ডেস্ক রিপোর্ট: বলা হয়, আধুনিক ব্রিটেনের জননী বা ব্রিটেনকে ক্রমেই বিশ্বের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে যার গুরুত্বপূর্ণ অবদান তিনি রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ। জীবনের প্রথম এক দশকে যিনি রানি হওয়ার আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ করেননি। তিনি ছিলেন এক স্বাধীন শিশু। প্রিয় কুকুর এবং ঘোড়ার সঙ্গে খেলা করাই ছিল তার শখ এবং ধ্যান-জ্ঞান। একদশক পরে তার সামনে কী আছে তা তিনি কখনো চিন্তাই করেননি। কিন্তু তার জীবনের সব গল্প কিন্তু সেটা বলছে না।

ছোট্ট এলিজাবেথকে দাদা রাজা পঞ্চম জর্জ ‘লিলিবেট’ বলে ডাকতেন। এটা একসময় তার পারিবারিক নাম হয়ে দাঁড়ায়। তার পুরো নাম ছিল এলিজাবেথ আলেকজান্ড্রা মেরি। এলিজাবেথ তার মায়ের নাম এবং মেরি তার দাদির নাম। ছোট্ট সেই আলেকজান্ড্রাই গত ৬ ফেব্রুয়ারি ব্রিটেনের রানি হওয়ার ৭০ বছর পূর্ণ করলেন এবং জীবনের ৯৪টি বছর পার করে ৯৫ বছর কাটাচ্ছেন। ১৯২৬ সালের ২২ এপ্রিল ২টা ৪০ মিনিটে (জিএমটি) জন্ম নেওয়া প্রিন্সেস এলিজাবেথকে আধুনিক যুগের প্রিন্সেস ব্রিটেসের (প্রিন্স ডিউক অব ইয়র্কের মেয়ে) তুলনা করা হয়।

ছোট্ট এলিজাবেথকে দাদা রাজা পঞ্চম জর্জ ‘লিলিবেট’ বলে ডাকতেন
লিলিবেটের জীবনে প্রথম নাটকীয় পরিবর্তন আসে ১৯৩৬ সালে। ঐ বছর তার চাচা ডেভিড তথা অষ্টম অ্যাডওয়ার্ড আমেরিকান বিধবা নারী ওয়ালিস সিম্পসনকে বিয়ের জন্য সিংহাসন ত্যাগ করেন। রাজপরিবার এবং সারা বিশ্ব তখন বিস্মিত হয়েছিল। অনেকে ডেভিডের এই ঘোষণায় ভেঙে পড়েছিলেন। আর এলিজাবেথের জীবনেও এই ঘটনা বিস্ময় হিসেবে দেখা দিয়েছিল। তবে সেটা ছিল আনন্দের। কারণ ১০ বছরের এলিজাবেথ সেই সময় জেনে গিয়েছিলেন তিনিই হচ্ছেন ভবিষ্যত্ ব্রিটেনের রানি। এলিজাবেথ লন্ডনের মেফেয়ারে ইয়র্কের ডিউক এবং ডাচেস (পরে রাজা জর্জ এবং রানি এলিজাবেথ) এর প্রথম সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার মার্গারেট নামে ছোট একটা বোন ছিল। তার বাবা ১৯৩৬ সালে নিজের ভাই রাজা অষ্টম অ্যাডওয়ার্ডের পরে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।

প্রশ্ন আসতে পারে, শিশু এলিজাবেথ কী রানি হওয়ার জন্য এতটা অপ্রস্ত্তত ছিলেন? ঘটনা জানলে হয়তো সেই রকমটা মনেই হবে না। এলিজাবেথ ঐ বছরের ডিসেম্বরে তার ছয় বছর বয়সি বোন মার্গারেট রোজকে বলেন, ‘বাবা রাজা হচ্ছেন’। মূলত তিনি রাজপ্রাসাদের বাইরে অনেক মানুষের জটলা দেখে এই মন্তব্য করেছিলেন। মার্গারেট বলেন, ‘তার মানে তুমি রানি হতে যাচ্ছ?’ এলিজাবেথ খুব ঠান্ডা মাথায় জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, তাই-ই হয়তো হবে’। ১৯৮০-এর দশকে এক অনুষ্ঠানে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এই ঘটনা যখন বলছিলেন তখন মার্গারেটও কৌতুক করেছিলেন। দুই দশক পর মার্গারেটও একই গল্প ঐতিহাসিক বেন পিমলটের কাছে বলেছিলেন।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্রথম মডেল ছিল তার দাদা রাজা পঞ্চম জর্জ (১৮৬৫-১৯৩৬)। এলিজাবেথ তাকে ‘গ্র্যান্ডপা ইংল্যান্ড বা দাদা ইংল্যান্ড’ বলে ডাকতেন। এর মাধ্যমেই তার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় মিলেছিল। তিনি রাজকীয় বিষয় কতটা বুঝেছিলেন তারই প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯২৯ সালে এপ্রিলে এলিজাবেথের তৃতীয় জন্মদিনে টাইম ম্যাগাজিনে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রচ্ছদে তাকে ‘প্রিন্সেস লিলিবেট’ নামে উল্লেখ করা হয়।

যৌবনে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ
১৯২৯ সালের শুরুর দিকে রাজা পঞ্চম জর্জ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে তার নাতি একদিন ব্রিটেনের সিংহাসনে আরোহণ করবেন। লিলিবেটের বাবাকে পঞ্চম জর্জ বলেছিলেন, তোমার ভাই রাজা হতে পারবে না। রানির মা কয়েক বছর পর এই গল্পটি বলেছিলেন এবং বলেছিলেন আমরা এটা হাস্যকর বলেই উড়িয়ে দিয়েছিলাম। পুত্র ডেভিডকে নিয়ে রাজা পঞ্চম জর্জই খুবই হতাশ ছিলেন। ব্রিটেনের অর্থমন্ত্রী থাকাকালে উইনস্টন চার্চিল (পরে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী, রানি যাকে প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পেয়েছিলেন) স্ত্রীর কাছে লেখা এক চিঠিতে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, এলিজাবেথই ব্রিটেনের রানি হবেন।

তিনি বলেছিলেন, লিলিবেটের মধ্যে আশ্চর্যজনক কর্তৃত্ব এবং প্রতিফলনের নিদর্শন রয়েছে। ঐ সময় এলিজাবেথ দাদার সঙ্গে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন। পরিস্হিতি এমন হয়েছিল যে তাকে মানুষ অনেক উপহার পাঠাতে শুরু করল এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাকে উপস্হিত করার জন্য রাজার ওপর চাপ বাড়তে থাকল। দাদা দেখেছিলেন ছোট্ট এলিজাবেথ কীভাবে বালির দুর্গ গড়ে তুলেছিলেন। এর একটি ছবিও প্রকাশ পেয়েছিল। ১৯৩০ সালের গ্রীষ্মে চতুর্থ জন্মদিনে প্রিন্সেস এলিজাবেথের একটি মোমের মূর্তি মাদাম তুসো জাদুঘরে স্হান পেয়েছিল। এর দুই বছর পর নিউফাউন্ডল্যান্ডে একটি ছয় সেন্টের স্ট্যাম্পে রাজকন্যাকে চিত্রিত করা হয়েছিল। মা-বাবা শিল্পী ফিলিপ দে লাসজলোকে লিলিবেটের একটি ছবি আঁকতে বলেছিলেন। চিত্রশিল্পী মেয়েটিকে সবচেয়ে বুদ্ধিমান এবং সুন্দরী হিসেবে এঁকেছিলেন। তার ছবিতে এটা বোঝানোর চেষ্টা ছিল যে বর্তমানে ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আছেন গ্রেট ব্রিটেনের রানি।

১৯৩৪ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রের একটি পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয় যে অষ্টম অ্যাডওয়ার্ড রাজা হতে চান না। কারণ, তিনি ভিন্ন আনন্দ উপভোগ করার জন্য এই আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন ঘনিষ্ঠজনদের কাছে। এজন্য শিশু এলিজাবেথ ভবিষ্যতে রানি হওয়ার কঠিন শিক্ষা গ্রহণ করছেন। অষ্টম অ্যাডওয়ার্ডের ঘনিষ্ঠ সহযোগী এই খবর দিয়েছিলেন।

এলিজাবেথ কতটা বুদ্ধিমতী ছিলেন তা জানা যায় আরো একটি ঘটনায়। তিনি একজন গভর্নরকে বলেছিলেন, আমি রানি হলে এমন একটা আইন করব যাতে রবিবার ঘোড়ায় চড়া নিষিদ্ধ থাকবে। কারণ ঘোড়াদেরও বিশ্রামের দরকার হয়। দাদি রানি মেরি এলিজাবেথের বুদ্ধিমত্তার বিষয়টি জানতে পেরেছিলেন যখন তিনি একটা কনসার্টে গিয়েছিলেন। নাতনি কীভাবে অধৈর্য হয়ে ঘোরাফেরা করছিলেন তা তিনি লক্ষ্য করলেন।

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ
এলিজাবেথকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি বাড়ি যাবে কি না।’ এলিজাবেথের জবাব, ‘আরে দাদি। আমরা কনসার্ট শেষ হওয়ার আগে যেতে পারি না। সেই সব মানুষের কথা ভাবুন, যারা আমাদের বাইরে দেখার জন্য অপেক্ষা করবে।|’ এরপর রানি মেরি দ্রুত একজনের মাধ্যমে এলিজাবেথকে পেছনের দরজা দিয়ে বাইরে নিয়ে ট্যাক্সিতে রাজপ্রাসাদে যান। এসব ঘটনা থেকে ধারণা করা হয়, সাত বছর বয়সের মধ্যে ভবিষ্যত্ দ্বিতীয় এলিজাবেথ তার জন্য সামনে কী রয়েছে তার একটি ধারণা অর্জন করেছিলেন অর্থাত্ তার চাচা সিংহাসন ত্যাগেরও তিন বছর আগে।

১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বাবা রাজা ষষ্ঠ জর্জ মারা গেলে দ্বিতীয় এলিজাবেথ কমনওয়েলথের প্রধান হন এবং সাতটি কমনওয়েলথভুক্ত দেশের রেজিমেন্টের প্রধান হন। তিনি এখন ১৬টি সার্বভৌম দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। যদি তার বাবা-মায়ের পরবর্তীকালে পুত্র হতো তবে সেই পুত্রই উত্তরাধিকারী হয়ে উঠত এবং উত্তরাধিকারের তালিকায় তার ওপরে থাকত, যা তত্কালীন প্রথম পুরুষ পছন্দ দ্বারা নির্ধারিত হতো।

১৯৫৩ সালে তার রাজ্যাভিযান এবং ১৯৭৭, ২০০২ এবং ২০১২ সালে যথাক্রমে তার রৌপ্য, স্বর্ণ এবং হীরক জয়ন্তী উদযাপন অন্তর্ভুক্ত। ২০১৭ সালে তিনি নীলকান্তমণি জয়ন্তীতে পৌঁছানো প্রথম ব্রিটিশ রাজ্যশাসক হয়েছিলেন। তিনি সবচেয়ে দীর্ঘজীবী এবং সবচেয়ে দীর্ঘকাল ধরে শাসনকারী ব্রিটিশ রাজ্যশাসক। তিনি বিশ্বের ইতিহাসের দীর্ঘতম শাসনকারী নারী রাষ্ট্রপ্রধান এবং বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক জীবিত রাজ্যশাসক, বর্তমানে জীবিত রাজা-রানিদের মধ্যে সর্বাধিক দীর্ঘকালীন ধরে শাসনকারী রাজ্যশাসক এবং বর্তমান রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে সর্বাধিক প্রবীণ ও দীর্ঘকালীন রাষ্ট্রপ্রধান। এ বছর তিনি প্লাটিনাম জুবিলি পালন করছেন।

স্বামী প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ
এলিজাবেথ তার ভবিষ্যত্ স্বামী, গ্রিস এবং ডেনমার্কের প্রিন্স ফিলিপের সঙ্গে ১৯৩৪ এবং ১৯৩৭ সালে দেখা করেছিলেন। ১৯৩৯ সালের জুলাইয়ে ডার্টমাউথের রয়্যাল নেভাল কলেজে আরেকটি বৈঠকের পরে এলিজাবেথ (যদিও তার বয়স তখন মাত্র ১৩ বছর ছিল) বলেছিলেন যে তিনি ফিলিপের প্রেমে পড়েছেন এবং তারা চিঠি আদান-প্রদান শুরু করে। ১৯৪৭ সালের ৯ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে বাগদানের ঘোষণা দেওয়ার সময় রানির বয়স ছিল ২১ বছর। এলিজাবেথ এবং ফিলিপ ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে ১৯৪৭ সালের ২০ নভেম্বর বিয়ে করেছিলেন। তারা বিশ্ব জুড়ে ২ হাজার ৫০০টি বিয়ের উপহার পেয়েছিলেন। ব্রিটেন তখনো যুদ্ধের বিধ্বস্ততা থেকে পুরোপুরি সামনে উঠতে পারেনি, তাই এলিজাবেথকে তার গাউনটির জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে রেশন কুপনের প্রয়োজন হয়েছিল।-ইত্তেফাক