Home শিক্ষা ও ক্যাম্পাস দুর্ভাগ্যজনক রহস্যে ঘেরা আগস্ট মাস!!

দুর্ভাগ্যজনক রহস্যে ঘেরা আগস্ট মাস!!

159

সরদার মোঃ শাহীন:

পঁচাত্তরের আগস্ট পরবর্তী সময়কার কথা। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে ক্লাস ফোরে পড়ি। গ্রামেই থাকতাম আমরা। বছরে এক আধবার বাবামায়ের সাথে ঢাকায় বেড়াতে গেলে এক আত্মীয়ের বাসায় উঠতাম। মোটামুটি নিকটাত্মীয়ই বলা চলে। তখনকার সময়টাই ছিল এমন। গাট্টিবোচকা নিয়ে দলবেঁধে গিয়ে ওঠা যায়, ক’দিন থাকা যায়, এমন বাসায়ই যেয়ে গ্রামের আত্মীয়রা উঠতো। যার বাসায় যেয়ে উঠতো, তিনি বা তাঁরা কাছের না দূরের আত্মীয়, সেটা বিবেচ্য ছিল না মোটেও।
আমরা যার বাসায় যেয়ে উঠতাম, মানুষ হিসেবে তিনি সাংঘাতিক রকমের হাস্যরস প্রিয়, সংস্কৃতি এবং সাহিত্যমনা ছিলেন। উচ্চমানের রসবোধের জন্যে প্রচন্ড আড্ডাবাজ মানুষটি ছিলেন সবার প্রিয়। পন্ডিততুল্য এই মানুষটি অফিস থেকে ফিরে প্রায় সন্ধ্যায় বাসার সবাইকে নিয়ে আসর জমাতেন। আমাদেরকে পেয়েও তিনি তেমনি এক মজার আসর জমালেন।
আসরে তখনকার রাজনীতির ক্রেজ মেজর জলিলও ছিলেন। ছেলেবেলায় জলিল ছিলেন ওনার সাক্ষাত ছাত্র। সেই সুবাদেই জলিলের অবাধ আসা-যাওয়া ছিল তাঁর বাসায়। একবার নয়, একাধিক বার আমি জলিলকে তাঁর বাসায় ঘরোয়া পরিবেশে, ঘরোয়া আড্ডায় দেখেছি। ঝাঁকরা চুলের এই মানুষটিও গল্প বলায় অংশ নিতেন। সেদিনের আসরে মেজর জলিল হাসতে হাসতে স্যাটায়ারধর্মী একটা গল্প বললেন। গল্পটা ছিল এই রকম;
“শেখ মুজিব মারা গেছেন। কিন্তু কবরে তাঁর কোন কাজকর্ম নেই। একা একা শুয়ে-বসে কতক্ষণ থাকা যায়। কিন্তু তিনি তো বকবক করা ছাড়া থাকতে পারেন না। তাই সারাক্ষণই বকবক করেন। বকবক আর কী! শুধু ৭ই মার্চের ভাষণ, ভায়েরা আমার ….। এসবে ফেরেস্তারা বিরক্ত হয়ে তাঁকে ভাষণ দিতে বারণ করেন। কিন্তু সে তো থামার মানুষ না। শেষমেষ ফেরেস্তারা যেই না তাঁর মাথার পাশে একটা ডালিম গাছ লাগিয়ে দেন, অমনি তাঁর ভাষণ থেমে যায়। তিনি একেবারে চুপ হয়ে যান।”
বলেই থামলেন জলিল সাহেব। তারপর হাসি। অট্টহাসি যাকে বলে। তিনি হো হো করে হাসছেন। হাসছে বাসার সবাই। খুবই মজা পেয়েই হাসছে। ডালিম নামক গাছটির ক্ষমতা দেখে হাসছে। পাশে বসে হাসছেন তাঁর সঙ্গে থাকা বন্ধুতুল্য আরো একজন মানুষ। তবে তিনি হো হো করে নয়। মুচকী হাসি হাসছেন। তিনি দাদা ভাই; সিরাজুল আলম খান। আসরে মেজর জলিল একাই কথা বলতেন। কিন্তু সিরাজুল আলম বলতেন না। তিনি শুধু শুনতেন, তবে হাসতেন কম। এক ধরণের রহস্যময়তা যাকে বলে।
রহস্যময়তা কার মধ্যে ছিল না! জাতির জনককে নির্মম ভাবে খুন করে সাতসকালে রশিদ-ফারুক সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমানের বাসায় যেয়ে উঠলো। তখন কিন্তু সেনাপ্রধানও ছিলেন একজন। তারা তাঁর বাসায় গেল না; আর কোন বাসাও পেল না যাবার মত। কিংবা রিপোর্ট করার মত আর কাউকেই পেলো না। শুধু জিয়াকেই পেল। সরাসরি জিয়ার বাথরুমে ঢুকে পড়ার অনুমতিও পেল।
মর্নিং শেভিং এ ব্যস্ত জিয়া গ্লাসের দিকে তাকিয়ে শেভ করছেন আর শুনে যাচ্ছেন দুই খুনীর কথা। কোন ভাবলেশ নেই তাঁর মধ্যে। এমন ভাবে শুনছেন যেন বাড়ির রাখালের খবর নিচ্ছেন। এমন ভাবে রিয়্যাক্ট করছেন যেন তিনি মানুষ নন; একটা রোবট। মেইড ইন বাংলাদেশী রোবট। ওদের সব কথা শেষে রোবটরূপী জিয়া খুবই নির্লিপ্ত এবং উদাসীন ভাবে বললেন, প্রেসিডেন্ট ইজ কিলড! সো হোয়াট? ভাইস প্রেসিডেন্ট ইজ দেয়ার! ভাবখানা এমন যেন একজন প্রেসিডেন্ট নয়; যদুমধু খুন হয়েছে।
বঙ্গবন্ধু যদুমধু ছিলেন না। ছিলেন জাতির জনক। জনকের মৃত্যু সংবাদে জিয়ার সেই মুহূর্তের আচরণ যেমন কঠিন রহস্যে ভরা ছিল, জলিলের আচরণও ছিল তেমনি রহস্যমাখা। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশের প্রথম বারোটা বাজিয়েছে এই মেজর জলিল গং। আসম রবকে নিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শে দল করলেন। নাম দিলেন জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ)। তারপর শুরু করলেন অশুদ্ধ রাজনীতি; অনৈতিকতার বেড়াজালে রাজনীতির নামে অনাচার, অবিচার।
সারাদেশের যুব সমাজকে কাছে ভিড়াতে সব অপকর্মই তারা করলেন। প্রলোভন দেখিয়ে এক আজগুবি রাজনৈতিক আদর্শ তুলে ধরলেন সদ্য স্বাধীন দেশের উঠতি যুব সমাজকে। অস্ত্র তুলে দিলেন ওদের হাতে। তারা শহর এবং গ্রামেগঞ্জে ছড়িয়ে পড়লো। গ্রামবাংলা হয়ে উঠলো বিপজ্জনক রকমের উত্তপ্ত। আন্ডার ওয়ার্ল্ডের “সর্বহারা”প্রধান সিরাজ সিকদারকেও পাশে রাখলো জাসদ। এই দুইয়ে মিলে ব্যাংক লুট, পাটের গুদামে আগুন, রেলস্টেশন পুড়িয়ে ফেলা, ঘরে ঘরে ডাকাতি করা শুরু করলো সারা বাংলায়। পুরো বাংলাকে টালমাটাল করে তোলা হলো। দেশকে ধ্বংস করে বঙ্গবন্ধুকে চরম বিপদে ফেলতেই এসব করা হলো। দেয়ালে দেয়ালে চিকামারা হলো। বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ্য করে তুই তুকারির ভাষায় সে সব চিকামারা; ভাত দে, কাজ দে; নইলে গদি ছেড়ে দে।
রব-জলিলের নেতৃত্বে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের এমনতর চরম নোংরা রূপ দেখলো দেশবাসী। শুধু নোংরা নয়; বলা চলে ভয়ানক ধ্বংসাত্মক রূপ। এই রূপের প্রধান নকশাকারী ছিলেন তথাকথিত “রাজনীতির রহস্য পুরুষ” সদ্য প্রয়াত সিরাজুল আলম খান। তিনিই ছিলেন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র নামক কনসেপ্টের মাস্টার প্ল্যানার। সদ্য স্বাধীন দেশকে ধ্বংস করার নাটের গুরু। সারাজীবন ফ্রন্টলাইনে না থেকে, থেকেছেন পেছনে। পেছন থেকেই কুভাবনা দিয়েছেন, কুবুদ্ধি দিয়েছেন। দিয়েছেন মহা পরিকল্পনা।
স্বাধীন বাংলার রূপকল্প তৈরীতে বঙ্গবন্ধুর সহকারি হিসেবে তিনিও ছিলেন একজন অন্যতম আর্কিটেক্ট। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রশক্তির নিউক্লিয়াস সেলেরও প্রধান ছিলেন। একদিন প্রচন্ড চিকনা বুদ্ধি সম্পন্ন এই মানুষটির হাতে স্বাধীন বাংলা গড়ার তুলি ছিল। সেই তিনিই স্বাধীনতা লাভের পরপরই বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের ধোঁয়া তুলে দেশের যুব সমাজ তথা সদ্য স্বাধীন দেশের বারোটা বাজিয়ে দিলেন। সারা বাংলায় রক্তের বন্যা বইয়ে দিলেন। যুবসমাজকে ভুল পথে পরিচালিত করলেন। আর বঙ্গবন্ধু হত্যায় রাখলেন রহস্যময় ভূমিকা। রইলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি যা করতেন, সব পেছন থেকেই করতেন। বরাবরই রহস্যময়তার মধ্যে থাকতেন। নিজে নাচতেন না কখনোই। সবাইকে নাচাতেন।
আর এই ওনাকেই মিডিয়া “রহস্যময় রাজনৈতিক”খেতাব দিয়ে তার সন্দেহজনক রহস্যময়তাকে ভক্তি ভরে গূঢ়চারীর গুণ হিসেবে এতদিন প্রচার করেছে। রাজনীতিতে রহস্যময়তার কোন জায়গা পৃথিবীর কোথায়ও নেই। রাজনীতিতে রহস্যময়তা কখনো শুদ্ধ আচরণ হতে পারে না। কোনো রহস্যই রাজনীতিতে গ্রহণযোগ্য নয়। রহস্যজনক হয়ে ওঠা একজন রাজনীতিকের জন্য অত্যন্ত সন্দেহজনক। সকল সময় সকল সন্দেহের উর্ধ্বে রেখে আমৃত্যু রহস্যমুক্ত থাকাই একজন রাজনীতিকের অন্যতম দায়িত্ব।
জীবনভর তাঁকে একটা খোলা বই হিসেবেই জনগণের সামনে থাকতে হবে। মনে রাখা দরকার, কাউকে পা ধরে রাজনীতিতে নিয়ে আসা হয় না। কেউ কাউকে রাজনীতিতে নিয়োগও দেয় না। রাজনীতি যিনি করতে আসেন, তিনি তাঁর অবশিষ্ট জীবনের সবটা মানুষের জন্য উৎসর্গ করার অঘোষিত ঘোষণা দিয়েই আসেন বলে ধরে নেওয়া হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তেমনি ব্রত নিয়েই রাজনীতিতে এসেছিলেন। পুরোটা জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্যে; দেশের মানুষের জন্যে। পরিবারকে সময় দিতে পারেননি তেমন করে। জেল খেটেছেন বছরের পর বছর। সারাবাংলা ঘুরে ঘুরে মানুষকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন। স্বাধীনতার জন্যে প্রস্তুত করেছেন। কখনো রহস্যময় আচরণ করেননি ।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু বাংলার আকাশে উদিত হয়েছিলেন জলের মতো টকটকা স্বচ্ছ একজন রাজনীতিক হিসেবে। জন্ম নিয়েছিলেন খোলা বইয়ের মতোই। তাঁকে পড়তে পারতো শিক্ষিত- মূর্খ সবাই। তিনি ছিলেন নেতাকর্মীদের সবার প্রিয় মুজিব ভাই। তাঁর বিচরণ ছিল সারাবাংলার সব জায়গায়। এমনি ছিলেন বলেই অনেকটাই কম বয়সে হয়ে উঠেছিলেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা, জাতির পিতা।
বাংলার ইতিহাসে তিনি এভাবেই থাকবেন চিরকাল। তিনি এসেছিলেন ইতিহাস ভাঙতে। ভেঙেছেন। এসেছিলেন নতুন ইতিহাস গড়তে। মন ভরে গড়েছেন। পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার ইতিহাস গড়েছেন। বাঙালিকে হাজার বছরের গোলামী থেকে মুক্ত করেছেন। তবে বেশিদিন দুনিয়াতে থাকতে পারেননি। থাকতে দেয়া হয়নি। ক্ষণজন্মা মানুষেরা এমনই হয়। নশ্বর দেহ নিয়ে বেশিদিন ধরায় থাকতে পারেন না। থাকেন মৃত্যুর পর। হাজার বছর পরেও বেঁচে থাকেন। বেঁচে থাকা মানুষদের চাইতেও অধিকতর সম্মান আর পরিচিতি নিয়েই বেঁচে থাকেন!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা।