Home জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়ার সম্ভাবনা দেখছে না টিআইবি

নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়ার সম্ভাবনা দেখছে না টিআইবি

25

স্টাফ রিপোটার: ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না এবং এমন নির্বাচনের ওপর জনগণের আস্থা নিশ্চিত করা অসম্ভব।’ গণতন্ত্র, সুশাসন ও শুদ্ধাচার চর্চার রাজনৈতিক অঙ্গীকার বিষয়ে সুপারিশমালা উপস্থাপন উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এমন উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চর্চার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ নিশ্চিতের লক্ষ্যে কার্যকর সংসদ প্রতিষ্ঠা, রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমে গণতন্ত্র, সুশাসন ও শুদ্ধাচার নিশ্চিতে ৭৬টি সুপারিশ করেছে টিআইবি।

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, টিআইবির আউটরিচ অ্যান্ড কমিউনিকেশন বিভাগের পরিচালক শেখ মনজুর-ই-আলম এবং গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। সংবাদ সম্মেলনে সুপারিশটি উপস্থাপনা করেন টিআইবির রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট কাওসার আহমেদ।

সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে ও পরবর্তী সময় পর্যালোচনার ভিত্তিতে এ ধারণা আমাদের হয়েছে- অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে আমরা যা বুঝি, তা এবারও পাওয়া যাচ্ছে না। এটি অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। ভোটের অধিকারভিত্তিক নির্বাচন প্রতিষ্ঠা করা এবং এই নির্বাচনের ওপর জনআস্থা নিশ্চিত করাও অসম্ভব বলে আমরা মনে করি।’ টিআইবির সুপারিশামালায়ও বিষয়টির ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।

পাশাপাশি সুষ্ঠু, দলীয় প্রভাবমুক্ত ও নিরপেক্ষভাবে সংসদীয় ও সরকারি কার্যক্রম পরিচালনা করতে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণকালে দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগের বিধান; সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে নিজ দলের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব ও বাজেট ব্যতীত, অন্যান্য আইন প্রণয়নসহ অন্য সকল ক্ষেত্রে সদস্যদের নিজ দল সম্পর্কে সমালোচনা ও দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টির সুপারিশ উল্লেখ করে ড. জামান বলেন, ‘অর্ধশতাব্দী যাবৎ আমরা আসনভিত্তিক সংসদীয় ব্যবস্থার চর্চা করছি। এখন আনুপাতিক প্রতিনিধিত্বমূলক সংসদীয় ব্যবস্থার চর্চা করার সময় এসেছে। সংসদীয় ব্যবস্থাকে কার্যকর করতে প্রয়োজন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করা। এজন্য নির্বাচনকালীন সরকার এবং অন্যান্য সকল অংশীজন বিশেষ করে প্রশাসন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার স্বার্থের দ্ব›দ্বমুক্ত ও দলীয় প্রভাবমুক্ত ভূমিকা প্রয়োজন, যা নিশ্চিত করতে আইনি সংস্কার জরুরি।’

স্বাধীন, শক্তিশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সকল কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে আইনে অন্তর্ভুক্ত যোগ্যতা ও অযোগ্যতার শর্তাবলি যথাযথভাবে অনুসরণ করা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিতে অনুসন্ধান কমিটি কর্তৃক গণশুনানি; গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (সংশোধনী) ২০২৩-এর ৯১ (এ) সংশোধনের মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট সংসদীয় আসনের পূর্ণাঙ্গ ফলাফল বাতিল করার ক্ষমতা রহিত করার মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সংকুচিত করার এই ধারা পরিবর্তন, প্রতিযোগিতার সমান ক্ষেত্র (লেভেল প্লেইং ফিল্ড) নিশ্চিতে নির্বাচন-পূর্ব সময়ে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যগণের নির্বাচনকেন্দ্রিক আচরণ বিধি সুস্পষ্ট করা এবং সকল দল ও প্রার্থীর প্রচারণার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা; জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের সকল নির্বাচনে ‘না’ ভোটের পুনঃপ্রচলনের সুপারিশ করেছে টিআইবি।

রাজনৈতিক দলের কার্যক্রমে গণতন্ত্র, সুশাসন ও শুদ্ধাচার চর্চা রাজনৈতিক দলের সকল প্রকার গৃহীত অনুদান, আয়-ব্যয়, বিশেষ কার্যক্রমভিত্তিক সংগৃহীত অর্থ ও ব্যয়, প্রচারণাসহ নির্বাচনী ব্যয়, মনোনয়ন কেন্দ্রিক আর্থিক লেনদেনকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ও তদারকি ব্যবস্থার আওতায় নিয়ে আসতে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার; রাজনৈতিক দলসমূহের আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষা প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনের কাছে জমা দেওয়া ও নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা; রাজনৈতিক দলসমূহের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে দলের কেন্দ্রীয়/নীতি নির্ধারনী পর্যায়ের নেতাদের সম্পদের হিসাব জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা; সকল রাজনৈতিক দলের কমিটিতে অন্তত এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা, নির্বাচনে ন্যূনতম এক-তৃতীয়াংশ নারী সদস্যকে মনোনয়ন প্রদান এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে প্রার্থী মনোনয়ন বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে টিআইবি। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব ও প্রতিনিধিত্বের ক্ষেত্রে জেন্ডার, ধর্মীয়, নৃতাত্ত্বিক, শারীরিক প্রতিবন্ধকতা এবং অন্যান্য মাপকাঠিতে প্রান্তিকতার শিকার নাগরিকদের যথাযথ রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। অর্থ ও পেশী শক্তির বিনিময়ে মনোনয়নের সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে এসে দলের প্রতি অবদানকে গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে যারা দীর্ঘদিন ধরে জনকল্যাণমুখী রাজনীতি করেন তারা নিজেদের বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি মনে করেন। এ অবস্থার পরিবর্তন রাজনৈতিক দলকেই করতে হবে।’

টিআইবির সুপারিশমালায় বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা, প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বাধীনভাবে পরিচালনার জন্য বিচার বিভাগের নিজস্ব সচিবালয় স্থাপন, অধস্তন আদালতের নিয়োগ, পদোন্নতি ও বদলিসহ সার্বিক নিয়ন্ত্রণ ও তত্তাবধান এককভাবে সুপ্রিম কোর্টের সচিবালয়ের ওপর ন্যস্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি শক্তিশালী মানবাধিকার কমিশন প্রতিষ্ঠা, বিচারবর্হিভ‚ত হত্যাকান্ড, গুমসহ সকল মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্তের ক্ষেত্রে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে এখতিয়ার প্রদান; আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোকে আধুনিকায়নের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতে যুগপোযোগী পুলিশ আইন প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন; আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাসমূহের সদস্যদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনিয়ম-দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পুলিশ কর্তৃপক্ষের বাইরে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা হিসেবে একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে সুপারিশ করেছে টিআইবি। একইসঙ্গে, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে জনপ্রশাসনের কার্যক্রমে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতাসহ সুশাসন নিশ্চিত করা; দুর্নীতির মাধ্যমে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচার বিষয়ে তদন্ত ও ব্যবস্থা গ্রহণে দুদকের ক্ষমতাকে খর্ব করে আইনের এমন সংশ্লিষ্ট ধারা সংশোধন করা; দুদকের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাসহ জনবল নিয়োগ, পদায়ন ও বদলির ক্ষমতা দুদক সচিবের নিকট থেকে সরিয়ে কমিশনের হাতে ন্যস্ত করতে দুদকের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা অর্পণ আদেশ বাতিল করা ও দুদকের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় পরিচালক হতে উচ্চ পদসমূহে প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণের মাধ্যমে পদায়ন বন্ধ করতে সুপারিশ করেছে টিআইবি।

টিআইবি প্রণীত সুপারিমালায় নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, তথ্য অধিকার, তথ্য ও উপাত্ত সুরক্ষা নিশ্চিত করা ও স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করার জন্য প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়া, আর্থিক খাত ও সরকারি ব্যয়ে সুশাসন, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত, পরিবেশ সংরক্ষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সুস্পষ্ট সুপারিশ করেছে সংস্থাটি। গণমাধ্যম, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নিশ্চিতে এদের পরিপন্থী আইন সংস্কার এবং নজরদারিমূলক সমাজ ব্যবস্থা থেকে সরে এসে সরকারকে গণমাধ্যম ও নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিতেরও আহবান জানানো হয়েছে টিআইবির পক্ষ থেকে।