Home জাতীয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক হয়নি: টিআইবি

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অবাধ ও অন্তর্ভূক্তিমূলক হয়নি: টিআইবি

15

স্টাফ রিপোটার: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন একপাক্ষিক ও পাতানো প্রতিযোগিতাপূর্ণ হয়েছে; অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। নির্বাচনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিসহ সার্বিক অভিজ্ঞতা বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ভবিষ্যতের জন্য অশনি সংকেত বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া ট্র্যাকিং” শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, এই নির্বাচন বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনা ও স্বপ্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ধারণা অর্থাৎ অবাধ, অংশগ্রহণমূলক, নিরপেক্ষ ও সর্বোপরি সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র নিশ্চিতের পূর্বশর্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিপালিত হয়নি উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের পরস্পর বিপরীতমুখী ও অনড় অবস্থানের কারণে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হয়নি। যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জিম্মিদশা প্রকট করে তুলেছে। এ নির্বাচন বাংলাদেশের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার চেতনা ও স্বপ্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। অর্থবহ রাজনৈতিক প্রতিপক্ষহীন নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী, একই দলের ‘স্বতন্ত্র’ ও অন্য দলের সরকার সমর্থিত প্রার্থীদের যে “পাতানো খেলা” সংগঠিত হয়েছে, তাতেও ব্যাপক আচরণবিধি লঙ্ঘনসহ অসুস্থ ও সহিংস প্রতিযোগিতা হয়েছে। এর সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্বের বাইরে রাজনৈতিক আদর্শ বা জনস্বার্থের সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া কঠিন। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গন ও শাসনব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চূড়ান্ত প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতার জবাবদিহিহীন প্রয়োগের পথ আরও প্রসারিত হয়েছে।’

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের ভবিষ্যতের জন্য “অশনি সংকেত” উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, ‘ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ক্ষমতা অব্যাহত রাখার কৌশল বাস্তবায়নের একতরফা নির্বাচন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। যার আইনগত বৈধতা নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ হয়তো হবে না, হলেও টিকবে না। তবে তাদের এ সাফল্য রাজনৈতিক শুদ্ধাচার, গণতান্ত্রিক ও নৈতিকতার মানদণ্ডে চিরকাল প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে। দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের নির্বাচনী অঙ্গীকার আরও বেশি অবাস্তব ও কাগুজে দলিলে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সরকারের টানা চতুর্থ মেয়াদের সম্ভাব্য সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে যতটুকু আগ্রহ থাকবে, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হবে শুদ্ধাচার ও নৈতিকতার মানদণ্ডে সরকারের প্রতি জনআস্থা এবং গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন ও তার প্রভাব। একইসঙ্গে, ক্রমাগত গভীরতর হবে দেশের গণতান্ত্রিক ও নির্বাচনী ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ। ’

গণতন্ত্রকামী মানুষের বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কী করণীয় ও বর্জনীয় তার বিশ্লেষণ, বিশেষ করে গণতান্ত্রিক অবনমনের অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচনী কৌশল ও অভিনবত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক টেষ্ট-কেইস হিসেবে বিবেচিত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক।

টিআইবির গবেষণায় নমুনা হিসেবে অন্তর্ভূক্ত ৫০টি আসনে শতভাগ ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগ মনোনিত শতভাগ প্রার্থী কর্তৃক ন্যূনতম একবার হলেও কোনো না কোনো নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন। স্বতন্ত্র (আওয়ামী লীগ) প্রার্থীর ৯৭.৩ শতাংশ, অন্যান্য স্বতন্ত্র প্রার্থীর ৮৭.৫ শতাংশ, জাতীয় পার্টির প্রার্থীর ৮৪.৯ শতাংশ, অন্যান্য দলের প্রার্থীর ৮০ শতাংশ ও তৃণমূল বিএনপির প্রার্থীর ৭৫ শতাংশ নির্বাচনী আচরণবিধি ভঙ্গ করেছেন।

গবেষণায় দেখা যায়, ৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিতে ক্ষমতাসীন দল ঘোষিত লক্ষ্য পূরণে বিভিন্নভাবে বলপ্রয়োগ করা হয়। ক্ষমতাসীন দলের সভায় না এলে, ভোট কেন্দ্রে না গেলে এবং নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট না দিলে নির্বাচনের পর সাধারণ ভোটারসহ প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সরকারি সেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা বন্ধের হুমকি প্রদানের ঘটনা রয়েছে। আবার, সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য ও পক্ষপাতমূলক কার্যক্রমে অংশ নেওয়াসহ ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন ও প্রচারণায় অংশগ্রহণের ঘটনা রয়েছে। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীর (আওয়ামী লীগ) মধ্যে নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতার পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থীর কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা, কর্মী ও সমর্থকের বাড়িতে হামলা, গুলি ও আগুন দেওয়া, গাড়িবহরে হামলা, ক্যাম্পে হামলা, পোষ্টার ছেঁড়া, যানবাহন ভাঙচুর ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছে।

গবেষণায় উঠে এসেছে, মোবাইলে এসএমএস প্রদান, ফেসবুকে প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারের বিবিধ উন্নয়নমূলক কাজের প্রচারণার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম বিটিভিকে একচেটিয়া ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দলের প্রচার-প্রচারণা ও সভা-সমাবেশের খবর প্রচার করা হয়েছে। আবার বেসরকারি সংবাদ মাধ্যমগুলোতে হরতাল-অবরোধ-অগ্নিকান্ড ও নির্বাচন বর্জনের খবরসহ বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি এই বিষয়ক সরকার দলীয় নেতাদের বক্তব্য অধিক প্রচার করা হয়েছে। ৫ ডিসেম্বর ২০২৩ – ৫ জানুয়ারী ২০২৪ পর্যন্ত বিটিভি’র রাত ৮ টার খবরে নির্বাচন সম্পর্কিত সংবাদে মোট ব্যয়িত সময় ৪৯৩ মিনিট ২৭ সেকেন্ড এবং এ বাবদ প্রাক্কলিত মোট আর্থিক মূল্য ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী বিষয়ক সংবাদ ১১৫ মিনিট ৫১ সেকেন্ড, যার অর্থমূল্য ১ কোটি ৪ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ টাকা।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, রাজনৈতিক কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরিসহ বিরোধী দলকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কৌশল হিসেবে সভা-সমাবেশে বিবিধ শর্ত প্রদান, নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার ও রাজনৈতিক হয়রানি মামলা প্রদান, দ্রুততার সঙ্গে বিচার ও সাজা প্রদানে রাতে বিচারকার্য পরিচালনা করার ঘটনা ঘটেছে। তফসিল ঘোষণার আগে বিরোধী দলের সক্রিয় ও নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নামে নতুন এবং পুরাতন মামলায় গ্রেফতার ও সাজা প্রদান- এ সকল কাজে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে। বিএনপিসহ ১৫টি নিবন্ধিত দলের অনুপস্থিতি ও তাদের নির্বাচন বর্জনের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি বৃদ্ধি, নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং উৎসবমুখর দেখাতে ক্ষমতাসীন দলের নানাবিধ কৌশল গ্রহণ করে। সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবং জোটভুক্ত কয়েকটি দলের সঙ্গে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের আসন ভাগাভাগি ও সমঝোতা, স্বতন্ত্র ও জোটের মধ্যে থেকে অনুগতদের বিরোধী দল হিসেবে রাখার কৌশল নেওয়া হয়। যদিও ২৪১ আসনে নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়নি, এ সব আসনে বিজয়ী প্রার্থীর সঙ্গে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর ভোট ব্যবধান গড়ে এক লাখের বেশি।

নির্বাচনে সারাদেশে অধিকাংশ কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থী ছাড়া অন্য দলের প্রার্থীদের পোলিং এজেন্ট না থাকা; প্রতিপক্ষ প্রার্থীর এজেন্টদের হুমকির মাধ্যমে কেন্দ্রে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখা, ভোটার স্বল্পতা, ডামি লাইন তৈরি, অন্য প্রার্থীর এজেন্ট বের করে দেওয়া, ভোটের আগেই ব্যালটে সিল মারা, ভোট চলাকালে প্রকাশ্য সিল মারাসহ বিভিন্ন অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

গবেষণায় নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়েও নানাবিধ প্রশ্ন রয়েছে। আগের নির্বাচনের তুলনায় ভোটার বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ হওয়া, সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস, নতুন দলের নিবন্ধন, কমিশনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি, সংলাপের প্রাপ্ত সুপারিশ আমলে নিতে নির্লিপ্ততাসহ নানাবিধ বিতর্ক রয়েছে। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু করতে সংবিধানে প্রদত্ত ১২৬নং অনুচ্ছেদের ক্ষমতা বা ম্যান্ডেট রাজনৈতিক সঙ্কট সমাধানে ব্যবহার করেনি কমিশন। আবার, নির্বাচনের বাজেট ১৪৪৫ কোটি টাকা হলেও ব্যয় বেড়ে ২২৭৬ কোটি টাকা হয়েছে, যা একাদশ নির্বাচনের তুলনায় তিনগুণ।

টিআইবি আয়োজিত এই সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা-নির্বাহী ব্যবস্থাপনা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ বদিউজ্জামান। সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি উপস্থাপনা করেন সংস্থাটির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মাহ্ফুজুল হক, রিসার্চ ফেলো নেওয়াজুল মওলা এবং ডেটা অ্যানালিস্ট সাজেদুল ইসলাম। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া কতটুকু অবাধ, স্বচ্ছ, সকলের জন্য নিরপেক্ষ ও সমপ্রতিযোগিতামূলক, অংশগ্রহণমূলক এবং প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ তা ট্র্যাকিংয়ের উদ্দেশ্যে গবেষণাটি পরিচালনা করা হয়। মিশ্র পদ্ধতির এই গবেষণায় দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৫০টি নির্বাচনী আসন নির্বাচন করে জুন ২০২৩ থেকে জানুয়ারি ২০২৪ পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণপূর্বক প্রতিবেদনটি প্রণয়ন করা হয়।