে থাকে একটি নবজাত ভূমিতে যার নাম নো ম্যানস ল্যান্ড!

সভ্যতার বিবেক সেই মহা পাগলটি কোত্থেকে এসেছিল? এই প্রশ্ন করেছিলেন বিষণ সিং। পাগলটি মহা উত্তর দিয়েছিল, টোবা টেক সিং থেকে, যা ভারতেও নেই, পাকিস্তানেরও নেই!

দুনিয়ার পাগলামির, ক্ষমতায়নের পাগলামির নৈপুণ্যেরের কারিগর সাহিত্যের সেরা উন্মাদ সত্যদ্রষ্টা সাদাত হাসান মান্টো এই সমাজ সভ্যতার পোস্টমর্টেমের দক্ষ শল্য চিকিৎসক।
-লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক।