Home শিক্ষা ও ক্যাম্পাস জাবিতে এক বছরে চার শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

জাবিতে এক বছরে চার শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা

239

আগামীকাল বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস।

বোরহান উদ্দীন: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ( জাবি) গত এক বছরে চারজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। তাদের মধ্যে তিনজন ছাত্র ও একজন ছাত্রী। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, আত্মহত্যা প্রতিরোধে কর্মশালা ও সেমিনার আয়োজনের পাশাপাশি হতাশাগ্রস্ত শিক্ষার্থীদের বিশেষভাবে কাউন্সিলিং করা হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২ সেপ্টেম্বর বন্ধুর সাথে ঝগড়ার জের ধরে বন্ধুকে ভিডিও কলে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ্ববর্তী আমবাগান নামক এলাকায় ভাড়া বাসায় গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন ইতিহাস বিভাগের ৪৮ তম আবর্তনের কাজী সামিতা আশকা ওরফে নেহা (২৪) । এর আগে, এপ্রিলের শুরুর দিকে মীর মশাররফ হোসেন হলে ১১৫ নং কক্ষে ফেসবুকে রহস্য জনক ‘অন্তিম যাত্রার পথে’ নামক দীর্ঘ একটি পোস্ট দিয়ে নিজ কক্ষে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মাহত্যা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের ৪৫ তম আবর্তনের শিক্ষার্থী আরফাত রহমান সিয়াম (২৬)।

গত বছরের ১০ ই মে অমিত কুমার বিশ্বাস(২৪) নামে এক শিক্ষার্থী চিরকুটে আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয় লিখে বিশ্ববিদ্যালয়ের রফিক জব্বার হলের ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। কি কারনে তিনি আত্মাহত্যা করেন সে বিষয়ে সুষ্ঠু তথ্য পাওয়া নি। তার আত্মহত্যাটি শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রেও নথিভুক্ত হয়নি। এ বিষয়ে আবার অনেকে বলেন তিনি পা পিছলিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন।
এছাড়াও ২১ জানুয়ারী যশোরের নিজ বাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ- বিজ্ঞান ৪৪ তম আবর্তনের শিক্ষার্থী হাবিবুর রহমান (২৮) বেকারত্বের হতাশা ও পারিবারিক খরছ মিটাতে না পেরে আত্মহত্যা করেন।
তাঁর এক বন্ধু জানান, বেশ কয়েকটি চাকুরিতে তিনি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। কিন্তু কোন চাকুরী না হওয়াতে হতাশার অন্তরালে ডুবে গিয়ে এই কঠিন পথ বেছে নেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু তূলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউটের ৫০ তম আবর্তনের শিক্ষার্থী মোস্তাফিজুর রাহমান বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শ দান কেন্দ্রের কার্যক্রম স্পষ্ট না। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন একটা কেন্দ্র আছে তার কথা হয়তো যে ছেলেটা বা মেয়েটা আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে সে জানতেই পারেনা। অবশ্য জানতে পারলেও সে নিজে থেকে এর দ্বারস্থ হবে এমনটা ভাবাও যায়না, কেননা সে সুস্থ মস্তিষ্কে নাই, সুস্থ মস্তিষ্কে থাকলে সে আত্মহত্যাই তো করতো না। সেজন্য দরকার তার আশেপাশের মানুষজন, বন্ধু, সহপাঠী, শিক্ষকদের সচেতনতা। আমাদের আশেপাশে আত্মহত্যাপ্রবণ কাউকে মনে হলে আমাদের উচিত তার প্রতি সহমর্মিতা জানানো এবং তার বন্ধুদের উচিত তাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারা এবং পরামর্শ কেন্দ্রে তাকে নিয়ে গিয়ে কাউন্সেলিং করানো। আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শ দান কেন্দ্রের আরো বেশি কার্যক্রম চালানো দরকার। প্রয়োজন হলে সেমিনার করা যেতে পারে। লিফলেট বিতরণ কিংবা অনলাইনে সচেতনার প্রচার প্রচারণা চালানো যেতে পারে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী রবিউল হাসান বলেন,আত্মহত্যার প্রধান কারণ যেহেতু মানসিক অশান্তি।তাই শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের মানসিক অশান্তির কথা মনোবিদদের কাছে সমাধানের জন্য জানাতে আগ্রহী হয় সে ব্যাপারে প্রচারণা বাড়িয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। আমার মনে হয় একটা মানুষ মনের কথা বলতে না পেরেই বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে আত্মহত্যার দিকে পা বাড়ায় তাই এটির সমাধানের দিকে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী হওয়া উচিত এবং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, শিক্ষক সকলেরই উচিত এ নিয়ে সচেতনতা তৈরি করা, সকলের মাঝে বাঁচার আগ্রহ জাগিয়ে তোলা। কারণ মৃত্যু কোন সমস্যার সমাধান নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের উপ-পরিচালক মনোবিজ্ঞানী শুভাশীষ কুমার চ্যাটার্জী সাম্প্রতিক আত্মহত্যাগুলো নিয়ে বলেন, শিক্ষার্থীরা তাদের চলার পথে সম্পর্কের দ্বন্দ্ব গুলোকে সঠিক মীমাংসা করতে না পেরে একাকিত্বে ভুগে।এই একাকিত্ব থেকে তারা আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আবার বর্তমান সময়ে শিক্ষার্থীরা পরিবার থেকে একটা বিচ্ছিন্ন থাকতে চায়। আগে যেমন পরিবারের সাথে একটা গভীর সম্পর্ক ওটার জায়গা একটু ছোট হয়ে গেছে বলা যায়। তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক একটা চাপ থাকে অনেকে এই বিষয়টি নিতে পারেন না। একাডেমিক পড়া শেষ হলেও অনেকের দ্রুত চাকরী না হওয়াতে হতাশায় ডুবে যায়। প্রেম সম্পর্ক এগুলোর বিচ্ছেদ ভার্চুয়াল সম্পর্ক এগুলোর মারাত্মক ঝুঁকি বেড়েছে।যার কারণে আগের চাইতে আত্মহত্যার হার বেড়েছে কয়েকগুণে। অনেকে আবার দেখা যায় নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। হঠাৎ করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নে।

আত্মাহত্যার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী কল্যাণ ও পরামর্শদান কেন্দ্রের অবস্থান ও কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন শিক্ষার্থী যখন আমাদের কাছে আসে তখন আমরা তখন বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাকে পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করি। তার ডিপ্রেশনের মাত্রা কতটুকু তার এখন কি অবস্থা। এসব বিষয়ের উপর নির্ভর করে আমরা ব্যক্তিগত কাউন্সিলের ব্যবস্থা করি। ওয়ার্নিং সাইন বেশি দেখা যায় অর্থাৎ ঝুঁকি মারাত্মক হয় তাহলে আমরা তাকে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে হস্তান্তর করি এবং ঐ শিক্ষার্থীর আবাসিক হলের আবাসিক শিক্ষকদের এবং বিভাগের চেয়ারম্যানকে বিষয়টি অবহিত করি। আমরা চেষ্টা করতেছি প্রথমদিকে যখন শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে তখন তাদের কাছে মানসিক স্বাস্থ্য সচেতন করা। এর অংশ হিসেবে আমরা বিভিন্ন বিভাগে গিয়ে ক্লাসের মতো করে কাজ করে যাচ্ছি। গত বছরে এই কাজটি ব্যাপক সাড়া পেলেছে। আবার এক্ষেত্রে অনেক সময় বিভাগের সভাপতির সহযোগিতা পাওয়া যায় না। যার কারণে আমাদের কাজ করা কঠিন হয়ে যায়। তবে আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি সর্বোচ্চ আন্তরিকা দিয়ে কাজ করার। গত এক বছরে আমরা ১৫ এর অধিক শিক্ষার্থীকে গুরুতর হতাশা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আনতে সক্ষম হয়েছি।

শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা প্রতিরোধের বিষয়ে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের সবসময় সচেতন থাকতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে মানসিকভাবে শক্ত থাকতে হবে। পরিবার পরিজনের সাথে ভালো সম্পর্ক রাখতে হবে। বন্ধু বান্ধবের সাথে যেকোন সমস্যা শেয়ার করতে হবে। ধর্মীয় বিশ্বাস গুলো মেনে চলতে হবে। তাহলে আত্মাহত্যার হার কমে যাবে।
তিনি আরো জানান, আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবাইক সমন্বিত হয়ে কাজ করতে হবে। আসলে কার মনে কি আছে বলা যায় না। আশেপাশের বন্ধু বান্ধব সিনিয়র জুনিয়র সকলের খোজ নিতে হবে। যদি কোন সমস্যা দেখা যায় কিংবা বুঝা যায় সাথে সাথে যাতে আমাদের জানায়। বিশ্ববিদ্যালের শিক্ষকদের তিনি এগিয়ে আসতে বলেন। শিক্ষকরা এগিয়ে আসলে সবার ভিতর সুন্দর সম্পর্ক থাকলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ সম্ভব।