Home মতামত নেত্রী মনে হয় বেঁচে নাই

নেত্রী মনে হয় বেঁচে নাই

61

অপর্না পালঃ

২১ আগস্ট ২০০৪।
আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্স এর নিয়মিত ছাত্রী।
সেই সাথে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের একজন গর্বিত কর্মী।
তখন, আমি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করছিলাম, একই সাথে কেন্দ্রীয় কমিটি আমাকে সদস্য করে রেখেছিলো।
২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলীয় সভানেত্রীর এই ধরণের কোনো সমাবেশ আমি বা আমরা কখনোই মিস করতাম না। আমরা হল থেকে সহযোদ্ধাদের নিয়ে এইসব বড় সমাবেশ এ যোগ দিতাম।

তবে সেদিন পারিবারিক কারণে আমি এই সমাবেশ স্থলে সময়ের মধ্যে উপস্থিত হতে পারিনি। সিরাজগঞ্জ থেকে আমার বড়দা ও বড় বৌদি এসেছিলো। সেইদিন আমার বড় ভাইয়ের বড় ছেলে সজীব পাল, রামকৃষ্ণ মিশনের হোস্টেলে ওঠে, আমি ছিলাম ওর স্থানীয় অভিভাবক । সেই বছর আমার বড় ভাতিজা নটরডেম কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছিল।

আমি ভেবেছিলাম, এখানে শেষ করে আমি সমাবেশের পরে প্রতিবাদ মিছিলে, ( ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ থেকে ৩২ পর্যন্ত নেতা কর্মীদের হেটে যাবার কথা ছিল) অংশ নিতে পারবো। কারণ, গোপীবাগ থেকে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ আসতে সময় বেশি লাগবে না।
এর মধ্যে ইলিয়াস ভাইয়ের (সহ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) ফোন। ওপাশের আতংকিত কণ্ঠ বললো, “তুমি এদিকে এসো না, বোমা হামলা হয়েছে। নেত্রী মনে হয় বেঁচে নাই, মনে হচ্ছে সব মানুষ মারা গিয়েছে , আইভি আপা,বাহাউদ্দিন নাছিম ভাই ও বাবু ভাইয়ের(নজরুল ইসলাম বাবু, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) অবস্থা খুব খারাপ।আমি নাসিম ভাইয়ের সাথে যাচ্ছি।” সে তাৎক্ষণিক যতটুকু দেখেছিলো বলেছে। (পরবর্তীতে ইলিয়াস ভাইয়ের মুখে শুনেছি, সেও সেন্টু ভাইয়ের পাশেই ছিল, কাকতলীয় ভাবে সে অক্ষত আছে।) তখন যে আমার কি অবস্থা আমি এখানে ব্যাখ্যা করতে পারবো না। আমি শুধু বললাম, আমাকে যেতে হবে, দলীয় কার্যালয়ে বোমা হামলা হয়েছে।
আমার বড়দা বললো, আমি তোমাকে যেতে দিবো না, আমাদের সাথে রাতেই তুমি সিরাজগঞ্জ যাবে। (এটাই স্বাভাবিক বড় ভাই হিসাবে)

আমার বড়দার ঘনিষ্ট বন্ধু প্রণব নিয়োগী( সাবেক অতিরিক্ত সচিব) দাদা বললেন, “কি বলিস, অপর্ণা একটি দল করে, সেই দলের আজ দুঃসময়, ওকে এখন দলের দরকার, ওকে যেতে দে”।
প্রণব দা আমাকে নিয়ে বাইরে আসলো রিক্সা ভাড়া করে দেবার জন্য। পরে ইত্তেফাক মোড়ে এসে রিক্সা পেলাম।

ইতিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি, দেলোয়ার হোসেন ও সাধারণ সম্পাদক, হেমায়েত উদ্দিন খান হিমুর ফোন পেলাম। নিৰ্দেশনা হলে যাও, যারা আহত, তাদের অনেক রক্ত লাগবে, ম্যানেজ করো।ইতিমধ্যে খবর পেয়েছি, মহান সৃষ্টিকর্তা নেত্রীকে রক্ষা করেছেন।

আমি হলের দিকে যেতে থাকলাম, এত বড় নৃশংস ও ভয়ঙ্কর ঘটনার পরে আমার মনে হচ্ছিলো চারপাশের সবকিছু থমকে গিয়েছে। আমি ক্যাম্পাস থেকে আমার জন্য অপেক্ষারত আমার দুই সহযোদ্ধা,একজন তৎকালীন বাংলাদেশ কুয়েত মৈত্রী হলের সভাপতি, শারমিন জাহান ও আরেকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের অর্থ সম্পাদক খাদিজা ফারজানা রিভাকে আমার রিকশায় তুলে নেই।

তিন জন্যে ছুটে গেলাম ঢাকা মেডিক্যাল এর ইমার্জেন্সির উদ্দেশে, কিন্তু শহীদ মিনার থেকে কিছু দূর গিয়ে আর যেতে পারলাম না পুলিশের বেপরোয়া লাঠি চার্জ এর কারণে। আমরা তারপর গেলাম সেন্ট্রাল হসপিটালে, পঙ্গু হাসপাতালে গিয়ে আমরা সেন্টু ভাই ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের একজন কর্মীর নিথর দেহ দেখতে পেলাম।
ধানমন্ডির আরো একটি হাসপাতাল হয়ে আমরা চলে গেলাম ক্যান্টনমেন্টের সি এম এইচ এর সম্মুখে(ভিতরে না), সবার পরে সিকদার মেডিকেল।
প্রত্যেকটি হাসপাতালের দৃশ্য ছিল করুন, আহত নেতা কর্মীদের গগন বিদারী চিৎকারে পরিবেশ ছিল ভারী। আর যারা সেদিন উপস্থিত ছিলেন, তারাও বাকরুদ্ধ। আমাদের মধ্যে থেকে যে কেউ আজ আমরা চলে যেতে পারতাম।
হলে যখন ফিরলাম অনেক রাত, আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো হলের আবাসিক শিক্ষিকা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমাকে হাত ধরে হলের ভিতর নিয়ে গেলো, আমি বারান্দায় বসেই এত সময়ের চেপে থাকা কষ্ঠ আর ধরে রাখতে পারলাম না, পাগলের মতো কাঁদতে থাকলাম। আজ যদি নেত্রীর কিছু হতো, আমাদের কি হতো? দলীয় সভানেত্রীকে হত্যার উদ্দেশেই তো হায়েনারা তৎকালীন রাষ্ট্রীয় মদদে এই ধরণের নিকৃষ্ট বর্বর ঘটনা ঘটিয়েছে।

*পরের দিন আমি ২২ শে অগাস্ট সুধাসদনে যাই, নেত্রী কেমন আছে জানার জন্য। যেহেতু দেশরত্নই তাদের টার্গেট ছিল এবং নেত্রীও আহত ছিল, দেখা হবে না জানি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুলতানা শফি ম্যাডামকে দেখতে পেলাম, উনিও এসেছিলেন আমার মতো মনের তাড়নায়। ম্যাডাম আমাকে বললো,”চলো তোমাকে ক্যাম্পাসে নামিয়ে দেই”।

আওয়ামী লীগ তখনো কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করেনি কারণ ঘটনাটি ছিল আকস্মিক এবং বেশির ভাগ কেন্দ্রীয় নেতাই এই হামলার শিকার হয়েছিল, তাছাড়াও আইনি বিষয়গুলিও ছিল(তৎকালীন সরকার মামলা নিতে গড়িমসি) কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ এই ঘটনায় এতটাই হতবাক হয়েছিল যে তারা সবকিছু বন্ধ রেখেছিলো। মনে হয়েছিল মানুষের এটি ছিল বি এন পি, জামাত জোট সরকারের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ।

*২৩ অগাস্ট সকাল থেকেই বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সুধাসদনের সম্মুখে অবস্থান করে। কারণ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া আমাদের আহত দলীয় প্রধানকে দেখতে আসতে চেয়েছিলো। এই খবর আমরা জানতে পেরে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ সহ অন্যান্য সহযোগী ও অঙ্গ সংগঠনের নেতা কর্মীরা সুধাসদনের সামনে জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করি ও প্রতিরোধ গড়ে তুলি।
ইতিমধ্যে বাংলার আপামর জনতা জেনে গিয়েছিলো এই ডাবল স্ট্যান্ডার্ড ড্রামা।

পরবর্তীতে, নেত্রীকে হত্যা চেষ্টা এবং এই গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে হরতাল, ধর্মঘটসহ বিভিন্ন কর্মসূচি আসে দলীয়ভাবে। তৎকালীন সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সরাসরি ইন্ধনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল আওয়ামী লীগের সভাপতিকে হত্যার উদ্দেশে এই গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। যারা বাংলাদেশকে বিস্বাস করেনা, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে কখনো মেনে নিতে পারেনি, যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রাকে কখনও চায় না ……সেই সব হায়েনারা এবং তাদের দোসররা এই হামলা চালায়। তৎকালীন বিএনপি জামাত জোট সরকার প্রত্যক্ষভাবে এই হামলার সাথে জড়িত ছিল।
অনেক নাটকীয়তার পরে সুদীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এই হামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এই রায় কার্যকর করা এখন সময়ের দাবী।
জয় বাংলা
জয় বঙ্গবন্ধু
জয়তু শেখ হাসিনা

-লেখকঃ সাবেক সহ-সভাপতি, বাংলাদেশ ছাত্র লীগ।