Home মতামত তাহলে শিখলামটা কি জীবনে!!!

তাহলে শিখলামটা কি জীবনে!!!

33

সরদার মোঃ শাহীন:

আমার শোনিমকে জাপানের কিন্ডারগার্টেনে দিয়েছি কেবল। এদেশে তিনবছর বয়স হলেই বাচ্চাদেরকে স্কুলে দেয়া বাধ্যতামূলক। শোনিমের তিন পুরো হয়ে গেছে, তাই শোনিমকেও দিয়ে দিলাম। প্রথম দিন তো ফাটাফাটি রকমের খুশি শোনিম। খুশিতে স্কুলের প্রথম দিনের আগের রাতে সে কিছুতেই ঘুমুবে না। যদি সকালে ঘুম না ভাঙে এই ভয়ে সে ঘুমুবে না। তবে ভয় জিততে পারেনি। এক সময় ঠিকই ঘুমিয়ে পড়লেও সকালে ডাকতে হয়নি তেমন। এক ডাকেই চোখ মেলে ওঠে বসেছে। সমস্যা করেনি কোন।

স্কুলে যাওয়া নিয়ে শোনিমের কোন সমস্যা তেমন ছিলও না, কেবল সাতসকালে ঘুম থেকে ওঠা ছাড়া। সকালের ঘুমটাই ওকে বড্ড জ্বালাতো। ঘুম থেকে উঠাতে গেলেই রাজ্যের আপত্তি। একে তো কনকনে ঠান্ডা। তার উপর মাঝেমধ্যেই রাস্তা তুষারপাতে ঢাকা থাকে। শোনিম তুষার ডিঙিয়ে স্কুলে যেতে চাইতো না। এবং না যাবার যত রকম বাহানা আছে, সব করতো। তবে স্কুলে পৌঁছে গেলেই বদলে যেত শোনিম। বাসায় আর ফিরতেই চাইতো না।

বাসা থেকে খুব দূরে নয় স্কুল। পাড়ার মধ্যেই। সে কারণে হেঁটেই যেতে হতো। স্কুলটি দূরে হলেই বরং ভাল হতো। হেঁটে নয়, বাসে করে যাওয়া যেত। দূরের শিক্ষার্থীদের জন্যে স্কুল বাস আছে। প্রায়ই দেখতাম আমাদের পাশ দিয়েই বাসটি শো শো করে চলে যাচ্ছে। শোনিম কেবল দেখতো কিন্তু চড়তে পারতো না। বাসাটি স্কুলের আধা কিলোমিটারের মাঝে হওয়ায় সুযোগটা পায়নি শোনিম। এদেশে নিয়ম ভেঙে কোন কিছু করার সুযোগ নেই।

নিয়ম তো নিয়মই। সামাজিক নিয়ম। আর সামাজিক নিয়মের দীক্ষাটাই সামাজিক শিক্ষা। সামাজিক শিক্ষায় শোনিমও খুব তাড়াতাড়ি অভ্যস্ত হয়ে উঠলো। কেবল হেঁটে হেঁটে স্কুলে যাওয়াতেই নয়; বরং স্কুলে ঢুকে পায়ের জুতা খুলে জায়গা মত রেখেই সোজা টয়লেট জোনে যেতে হতো। তিন বছরের পিচ্চি একটা বাচ্চার স্কুলে ঢুকে প্রথম কাজই হলো নিজের স্কুলের টয়লেট নিজেই ঘষেমেজে পরিষ্কার করা।

শিক্ষকরা পরিষ্কার করার আনুসাঙ্গিক সব জিনিস নিয়ে বাচ্চাদের অপেক্ষায় থাকতো। এক একটা পিচ্চি ঢুকতো আর সে সব ধরিয়ে দিত হাতে। অত্যন্ত খুশিভরা মনে সব বাচ্চাদের দল মনের সকল মাধুরী মিশিয়ে টয়লেট জোনে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নেমে যেত। কেউ হাতে কাপড়ের টুকরো নিয়ে, কেউ বা মব। ছোট্ট ছোট্ট শিশুর দল নিত্যদিন স্কুল শুরুর আগে নিজেদের টয়লেট নিজেরাই পরিষ্কার করতো। ধরে নিত এটাই ওদের ক্লাস; এটাই ওদের শিখতে হবে।

আসলেই তাই। এটাই প্রকৃত শিক্ষা। এটাই সামাজিক শিক্ষা। শুধু ওরাই নয়, সামাজিক কাজটা শিক্ষকগণও করতো। বাচ্চাদের আসার অনেক আগে তারা এসে শিক্ষার্থীদের ক্লাসরুমগুলো চমৎকার ভাবে গুছিয়ে রাখতো। গুছাতো শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রাখার কেবিনেটগুলো। আর শিক্ষার্থীদের দল যখন টয়লেট পরিষ্কার করতো, শিক্ষকের দল তখন স্কুলের বাইরের আঙিনা পরিষ্কারে নেমে যেত। ঝাড়ু দিয়ে বাইরের সব কিছু ঝকঝকে তকতকে করে ফেলতো।

এসব কাজে শিক্ষকদের কোন ক্লান্তি কিংবা অনীহা দেখিনি কোনদিন। দেখিনি হীনমন্যতাও। নিজেদেরকে শিক্ষক ভেবে ঝাড়ু দেবার কাজকে ছোট কাজ বলতে শুনিনি। বরং এসব কাজ করেই নিজেদেরকে বড় ভাবার প্রচেষ্টা নিতে দেখেছি। বুঝতে শিখেছি কাজ যত ছোট হয়, নোংরা হয়; মানুষ সে সব করে ততই বড় হয়। সামাজিক জীব হিসেবে সমাজে মানুষের বড় হবার এর চেয়ে সহজ কোন উপায় আর আছে বলে মনে হয় না।
আর এই সহজ কাজগুলো করতে শেখার নামই সামাজিক শিক্ষা। সমাজে চলার জন্যে, সমাজের ভালোর জন্যে যে শিক্ষা, সেটাই সামাজিক শিক্ষা। সামাজিক শিক্ষায় দীক্ষা নিতে শুরু করেছে শোনিম চা’রে পা দিয়েই। স্কুলে যাবার প্রথম মাসে শিখেছে কিভাবে শহরের রাস্তা পেরোতে হয়। একদিন ওকে নিয়ে মহল্লার ভেতরেই হাঁটতে বেরিয়েছি। রাস্তায় গাড়ি তেমন নেই বললেই চলে। তাই অভ্যাসগত ভাবে রেড সিগনালেও রাস্তা পেরোবার উদ্যোগ নিয়েছি।

অমনি শোনিমের বাঁধা। রেড সিগনালে সে কিছুতেই রাস্তা পার হবে না। লজ্জায় আমি লাল। চার বছর বয়সে মাত্র একমাসে ও যা শিখেছে আমি ৩০ বছর পড়াশুনা করেও তা শিখতে পারিনি! শিখতে পারিনি, কেননা আমার শিক্ষা ব্যবস্থায় সামাজিক শিক্ষার লেশমাত্র ছিল না। ছিল অংক, ছিল ইংরেজি। পদার্থ বিদ্যার কঠিন পাঠও শিখেছি। কিন্তু শিখতে পারিনি, বাসা থেকে মাত্র দু’পা ফেলে কিভাবে রাস্তা পার হতে হয়!

জীবনে গাদা গাদা বই পড়ে কেবল একাডেমিক শিক্ষায় তথাকথিত শিক্ষিত হয়তো হয়েছি। কিন্তু সামাজিক শিক্ষায় দীক্ষা নিতে পারিনি। অবশ্য এই দোষ আমার বা আমার পূর্বপুরুষদের নয়। দোষ ব্রিটিশদের। সর্বনাশের শুরুটা করে দিয়ে গেছে ওরা। প্রায় দু’শ বছরের শাসনে ওরা আমাদেরকে অসামাজিক বানিয়ে গেছে। নিজের কাজ, বিশেষ করে ছোট কাজ অন্যকে দিয়ে করানোর প্রচলনটা ওরা শিখিয়েছে। কুলি, মেথর, মুচি, পিয়ন, দারোয়ান, আরদালী আর ড্রাইভার পদ সব ওদের সৃষ্টি। স্কুলের দফতরী পদটিও ওদের সৃষ্টি।

শোনিমের স্কুলের দফতরী টাইপের মানুষটিকেও রোজ দেখতাম বারান্দায় কোন না কোন বাচ্চা কোলে নিয়ে হাঁটছেন। হাত দিয়ে কারো নাকের ময়লা পরিষ্কার করছেন, কাউকে নিয়ে হিশু করাচ্ছেন। বিশেষ করে যে শিশুটি অটিজম টাইপের, তাদের সার্বিক দায়িত্ব এই মানুষটির। একটুও বিরাম নেই কাজে। একটি শিশুকে কোলে নিয়ে আর একটিকে হাতে ধরে এ রুমে সে রুমে যাচ্ছেন।
বাড়ি বাড়িও যেতেন তিনি। স্কুল বাসটি নিয়ে সকাল বিকেল বাড়ি বাড়ি যেয়ে বাচ্চাদের আনা নেওয়ার কাজটিও তিনি করতেন। তিনিই চালক, তিনিই হেলপার। খুব ভোরে বাসটি নিয়ে বেরিয়ে যেতেন আর বিভিন্ন স্পট থেকে একা একাই বাচ্চাদের তুলে তুলে স্কুলে নিয়ে আসতেন। কাজটি বিকেলেও তিনি ঠিক একই ভাবে করতেন। অবিরাম করতেন। জাপান বলেই সম্ভব ছিল এটা। যিনি দফতরী, তিনিই হেলপার। আবার তিনিই ড্রাইভার।

একদিনের কথা। শোনিমের গার্ডিয়ান হিসেবে প্যারেন্টস ডে’তে প্রথম ডাক পড়লো আমাদের। ডেকেছেন স্কুল প্রিন্সিপাল। শুনে ভাল লাগলো। এতদিন পর স্কুল প্রধানকে দেখার সুযোগ পাবো। আফটার অল প্রতিষ্ঠান প্রধান। তাই ক্যাজুয়াল পোশাকে নয়, ফরমাল পোশাকে গেলাম প্রিন্সিপাল স্যারের রুমে। শোনিমের বাবা হিসেবে গেলাম।

প্রিন্সিপাল স্যারও খুব ফরমাল পোশাকেই বসা ছিলেন চেয়ারে। স্যুটকোট পড়া দারুন মানানসই মানুষটি আমাদের দেখেই চেয়ার ছেড়ে উঠে এলেন। আর বসতে দিলেন সামনে থাকা সোফায়। তিনি নিজেও একটি সোফায় বসলেন। সময় ফিক্সড করা; ত্রিশ মিনিট। সব কথাই হলো। আলাপের প্রায় শেষের দিক। বিদায় নিতে যাবো। অমনি মনের কথাটি বলেই ফেললাম। মনের মধ্যে খুচখচ করতে থাকা প্রশ্নটা না করে পারলাম না।

বললাম, স্যার! আপনাকে একটু চেনা চেনা লাগছে। নিত্যদিন ভোরে স্কুল বারান্দায় ক্যাজুয়াল ড্রেসে শিশুদের কোলে নিয়ে যাকে ঘুরতে দেখি কিংবা স্কুল বাসটি সকাল বিকাল যাকে চালাতে দেখি, আপনিই কি সেই জন? সেই মানুষ? আমার প্রশ্নে তিনি একটু অবাক হলেন বটে। তবে মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিতে দেরি করলেন না।

এবং খুব স্বাভাবিক ভঙিমায় বললেন, “এই প্রতিষ্ঠানে সবচেয়ে কম কাজ আমার। কাজ যা করার সব করে আমার শিক্ষকগণ। তারাই পড়ায়, পরীক্ষা নেয়। রোজকার ক্লাস রিপোর্ট লেখে। বলতে পারো বাচ্চাদের সার্বিক দেখভাল করে ওরা। যে সব শিশুরা পিছিয়ে আছে তাদের বাড়তি ক্লাসও নেয়। সেই তুলনায় আমার কোন কাজই তেমন নেই।”

একটু থেমে আবার বললেন, “প্রিন্সিপাল হিসেবে আমার কাজই হলো শিক্ষকদের সাহায্য করা। অসুস্থ শিশুদের কোলে কোলে রেখে, তাদের টেককেয়ার আর স্কুলে আনা নেয়া করে আমি আমার শিক্ষকদের একটু সাহায্য করি মাত্র। এইটুকু না করলে শুধু প্রিন্সিপাল হিসেবে আমার প্রয়োজনটাই তো আর থাকবে না। স্কুলে নিজেকে প্রয়োজনীয় করে রাখার জন্যেই আমি এসব করি। করতে হয় আমাকে।”

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স করে এক সময় নিজেকে খুব পন্ডিত মনে হতো। প্রিন্সিপাল স্যারের রুম থেকে বেরিয়ে বাসায় ফেরার পথে মনে হচ্ছিল, পন্ডিত তো ভাল, পান্ডিত্যের প ও অর্জন করতে পারিনি আজও। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে জীবনে যে পাঠ নিতে পারিনি, আমার ছোট্ট ছেলের কিন্ডারগার্টেন থেকে তা আজ নিতে পারলাম। গাদা গাদা বই পড়ে বড় হবার কত শিক্ষাই নিলাম জীবনে। কেবল নিতে পারিনি প্রকৃত মানুষ হবার, সামাজিক মানুষ হবার শিক্ষা। তাহলে করলাম টা কী জীবনে!! শিখলামই বা কী!!!

-লেখক: উপদেষ্টা সম্পাদক, যুগবার্তা ।