Home সাহিত্য ও বিনোদন ড. চঞ্চল সৈকত বিরচিত একটি সুখপাঠ‍্য গ্রন্থ “বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু”

ড. চঞ্চল সৈকত বিরচিত একটি সুখপাঠ‍্য গ্রন্থ “বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু”

50

জাকির হোসেন আজদী: সম্প্রতি দৃষ্টি কাড়লো
নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক, কবি, ঔপন্যাসিক, গায়ক, গীতিকার, সুরকার, গবেষক, সংগঠক, সমাজসেবক ও ব‍্যাংক কর্মকর্তা ড. চঞ্চল সৈকত বিরচিত একটি সুখপাঠ‍্য গ্রন্থ “বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু”। গ্রন্থের শিরোনামই আমাকে প্রথম আকর্ষণ সৃষ্টি করলো এবং গ্রন্থটি পাঠের ব‍্যাপারে অনুপ্রাণিত করলো। দেখতে চাইলাম এতো সুন্দর একটি বিষয়ে গ্রন্থকার কী লিখলেন!

বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু” গ্রন্থে লেখক তুলে ধরেছেন কিভাবে ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহে ১৯৭১ সালে বিশ্বের মানচিত্রে প্রথমবারের মতো অঙ্কিত হয় স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আবির্ভূত হন সে ঘটনাসমূহের নায়কের মূর্তিতে। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে তাঁর নাম লেখা হয়ে যায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিরূপে। দীর্ঘ মুক্তি সংগ্রাম এবং একটি স্বাধীনতা যুদ্ধ—সমগ্র বাঙালি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সে সংগ্রামে। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে বঙ্গবন্ধু রূপান্তরিত হন একজন রাজনৈতিক নেতা থেকে ইতিহাসের মহানায়কে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন, একজন রাষ্ট্রনায়ক ছিলেন; সর্বোপরি তিনি একজন মানুষ ছিলেন। স্বাধীনতার পর স্বাধীনতার স্থপতির জীবননাশও ইতিহাসে নতুন কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু জাতির একটা অংশ যেভাবে তাঁর কর্ম ও চরিত্রকে বিতর্কিত করার চেষ্টা করে চলেছে তা শুধু কৃতঘ্নের পক্ষেই সম্ভব। এটাই সত্য যে, সে বিতর্ক প্রচেষ্টা আপামর মানুষের হৃদয় থেকে বঙ্গবন্ধুকে দূরে সরাতে পারেনি।

শেখ মুজিবুর রহমান কেবল একজন ব্যক্তির নাম নয়। তিনি নিজেই এক অনন্য সাধারণ ব্যতিক্রমী ইতিহাস। সমাজ ও কালের প্রেক্ষাপটে তিনি ব্যক্তি মুজিব থেকে হয়ে উঠেছিলেন বঙ্গবন্ধু এবং বঙ্গবন্ধু থেকে হয়ে উঠেছিলেন বিশ্ববন্ধু। তাঁর পারিবারিক পরিমণ্ডলকে অতিক্রম করে তিনি সমাজ, দেশ ও সমকালীন বিশ্বের ইতিহাসে বিকশিত হয়েছেন। আপন সমাজের মানুষের দুঃখ-বেদনা-বঞ্চনা তাঁকে শৈশব থেকেই ব্যথিত করে তোলে।

বাংলার মানুষ ছিল তাঁর পাঠশালা। কালক্রমে বিশ্বমানব হয়ে উঠে তাঁর পাঠ গ্রহণের বৃহত্তম বিদ্যালয়। মানুষই ছিল তাঁর জ্ঞানার্জনের প্রধান বিষয়। তাই ব্যক্তি শেখ মুজিবুর রহমান এদেশের আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সংগ্রামের ধারায় ‘মুজিব ভাই’ ও ‘শেখ সাহেব’ থেকে পরিণত হয় ‘বঙ্গবন্ধু’তে এবং পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু থেকে পরিণত হন ‘বিশ্ববন্ধু’ তথা স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্থপতি ও জাতির জনক-এ এবং বিশ্বের শোষিত মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু-তে।

লেখক এই গ্রন্থটিতে প্রধানত যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সেগুলোর সংক্ষিপ্ত পরিচয় এখানে তুলে ধরা হলো। গ্রন্থের বিষয় সূচিতে আছে— মুজিবের শৈশবকালে ব্রিটিশ ভারতবর্ষ, শেখ পরিবার: শিশু ও তরুণ মুজিব, বিশ ও ত্রিশের দশকের রাজনীতির ধারাসমূহ, ব্রিটিশ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন: বিপ্লববাদী সংগঠনের ভূমিকা, তরুণ মুজিবের
রাজনীতি-সম্পৃক্ততা, পাকিস্তানের স্বপ্ন ও যুবক মুজিবের সংগঠন, ছাত্র, যুবক ও রাজনৈতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠা ও কর্মকাণ্ড, ভাষা আন্দোলন: ১৯৪৮-৫২, শেখ মুজিবুর রহমানের কারাজীবন: ১৯৪৯-৫২, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা: মুজিব নেতৃত্বের বিভিন্ন বিকাশ, যুক্তফ্রন্ট ও পাকিস্তান গণপরিষদ: নেতৃত্বের অভিজ্ঞতায় শেখ মুজিব, পাকিস্তান গণপরিষদে শেখ মুজিবুর রহমানের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ (১৯৫৫-৫৮), আইয়ুব খানের সামরিক শাসন (১৯৫৮-৬০): পূর্ব পাকিস্তান, রাজনীতি, শেখ মুজিব ও আন্দোলন, শেখ মুজিবের স্বদেশ চিন্তা (১৯৬৩-৬৫): আওয়ামী লীগের পুনঃঅভ্যুদয়, পাক-ভারত যুদ্ধ, শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ৬ দফা: আন্দোলন ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান: নেতৃত্বের শিখরে বঙ্গবন্ধু, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানের কারাগারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন, স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবের রাষ্ট্র ও দেশ গঠন, সরকার পদ্ধতি, সংবিধান ও স্বাধীন দেশের রাজনীতি, আওয়ামী লীগের অর্থনীতি ভাবনা, প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ও ভূমি-সংস্কার, বাংলাদেশে গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষানীতি, সমকালীন বিশ্ব-পরিস্থিতি ও বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধু: স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু হত্যা ১৫ আগস্ট ১৯৭৫, নেতা হত্যা ৩ নভেম্বর ১৯৭৫ এবং উপসংহার।

মানুষ বঙ্গবন্ধুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতা এবং বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক বিবর্তন সম্পর্কে বিবরণ রয়েছে। জাতীয় চার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জুলিও কুরি পদকপ্রাপ্তির দিনটি ‘বিশ্ববন্ধু’ হওয়ার স্মরণীয় দিন। ১৯৭৩ সালে এই পদকপ্রাপ্তির মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। দেশ ও জাতি হয়েছিল গর্বিত। বিশ্বশান্তি পরিষদ বাঙালি জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা গণতন্ত্র ও শান্তি আন্দোলনের পুরোধা বঙ্গবন্ধুকে ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করেছিল। বঙ্গবন্ধু সর্বদা শান্তিকেন্দ্রিক অহিংস গান্ধীবাদী রাজনৈতিক দর্শনের পথ অনুসরণ করেছিলেন। তিনি তাঁর জীবনের এক চতুর্থাংশ সময় কারাগারে কাটিয়েছেন।

আলোচ্য গ্রন্থ বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন ও রাজনীতি বিন্যস্ত করে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রেক্ষাপট তুলে ধরার একটি প্রয়াস। তাঁর ব্যক্তি ও রাজনৈতিক সত্তার মধ্যে সম্পর্ক বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে কীভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে, তা তুলে ধরা হয়েছে এই গ্রন্থের উপসংহারে। লোকায়ত বাঙালি সমাজের মানবতাবাদী ধ্যান-ধারণা কীভাবে পরিপুষ্ট করেছে তাঁর কর্মকথা ও আচরণকে-তাও তুলে ধরার প্রচেষ্টা রয়েছে এই গ্রন্থে ।

বিশেষ কৃতজ্ঞতা আমার প্রাণাধিক প্রিয় অর্ধাঙ্গিনী আলপনা সাহা (লাকী) এবং পুত্র— দিব্যজ্যোতি সাহা (অর্ক) ও সৌম্যজ্যোতি সাহা (অভ্র)কে যারা আমার সৃষ্টিশীল কাজের জন্য অনেক মূল্যবান সময় উপহার দিয়েছেন। লেখক-সম্পাদক অস্ট্রিক আর্যু বইটির আদ্যোপান্ত পরিবীক্ষণ করেছেন— তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। ‘বঙ্গবন্ধু থেকে বিশ্ববন্ধু’ গ্রন্থটি লেখার ভ্রমজনিত দায় নিজ কাঁধে গ্রহণ করে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের জানাই প্রণতি।
এই অনন্য অসাধারণ গ্রন্থটির লেখক ড. চঞ্চল সৈকত সংস্কৃতি ও ব্যাংকিং জগতে অতি পরিচিত নাম। তিনি অল্প সময়ের মধ্যে তরুণ সংস্কৃতি গবেষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। একাধারে নাট্যকার, অভিনেতা, নির্দেশক, কবি, ঔপন্যাসিক, গায়ক, গীতিকার, সুরকার, গবেষক, সংগঠক ও সমাজসেবক।

তার পিএইচডি থিসিসের অভিসন্দর্ভ A Study On Cultural Impact On Economic Development: Bangladesh Perspective অর্থাৎ অর্থনৈতিক উন্নয়নে সংস্কৃতির অবদান: বাংলাদেশী পরিবেক্ষণ। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর জয়যাত্রা, বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীনতা, মুক্তিযোদ্ধার ডায়েরি, নাট্যসমগ্র-১, গল্পে গল্পে শিশুদের নৈতিক শিক্ষা, প্রকাশিত হয়েছে। রচিত ছড়া- কবিতা-ছোটগল্প-নাটক-গান ইত্যাদিতে মননশীলতার ছাপ বহন করে।

ড. চঞ্চল সৈকত পারিবারিক সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠেন। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী নাট্যদল নাগরিক নাট্যাঙ্গন অনসাম্বলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দীর্ঘদিন যাবৎ দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়াও তিনি অভিনয় শিল্পীসংঘ, টেলিভিশন নাট্যকার সংঘ, ডিরেক্টরস্ গিল্ড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালাইমনাই এসোসিয়েশনের আজীবন সদস্য। জনতা ব্যাংক ওয়েলফেয়ার সোসাইটির সহ-সভাপতি, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক পরিষদের যুগ্ম সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন।

তাছাড়া তিনি বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন শিল্পী সংস্থা, এশিয়ান কালচারাল সোসাইটি, টেনাশিনাসসহ অসংখ্য সংগঠনের নির্বাহী পরিষদের সদস্য এবং বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশানের আন্তর্জাতিক সম্পাদক হিসেবে সুচারুভাবে দায়িত্ব পালন করছেন ।

বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ড. চঞ্চল সৈকত খুলনা জেলার অন্তর্গত ডুমুরিয়া উপজেলার মিকশিমিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ।