Home জাতীয় ঢাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে র‌্যালি ও সমাবেশ

ঢাকায় পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে র‌্যালি ও সমাবেশ

29

স্টাফ কোয়ার্টার: পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার রাষ্ট্রীয় বাহিনীর কর্তৃক প্রতিনিয়ত নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। এ হত্যাকান্ডের ঘটনায় সাধারণ শিক্ষার্থীসহ নিরীহ জনগণ বাদ যাচ্ছে না। সুতরাং এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ছাত্র সমাজকে গর্জে উঠতে হবে। দেশের ফ্যাসিবাদী শাসন ও পাহাড়ে ফৌজি শাসনের বিরুদ্ধে পাহাড় ও সমতলে সমান তালে লড়াই চালিয়ে নিতে হবে।

আজ শনিবার (২০ মে ) সকাল ১১টায় বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি)-এর ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাস বিরোধী রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে আয়োজিত সমাবেশে বক্তারা এসব কথা বলেন।

সমাবেশের আগে এক র‌্যালি অনুষ্ঠিত হয়। র‌্যালিটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শারিরীক শিক্ষা কেন্দ্র থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হয়ে ভিসি চত্ত্বর, কলা ভবন, মধুর ক্যান্টিন, সমাজবিজ্ঞান ভবন হয়ে রাজু ভাস্কর্যে গিয়ে এক ছাত্র সমাবেশ মিলিত হয়।

“পিসিপি’র গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামী চেতনা রাখবো সমুন্নত” এ শ্লোগানে এবং “পার্বত্য চট্টগ্রামে নিষ্ঠুর দমন-পীড়ন ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে গর্জে ওঠো, পাহাড়ে ফৌজি শাসন ও দেশে ফ্যাসিবাদ অবসানে পাহাড়-সমতলে লড়াই হবে সমান তালে” এই আহ্বানে র‌্যালির পরবর্তী অনুষ্ঠিত সমাবেশে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি অঙ্কন চাকমার সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক অমল ত্রিপুরার সঞ্চালনায় বক্তব্য রাখেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, ইউনাইটেড ওয়ার্কার্স ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টে সহ-সাধারণ সম্পাদক প্রমোদ জ্যোতি চাকমা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের সাধারণ সম্পাদক জিকো ত্রিপুরা, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সভাপতি নীতি চাকমা।

সমাবেশে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য রাখেন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের সভাপতি মুক্তা বাড়ৈ, বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী সাধারণ সম্পাদক দীলিপ রায়, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈকত আরিফ, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের প্রচার ও প্রকাশনার সম্পাদক সোহবত শোভন। এছাড়াও সমাবেশে সংহতি জানিয়েছেন বাংললাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি মিতু সরকার, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি ছায়েদুল হক নিশান, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের তথ্য প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সাদেকুল ইসলাম সাদিক প্রমুখ। এতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শুভাশীষ চাকমা।

সমাবেশে ফয়জুল হাকিম তাঁর বক্তব্যে বলেন, বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সাম্রাজ্যবাদের হস্তক্ষেপ তথা পুরো দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি বিরাজ করছে এই সময়ে পিসিপি’র প্রতিষ্ঠাবাষির্কী পালন করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখতে পাই তৎকালীন ছাত্র সমাজ পাকিস্তানের চাপিয়ে দেয়া উর্দু ভাষার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে, জীবনের আত্মহুতি দিয়ে ভাষা রক্ষার আন্দোলন সংগঠিত করেছে। এদেশের শ্রমিক-কৃষকসহ দেশের সাধারণ মানুষই ইতিহাসের নির্মাতা। অথচ বাংলাদেশে আজ জনগণের ভোটাধিকারে জনবান্ধব সরকার প্রতিষ্ঠা হয় না। যে সরকারের এমপি-মন্ত্রীরা সিন্ডিকেট গঠন করে কালো বাজারের মজুরি শোষণসহ শ্রমিক-কৃষক ও ছাত্র সমাজের ওপর ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন ও গণবিরোধী ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন জারি করে সে সরকার জনগণের সরকার হতে পারে না।

তিনি আরো বলেন, উগ্র-বাঙালি জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে পাহাড়িদের উপর জাতিগত নিপীড়ন জারি রাখা হয়েছে। আজকে স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পরও দেশের সংবিধানের কৃষক শ্রমিক তথা মেহনতি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়নি। নায্য দাবি আদায়ের আন্দোলন দমন করতে এই ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র ছাত্রনেতাদের হত্যা করছে। সাবেক ছাত্রনেতা মিঠুন, রূপক, অনিমেষ ও রমেলসহ অনেকে শাসকগোষ্ঠীর এই হত্যার শিকার হয়েছে। গণতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থার আন্দোলন, জাতিসত্তা মুক্তি সংগ্রাম ও সাংবিধানিক স্বীকৃতিসহ নিপীড়িত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হয়ে আন্দোলন জোরদার করতে হবে।

সভাপতির বক্তব্য অঙ্কন চাকমা বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিক্রম করলেও সর্বজনীন, বিজ্ঞানভিত্তিক, বৈষম্যহীন ও গণতান্ত্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয়নি। দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে দিন দিন সংকুচিত করা হয়েছে। বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে শিক্ষাকে একটি বাণিজ্যিক পণ্যে পরিণত করা হয়েছে। আওয়ামীলীগ সরকার কথায় কথায় নিজেদের “সংখ্যালঘু বান্ধব সরকার” হিসেবে জাহির করলেও বাস্তবে তাদের চরিত্র ভিন্ন। ২০১১ সালের ৩০শে জুন পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধনীতে দেশের ৪৫টির অধিক ভিন্ন জাতিসত্তা সমূহকে বাঙালি জাতীয়তা চাপিয়ে দিয়েছে।

তিনি আরো বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে অধিকাংশ স্কুল-কলেজ সমূহের বিরাজ করছে চরম শিক্ষক সংকট। রয়েছে অবকাঠামোগত দূর্বলতা, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঝুঁকিপূর্ণ জরাজীর্ণ স্কুল ভবন ও স্কুল কলেজে ছাত্রাবাস ও কলেজ বাস চালু নেই। এসব সংকট নিরসনের জেলা পরিষদ-আঞ্চলিক পরিষদ ও ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্য তথাকথিত জনপ্রতিনিধিদের কোন উদ্যোগ চোখে পড়ে না। শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে তারা চিন্তিত নয়, তৎপরতাও নেই। এইজন্য মান-সম্মত শিক্ষাতো দূরের কথা ন্যূনতম শিক্ষা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে পাহাড়ি শিশুরা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়ে প্রাইমারী লেভেলে অযোগ্য-অদক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দানের মাধ্যমে জেলা পরিষদ শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।

তিনি আরো বলেন,পার্বত্য সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সরকার দলীয় ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমূহের হল দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থীদের উপর হামলা, নির্যাতন করে এক ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরী করে রেখেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহে মুক্তচিন্তা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই।

প্রমোদ জ্যোতি চাকমা বলেন, রাষ্ট্রীয় বাহিনী কর্তৃক পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। ২০১৭ সালের ছাত্রনেতা রমেল চাকমাকে সেনা হেফাজতের কি নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। লামায় ম্রো-ত্রিপুরাদের ৪০০ একর ভূমি বেদখলের পাঁয়তারা এখনও বন্ধ করা হয়নি। সাম্প্রতিক সময়ে ১১ জন বম জাতিসত্তার ওপর চালানো হয়েছে নির্মম হত্যাকাণ্ড।

জিকো ত্রিপুরা বলেন, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের আর্দশকে সর্বদা সমুন্নত রাখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরীহ পাহাড়ি জনগণকে ফৌজি শাসনের কারাগার থেকে মুক্ত করতে হলে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদকেই লড়াই সংগ্রাম করে যেতে হবে। এটি হোক ৩৪তম প্রতিষ্ঠাবাষির্কীতে পিসিপি’র অঙ্গীকার।

সমাবেশে নীতি চাকমা বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে নারী অধিকার ও অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের অবদান ভুলবার নয়। পাহাড়ি নারীদের উপর যেভাবে পৈশাচিক নির্যাতন চালানো হয় কখনও কখনও তা প্রকাশিত হলেও অধিকাংশ ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যায়। বর্তমান সময়ে সেনাবাহিনী-সেটলার ও নব্য মুখোশ বাহিনী দিয়ে নারী নির্যাতনের নতুন ষড়যন্ত্র দাঁড় করানোর চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কিছুদিন আগে খাগড়াছড়ির লক্ষ্মীছড়িতে নব্যমুখোশ সদস্য কর্তৃক এসএসসি পরীক্ষার্থী ধর্ষণই তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

সমাবেশে মক্তা বাড়েই বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছর অতিক্রম করলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে নিপীড়নের মাত্রা কমেনি। সেনা শাসন জারি রেখে শাসন-শোষণ অব্যাহত রেখেছে।

সৈকত তারিফ বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকে পাহাড়িদের নির্মম-নিষ্ঠুরভাবে দমন করা হচ্ছে। প্রতিনিয়ত মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে ফ্যাসিস্ট কায়দায় বর্তমান সরকার তার শাসন কায়েম করেছে। জনগণের সমস্ত অধিকার কেড়ে নিয়ে বাংলাদেশেকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পরিবর্তে এক ভয়াবহ ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে ধাবিত করা হচ্ছে।
দিলীপ রায় বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী দিয়ে যেভাবে পাহাড়িদের নিপীড়ন করা হচ্ছে তাতে ভুলে গেলে চলবে না বাংলাদেশ একাত্তরেও এই এরকম একটা পরিস্থিতি পার করে এসেছে। রাষ্ট্র পাহাড়ের স্বতন্ত্র অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ভেঙে দিয়ে উন্নয়ন, পর্যটনের নামে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ভোগ-দখল করার চক্রান্ত করছে।

সোবহত শোভন বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘন, ভূমি বেদখলের মত যত নৃশংস ঘটনা ঘটছে তার জন্য এই রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থাই দায়ি।

সমাবেশে থেকে বক্তারা, পাহাড়ি জনগণের দাবি পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন মেনে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে সেনাবাহিনী প্রত্যাহার, বেআইনি অনুপ্রবেশকারীদের পার্বত্য চট্টগ্রামের থেকে সরিয়ে অন্যত্র সম্মানজনকভাবে পুনবার্সন করা, পাহাড়িদের প্রথাগত ভূমি অধিকার নিশ্চিত, সকল জাতিসত্তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড বন্ধ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক অবৈধ ১১দফা নির্দেশনা বাতিলসহ পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত খনিজ সম্পদ অনুসন্ধান ও আহরণ বন্ধের দাবি জানান।