Home জাতীয় জ্বালানিসংকট আরো প্রকট হচ্ছে

জ্বালানিসংকট আরো প্রকট হচ্ছে

30

ডেস্ক রিপোর্ট: বিশ্ব জুড়ে জ্বালানিসংকটের সঙ্গে আরো নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ যত প্রলম্বিত হচ্ছে সংকট তত গভীর হচ্ছে। গত এক দশকে আমদানি-নির্ভরতা বাড়ায় এবং স্থানীয় উৎস থেকে সংযোজন কমায় দেশে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

দেশে জ্বালানির চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ঘাটতি দূর করতে চার বছর ধরে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) এবং আড়াই বছর ধরে কয়লা আমদানি করছে। কিন্তু বর্তমান বিশ্ব-পরিস্থিতিতে এই দুই জ্বালানির প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য। একই সঙ্গে গত এক বছরে দুই ধরনের জ্বালানির দাম প্রায় ২০০ শতাংশ বেড়ে গেছে। সামনের দিনে এটি আরো বাড়বে বলেই পূর্বাভাস রয়েছে। অন্যদিকে অপর উৎস জ্বালানি তেল আমদানিও বিলম্বিত হচ্ছে ডলারসংকটের কারণে। সব মিলিয়ে দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির সংকট আগামী দিনে বর্তমান পরিস্থিতি থেকে আরো প্রকট হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের রেশ ধরে ইতিমধ্যে রাশিয়া ইউরোপের কয়েকটি দেশে জ্বালানি সরবরাহ বন্ধ এবং কয়েকটি দেশে সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ‘স্মরণকালের সবচেয়ে বড় ঘাটতির’ মুখে পড়ে হাঙ্গেরি গত বৃহস্পতিবার ‘এনার্জি ইমার্জেন্সি’ ঘোষণা করেছে। শীতে বিদ্যুৎ-জ্বালানির চাহিদা বাড়ে। সেজন্য রাশিয়ার বাইরের উৎস থেকে জোগান বাড়াতে চেষ্টা করছে ইউরোপীয় দেশগুলো। কিন্তু তাতেও চাহিদানুযায়ী সম্পূর্ণ জোগান পাওয়া সম্ভব হবে না। আগামী শীতের আগে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ থামবে বলে আশ্বস্ত হতে পারছেন না বিশ্লেষকরা। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যে বাজারগুলো থেকে তেল-এলএনজি-কয়লা আমদানি করছে সেগুলোতে ক্রয় প্রতিযোগিতা বাড়ছে। একদিকে জ্বালানির আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি অন্যদিকে বিনিময় মুদ্রা মার্কিন ডলারের নিয়ন্ত্রণহীন ঊর্ধ্বগতিতে আমদানি খরচের পর্যাপ্ত জোগান দিতে পারছে না রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো।

বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন বলেন, জ্বালানি জোগানের সর্বোচ্চ সুবিধাজনক সুযোগগুলো সরকার কাজে লাগাতে চায়। সে চেষ্টা চলছে। একই সঙ্গে ডিমান্ড সাইডে বা গ্রাহক পর্যায়ে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ-সাশ্রয় ব্যবস্থা নিয়ে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা হবে।

বাংলাদেশ তৈল গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) এবং বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) সূত্রে জানা যায়, দেশে দৈনিক ৪১০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদা রয়েছে। স্থানীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে এ গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব নয় বলে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি শুরু হয় ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে। ব্যয়বহুল এ জ্বালানির দাম বিশ্ববাজারে আরো বেড়েছে। ফলে দেশে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট সমপরিমাণ এলএনজি আমদানি ও ব্যবহারের সক্ষমতা থাকলেও তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সবমিলিয়ে গ্রিডে ২৭০ থেকে ২৯০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আসছে। এই ১১০ কোটির বেশি গ্যাস ঘাটতির ফলে একদিকে শিল্পে সরবরাহ কমানো হয়েছে অন্যদিকে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোতে উত্পাদন কমানো হয়েছে।

এ অবস্থায় সংশ্লিষ্টদের হাতে তাৎক্ষণিক বিকল্প থাকে দুইটি। এক. তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানো। দুই. কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি। কিন্তু ডিজেলভিত্তিক প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ ৩০-৩৫ টাকা পড়ে। এতেও খরচ বেশি বলে রেশনিং করতে হচ্ছে। বিদ্যমান অবস্থাতেই তেল বিক্রি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) দৈনিক লোকসান ১০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় তেল আমদানি করতে এলসি খোলা ও ওয়ার্ক অর্ডার সম্পন্ন করতে পারছে না বিপিসি। ফলে আগামী মাসে তেল সংকট বাড়তে পারে। কয়লায় খরচ কম হলেও গ্রিড সম্পূর্ণ প্রস্তুত না হওয়ায় পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন অর্ধেকের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে হচ্ছে। এ জ্বালানির আরেকটি কেন্দ্র রামপাল ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্ধারিত সময়ে উৎপাদনে আসতে ইতিমধ্যে বেশ দেরি করে ফেলেছে। আগামী অক্টোবরে এতে উৎপাদন শুরু হতে পারে। অর্থাৎ চাহিদা কমানো কিংবা সাশ্রয়ী ব্যবহারের চেয়ে দ্রুত সমাধান এখন নেই।

আবাসিক ও বাণিজ্যিক গ্রাহকদের মধ্যে লোডশেডিং করছে বিতরণ সংস্থাগুলো। সার্বিকভাবে লোডশেডিং যেন তীব্র হয়ে না উঠে সেজন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকেও গ্যাস-বিদ্যুৎ ব্যবহারে রেশনিং করতে অর্থাৎ দিনের নির্ধারিত সময়ে ব্যবহার না করতে অনানুষ্ঠানিক নির্দেশনা দিয়েছে বিতরণ সংস্থা ও কোম্পানিগুলো। শিল্প-কারখানার মালিক বা কর্মকর্তাদেরকে ফোনে কিংবা এসএমএস-এর মাধ্যমে এ নির্দেশনা দিয়েছে স্থানীয় বিতরণ সংস্হাগুলোর স্থানীয় অফিসগুলো। এর আগে গত রমজানে শিল্প-কারখানাগুলোতে প্রতিদিন চার ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ-ব্যবহার বন্ধ রাখতে নির্দেশনা দিয়েছিল পেট্রোবাংলা। ঐ নির্দেশনা ১৫ দিন কার্যকর করা হয়েছিল।

পরিবহনে তেল সরবরাহে রেশনিংয়ের চিন্তা

ডলার সংকটে ব্যাংকগুলো এলসি না খোলায় দেশে জ্বালানি তেল আমদানি ঝুঁকিপূর্ণ এবং বিলম্বিত হয়ে যাচ্ছে বলে জ্বালানি মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংককে একাধিকবার চিঠি দিয়ে জানিয়েছে বিপিসি। কিন্তু সমস্যার সমাধান এখনো হয়নি। এর ফলে আমদানি কমে গেলে বিদ্যুৎ উৎপাদন আরো ব্যাহত হবে। সংকটে পড়বে পরিবহন খাত। কৃষিসেচেও বিদ্যুৎ সরবরাহ কঠিন হয়ে পড়বে। দেশে পরিবহন খাতের ৯০ শতাংশের বেশি যানবাহন জ্বালানি তেলের ওপর নির্ভরশীল। আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার ৩৪ শতাংশ নির্ভর করে জ্বালানি তেলের ওপর। এমন অবস্থায় পরিবহন খাতে জ্বালানি তেল সরবরাহ ও ব্যবহার অর্ধেক কমিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব তৈরি করেছে বিপিসি। শিগগিরই এটি মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে তারা। জ্বালানি তেল আমদানির জন্য প্রতি মাসে গড়ে ১৫ থেকে ১৬টি আমদানি ঋণপত্র খোলা হয় দেশের ব্যাংকগুলোতে। এখন ৩৫ থেকে ৪০ দিনের জ্বালানি তেল মজুত করতে পারে বিপিসি। ঋণপত্র খুলতে দেরি হলে বিপিসির এই মজুত দিয়ে বেশি দিন চলা যাবে না। রেশনিং করতে হবে।

গত জুন থেকে এ পর্যন্ত চার দফা চিঠির মাধ্যমে অর্থ বিভাগ, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে ঋণপত্র খোলার বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করে বিপিসি। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবারও জ্বালানি বিভাগে বিপিসি চিঠি পাঠিয়েছে। এতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দর এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় যথাসময়ে এলসি খোলা ও মূল্য পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ বলেন, জ্বালানি তেল নিয়ে সব দেশই কমবেশি সংকটে। আমাদের দেশেও এর প্রভাব পড়ছে। ব্যাংকে আমাদের কী সমস্যা হচ্ছে, তা একাধিক চিঠি দিয়ে মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। পাশাপাশি কিছু বিকল্প প্রস্তাবনাও আমরা তুলে ধরব।

কয়লা ও এলএনজিতেও অস্বস্তি

দেশে তেল-গ্যাসের বাইরে কয়লা ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ছাড়া বাকি সবগুলোই এই দুই জ্বালানিনির্ভর। কোভিড-পরবর্তী বাণিজ্যিক উত্তরণের সময় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কয়লা ও এলএনজির দামে উল্লম্ফন ঘটেছে। এতে যে বিকল্প উপায় ও জ্বালানির উপর বাংলাদেশ নির্ভর করছে তাও কম্পমান হয়ে পড়েছে।

জ্বালানিমানে উৎকৃষ্ট যে কয়লার প্রতি টনের দাম ২০২০ সালের ও ২০২১ সালের জুলাইয়ে ছিল যথাক্রমে ৪৮ ও ১৩৯ ডলার তা এখন ৪০০ ডলার ছাড়িয়েছে। সে হিসেবে গত এক বছরে কয়লার দাম বেড়েছে ১৯৪ শতাংশ এবং দুই বছরে বেড়েছে ৭৫৫ শতাংশ।

এদিকে বিশ্ববাজারে প্রতি ইউনিট (এমএমবিটিউ) এলএনজির দাম এখন প্রায় ৪০ ডলার। এক বছরে এ পণ্যের দাম বেড়েছে ২১২ শতাংশ। আর গত দুই বছরে এ বৃদ্ধির হার ১ হাজার ৭০০ শতাংশেরও বেশি।

স্থানীয় উৎস থেকে তাৎক্ষণিক সমাধান নেই

দেশে গ্যাসের প্রমাণিত মজুত যা আছে শুধু তা দিয়ে চললে আগামী চার বছরেই মজুত শেষ হয়ে যাবে। স্বাধীনতার পর এখন পর্যন্ত সমুদ্রভাগে জ্বালানি-খনিজ অনুসন্ধানে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। সমুদ্রসীমা বিরোধ নিরসনের পর ভারত ও মিয়ানমার অনুসন্ধানশেষে উৎপাদন করলেও বাংলাদেশ এখনো অনুসন্ধানই সম্পন্ন করতে পারেনি। স্থল ভাগে বেশকিছু অঞ্চলে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা থাকার কথা জানিয়েছেন ভূতত্ত্ববিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সেদিকেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। ফলে স্থানীয় উৎস থেকে জ্বালানি সরবরাহ বাড়ানোর তাৎক্ষণিক সমাধান নেই।
-ইত্তেফাক